বলিউডের যাপিত বৈষম্যের বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন যে তারকারা
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
বৈষম্য অথবা সংকট, আছে সর্বত্রই। তবে যেটা সর্বত্র নেই, সেটা হচ্ছে- এসবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। যে প্রতিবাদটাই বরাবর করেন বলিউডের শিল্পীরা। এবং, ঠিক যেখানটাতে এসেই তারা অনন্য৷ ইতালির কবি দান্তে অলিঘিয়েরি বলেছিলেন- সংকটে যারা চুপ থাকে, তারাই সবচেয়ে বড় অপরাধী। যে অপরাধে আর যেই অপরাধী হোক না কেন, বলিউডের এ তারকারা যে মোটেও হবেন না, সেটাই সবচেয়ে বড় কথা...
'ওক কালচার' গ্লোবালি বেশ জনপ্রিয় এক টার্ম। আফ্রিকান আমেরিকান ভার্নাকুলার ইংলিশে প্রথমবারের মতন আবির্ভূত হওয়া এই বিশেষ কালচার, সময়ের ফেরে বেশ গুরুত্বপূর্ণ এক সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনেই রূপান্তরিত হয়েছে। লিঙ্গবৈষম্য, বর্ণবিদ্বেষ কিংবা সামাজিক নিরাপত্তা... সবকিছু নিয়েই নিয়মিত সরব এই 'ওক কালচার' এর অনুরাগী বহু দেশের বহু মানুষও। আপোষের সাথে ক্রমশ আঁতাত করার এই যে বিক্ষুব্ধ সময়, সে সময়ে দাঁড়িয়ে ভীষণ ব্যতিক্রমী এ কালচারের যে প্রয়োজনও বিস্তর, সেটিও তীব্র সত্যি। এবং এ প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করছেনও অনেকে। সে কারণেই হয়তো, খুব ছোট জায়গা থেকে শুরু হওয়া 'ওক কালচার' দ্রুতবেগে ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের সর্বত্র। আশেপাশে যদি দৃষ্টান্ত খুঁজি, তাহলেও যেতে হবে না বহুদূর, ঘরের পাশে বলিউডের দিকে তাকালেই দেখা যাবে, সেখানের অধিকাংশ তারকাই এই 'ওক কালচার' এর একনিষ্ঠ সমর্থক। সময়ের নানা ফেরে তারা বলিউডি নানা প্রসঙ্গে সরব হয়েছে। প্রত্যক্ষে ও পরোক্ষে দিয়েছেন 'ওক কালচার'কে সমর্থন। সেসব বলিউডি তারকার মধ্যে থেকে অগ্রগণ্য কয়েকজন, যারা সংকটে নিশ্চুপ না থেকে নিয়েছিলেন দৃঢ় পদক্ষেপ, রাখঢাক না করেই উচ্চারণ করেছিলেন সত্যবচন...তাদের নিয়েই আজকের কথাবার্তা।
বেশিদিন আগের কথা না, নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকী বিশেষ এক সাক্ষাৎকার দিলেন জনপ্রিয় এক নিউজ পোর্টালে। যেখানে কথা হচ্ছিলো বলিউডের নেপোটিজম নিয়ে। এবং সেই সাক্ষাৎকারের এক পর্যায়ে তিনি আচমকাই এমন এক মন্তব্য করলেন, যা শুনে নড়েচড়ে বসতে হলো। যে মন্তব্যের মূলকথা- বলিউডে নেপোটিজমের চেয়েও বড় সমস্যা, রেসিজম। যে সমস্যার ভুক্তভোগী তিনি। এবং যে সমস্যার কারণেই বলিউডের মেইনস্ট্রিম সিনেমায় কৃষ্ণবর্ণের কোনো নায়িকা আসেনি আজও! নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকীর এই কথার পরে টনক নড়েছিলো প্রায় সবারই। কারণ, কথাটা এমনই, সবারই জানা। কিন্তু আজতক বলেনি কেউই। এমন এক প্রসঙ্গে নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকী হুট করে সরব হবেন এবং বলিউডি কালচারের একেবারে গোড়া ধরে টান দেবেন... তা ছিলো ভাবনারও অতীত।
প্রসঙ্গত জানাই, বর্ণবৈষম্যের এই সমস্যার শিকার হয়েছিলেন আরেক বলিউডি তারকাও। সীমা পাহওয়া। যাকে বলিউডের 'ক্রিয়েটিভ' ঘরানার সিনেমায় সবসময়েই দেখা যায়। কিন্তু যখনই তিনি বলিউডি কমার্শিয়াল সিনেমায় অভিনয় করতে চেয়েছেন, তাকে বাতিল করা হয়েছে বারবার৷ ক্ষমাঘেন্না করে মাঝেমধ্যে যাও দুয়েকটা চরিত্র দেয়া হতো, তার অধিকাংশতেই থাকতো দুই-তিন সেকেন্ডের পাসিং শট! শুধুমাত্র গাত্রবর্ণ উজ্বল না হবার কারণেই এই বৈষম্য তাকে সহ্য করতে হয়েছে বহুদিন।
