দুই-আড়াই ঘন্টার সিনেমায় অল্প রানটাইমে এসেও এসব চরিত্রেরা ক্রমশ যেভাবে সঞ্চার করেছে শঙ্কা, কেড়ে নিয়েছে রাতের নিরাপদ ঘুম, তা বিবেচনায় এই তুখোড় শিল্পীদের প্রতি কুর্নিশ জানানোই প্রাসঙ্গিক। সে সাথে ক্যামেরার সেতু দিয়ে প্রবেশ করে ক্রমশ যেভাবে তারা স্থায়ী হয়েছে অন্দরমহলে, তা ভাবলেও বিস্তর শ্রদ্ধাবোধে বিনয়াবনত হতে হয়!

অভিনয়ের সুবাদে যখন কোনো কুশীলব কল্পিত এক চরিত্রকে জ্যান্ত করে নিয়ে আসেন পর্দায়, বোধহয় ঠিক তখনই ঘটে চমৎকারিত্ব। ক্যামেরার চোখ ভেদ করে সেই চরিত্র ঢুকে পড়ে হৃদয়ের অন্দরমহলে। যুগে যুগে কালে কালে নানা ইন্ডাস্ট্রির বহু কালজয়ী চরিত্রই এরকম আছেন, বিশেষ কোনো অভিনেতার অভিনয়শৈলীর সাপেক্ষে তারা পেয়েছে অমরত্বের স্থায়ী বর। সেরকমই কিছু চরিত্র নিয়েই আজকের সুলুকসন্ধান, যারা নেতিবাচক চরিত্র হওয়া সত্বেও তাদের নিয়ে কথা হয় আজও। পর্দায় যাদের উপস্থিতি এখনও মনে ভয় ধরায়। শিরদাঁড়া দিয়ে ভয়াল ঠাণ্ডা স্রোত নেমে আসার আবহ তৈরী হয়। 

১. অ্যান্থনি হপকিন্স (সাইলেন্স অব দ্য ল্যাম্বস) 

'সাইলেন্স অব দ্য ল্যাম্বস' যারা দেখেছেন, তাদের অনেকেরই যে রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিলেন 'হানিবল লেক্টার' নামের এ সিনেমার বিশেষ সেই খলচরিত্র, তা বোধহয় আলাদা করে আর না বললেও চলে। 'ডঃ হানিবল' নামের হিংস্র এক সাইকোপ্যাথের চরিত্রে দুর্দান্ত অভিনয় করে অ্যান্থনি হপকিন্স জিতে নিয়েছিলেন অস্কারও। মেরেকেটে ষোলো-সতেরো মিনিট স্ক্রিনে ছিলেন তিনি, এবং স্ক্রিনটাইমের পুরোটাতেই সঞ্চার করেছেন বিস্তর শঙ্কার আবহ! 

সাইলেন্স অব দ্য ল্যাম্বস! 

২. জ্যাক নিকলসন (দ্য শাইনিং) 

স্টিফেন কিং এর বিখ্যাত উপন্যাস 'দ্য শাইনিং' অবলম্বনে স্ট্যানলি কুবরিক যে সিনেমা বানালেন এবং সেখানে 'জ্যাক টোর‍্যান্স' চরিত্রে যে পৈশাচিক এক আবহ তৈরী করলেন জ্যাক নিকলসন, তা বহুদিন মনে থাকবে দর্শকের। জান্তব হাসি ও মুখচোখের অস্বাভাবিক, উন্মাদ অঙ্গভঙ্গিতে তিনি যেভাবে ত্রাস সঞ্চার করেছিলেন পর্দায়, তা ভীতিকর ও উপভোগ্য...একইসাথে দুটি অনুভূতিই দিয়েছে। এই সিনেমাটি প্রথমবার যে দর্শকই দেখবেন, জ্যাক নিকলসনের অভিনয় দেখে যে অবধারিতভাবেই শিউরে উঠবেন বা ঘাবড়ে যাবেন, তা নির্দ্বিধায় বলে দেয়া যায়। 

দ্য শাইনিং! 

৩. হেলেনা বনহাম কার্টার (হ্যারি পটার ফ্রাঞ্চাইজি)

'হ্যারি পটার' সিরিজের বইগুলো যারা গুলে খেয়েছেন, এই সিরিজের প্রতিটি নির্মাণও যাদের নখদর্পনে, যারা নিজেদের দাবী করেন 'ট্রু পটারহেড' হিসেবেও, তারা খুব ভালোভাবেই 'বেলাট্রিক্স লেসট্রেঞ্জ' চরিত্রটির সাথে পরিচিত। এবং এই চরিত্রটি সবার কাছে দারুণ ভাবে ঘৃণিতও। 'হ্যারি পটার' সিরিজের প্রিয় সব চরিত্রেরা তার বদৌলতেই যেসব যন্ত্রণার মুখোমুখি হয়েছে, তা বিবেচনায়, তাকে নিয়ে নিন্দা করাই সমীচীন। খুবই আলোচিত এই চরিত্রটিকে পর্দায় দুর্দান্তভাবে জ্যান্ত করলেন যে হেলেনা কার্টার, প্রশংসা করতে হয় তার অভিনয়শৈলীরও। নিজ অভিনয়গুণেই তিনি অর্জন করে নিয়েছেন দর্শকের যাপিত ঘৃণা! 