বলিউডের আরেক অসুস্থ সংস্কৃতির নাম- বডি শেমিং। 'নায়িকা' মানেই জিরো ফিগার, যৌন উত্তেজক দেহভাঁজ, মেদবিহীন দেহসৌষ্ঠব... বিচিত্র মাপকাঠি! বলিউডের অন্যতম সেনসেশন প্রিয়াঙ্কা চোপড়া এই সংস্কৃতির বিরুদ্ধেই হয়েছিলেন উচ্চকণ্ঠ। যিনি 'জিরো ফিগার' কিংবা 'আর্টিফিশিয়ালি বডি ফিগার ডেভেলপ' করারও ছিলেন ঘোরতর বিরোধী। যিনি মনে করেন, শরীরে সামান্য মেদ আর অল্পবিস্তর খুঁত থাকলেও, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা উচিত না মোটেও। প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার মত এই বিষয়টাতে সরব হয়েছিলেন বিদ্যা বালানও। বিদ্যা বালানকে 'ফ্যাট শেমিং' করা হয়েছে বহুদিন। তিনি আসলে নায়িকা হওয়ারও যোগ্য না... বলা হয়েছে এসবও। হরমোনাল সমস্যার কারণে তিনি বরাবরই খানিকটা হৃষ্টপুষ্ট। এটা নিয়েও ক্রমশ তাকে হতে হয়েছে বিদ্রুপের স্বীকার। গুরুত্বপূর্ণ এটাই, এসবের বিরুদ্ধে বেশ সরব হয়েছিলেন বিদ্যা বালানও। পাশাপাশি, অভিনয় দিয়েও স্তব্ধ করেছিলেন বহু নিন্দুকের মুখ।
'স্টার কালচার' নিয়ে বলিউডের বাতিক বহু পুরোনো। বড় কোনো তারকা এলে অন্যায়ভাবে অন্য অভিনেতাকে বাতিল করে দেয়া বলিউডের বহু পুরোনো অভ্যাস৷ যেই অভ্যাসের প্রতিক্রিয়ায় ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছিলো মনোজ বাজপেয়ী, অভয় দেওল, তাপসী পান্নু সহ অনেককেই। ক্যারিয়ারের শুরুতে এমন বহুবারই হয়েছে, অডিশন থেকে বাছাই করবার পরেও শেষমুহুর্তে কিছু না জানিয়েই বাদ দেয়া হয়েছে তাদের। বহুকাল ধরে এই অসম সংস্কারের সাথে লড়াই করে আসা এ অভিনয়শিল্পীরা এসব নিয়ে চুপও থাকেননি। কথা বলেছেন। নিজেদের মত করে বলেছেন। কোনোরকম পর্দার বালাই না রেখেই তারা সমালোচনা-বাণে বিদ্ধ করেছেন প্রশ্নবিদ্ধ এ 'স্টার কালচার'কে।
'পারিশ্রমিক বিভ্রাট'... বলিউডের আরেক ব্যাধি। নারী হলে পুরুষদের তুলনায় কম পারিশ্রমিক, সিনেমার কাজ শেষ হলেও পারিশ্রমিক ঝুলিয়ে রাখা বহুদিন, প্রতিশ্রুতিবদ্ধ পারিশ্রমিক না দিয়ে প্রবঞ্চনা... নানাবিধ সমস্যা। এই সমস্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন অনেক অভিনয়শিল্পীই৷ বলা যেতে পারে, সোনম কাপুরের কথা৷ যিনি পারিশ্রমিকের নানাবিধ সমস্যায় জেরবার হয়ে সিদ্ধান্তই নিয়েছিলেন, যেসব সিনেমায় নারীর তুলনায় পুরুষকে বেশি পারিশ্রমিক দেয়া হয়, সেসব সিনেমায় তিনি অভিনয় করবেন না৷ এবং তিনি করেনওনি। 'পারিশ্রমিক' এর বিষয়ে কথা বলেছিলে দীপিকা পাড়ুকোনও৷ যেসব সিনেমায় তার শ্রম বেশি, ত্যাগ বেশি, সেসব সিনেমায় তাকে কম পারিশ্রমিক কেন দেয়া হবে... এটাই ছিলো তার প্রশ্ন৷ এবং শুধু প্রশ্ন করেই থেমে থাকেননি তিনি। একটা সিনেমায় অভিনয় করা থেকে সরে এসেছিলেন শুধুমাত্র এ বৈষম্যের কারণেই।
বৈষম্য অথবা সংকট... আছে সর্বত্রই। তবে যেটা সর্বত্র নেই, সেটা হচ্ছে- এসবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। যে প্রতিবাদটাই বরাবর করেন বলিউডের শিল্পীরা। এবং, ঠিক যেখানটাতে এসেই তারা অনন্য৷ ইতালির কবি দান্তে অলিঘিয়েরি বলেছিলেন- সংকটে যারা চুপ থাকে, তারাই সবচেয়ে বড় অপরাধী। যে অপরাধে আর যেই অপরাধী হোক না কেন, বলিউডের এ তারকারা যে মোটেও হবেন না, সেটাই সবচেয়ে বড় কথা। সেটাই প্রাসঙ্গিক। এবং, এখান থেকেই মূলত শেখার আছে বহুকিছু।