হ্যারি পটার ফ্রাঞ্চাইজি! 

৪. হিথ লিজার (দ্য ডার্ক নাইট) 

ব্যাটম্যানের 'জোকার' চরিত্রে অভিনয় তো অনেকেই করেছেন। তবুও 'জোকার' নিয়ে কথা বলতে গেলে প্রথমেই মাথায় আসবে হিথ লিজারের নাম। নোলানের 'দ্য ডার্ক নাইট' এ যে দোর্দণ্ডপ্রতাপের সাথে তিনি 'জোকার' চরিত্রে অভিনয় করেছেন, কিছু ক্ষেত্রে 'ব্যাটম্যান'রূপী ক্রিশ্চিয়ান বেলকেও ম্লান করে দিয়েছিলেন তিনি। 'জোকার' চরিত্রকে বহু অভিনেতাই সঙ্গ দিয়েছেন, কিন্তু, ভীতি-ত্রাস-রোমাঞ্চের মিলিত ফলাফলে যে অবস্থানে এই চরিত্রকে হিথ লিজার গিয়েছেন, সেখানে আর কেউ যেতে পারবে কী না, তা নিয়ে সংশয় থাকবেই।

দ্য ডার্ক নাইট! 

৫. আশুতোষ রানা (সংঘর্ষ) 

হিজড়া এক কিডন্যাপার হয়ে ছোট বাচ্চাদের ধরে ধরে আধ্যাত্মিক সাধনায় উৎসর্গ করার যে পৈশাচিক চরিত্রে অভিনয় করার সুযোগ আশুতোষ রানা পেয়েছিলেন 'সংঘর্ষ' সিনেমায়, সে চরিত্রে তিনি যে পুরোদস্তুর সফল, তা একটি ঘটনার উদাহরণ দিলেই বুঝতে পারা যাবে। এই সিনেমা প্রথমবার দেখার পরে আশুতোষ রানার স্ত্রীও তার সাথে দেখা করতে ভয় পাচ্ছিলেন, এতটাই অনবদ্য ছিলো সিনেমায় তার অভিনয়! এই সিনেমায় তার অভিনয়ের কথা চিন্তা করলে এখনো গায়ে কাঁটা দিয়ে যায়! 

সংঘর্ষ!  

৬. উইলিয়াম ড্যাফো (স্পাইডারম্যান)। 

স্পাইডারম্যান যখন ২০০২ সালে মুক্তি পায়, সে নির্মাণে স্পাইডারম্যানকে নাকানিচোবানি খাইয়েছিলেন ক্রুর খলনায়ক গ্রিন গবলিন। এতটাই অমানবিক এই গ্রিন গবলিন, এখনও এই চরিত্রকে  ইতিহাসের অন্যতম নিষ্ঠুর ভিলেন হিসেবেই গন্য করা হয়। আর নিষ্ঠুরতার এই বিষয়টিকেই পর্দায় জ্যান্ত করে তুলেছিলেন যে মানুষ, তিনি উইলিয়াম ড্যাফো। 'স্পাইডারম্যান সিরিজ' এর নতুন পর্বেও গ্রিন গবলিন থাকবেন। এবার নিষ্ঠুরতার আর কোন উপাখ্যান দেখতে হবে, সেটিই এখন দেখার অপেক্ষা।

স্পাইডারম্যান! 

৭. সাইফ আলী খান (ওমকারা) 

ক্ষমতার জন্যে মানুষ কতটা নীচে নামতে পারে, সেটিরই যেন এক অদ্ভুত প্রতিফলন ঘটেছিলো বিশাল ভরদ্বাজের  'ওমকারা' সিনেমার এক চরিত্রের মধ্যে। এ সিনেমায় বিশেষ চরিত্র 'ল্যাংড়া তিয়াগি'রূপে  যে অভিনয় করলেন সাইফ আলী খান, তা একইসাথে অনবদ্য এবং হিংস্র। এই সিনেমায় বিশেষ এ চরিত্রে অভিনয়ের পরে সাইফ আলী খানের জনপ্রিয়তাও বেড়ে গিয়েছিলো বহুগুণ! লোভ-লালসা-সংকীর্ণতা মানুষকে কিভাবে পশুতে রূপান্তরিত করে, সেটিরই যেন সার্থক প্রতিফলন ছিলো 'ল্যাংড়া তিয়াগি' চরিত্রটি! 

ওমকারা! 

৮. রনবীর সিং (পদ্মাবত)

সঞ্জয় লীলা বানসালীর 'পদ্মাবত' এ 'সুলতান আলাউদ্দিন খিলজি'র চরিত্রে যে ভয়ঙ্কর অভিনয় রনবীর সিং করেছিলেন, তা চোখে লেগে থাকবে বহুদিন। ইতিহাসের হলদেটে পৃষ্ঠা সাক্ষ্য দেয়, আলাউদ্দিন খলজি বরাবরই ছিলেন ত্রাস-সৃষ্টিকারী শাসক। সেটিরই যেন সার্থক রূপান্তর দেখি রনবীর সিংয়ের অভিনয়ে। যতক্ষণ রানটাইম পেয়েছেন, নিজেও সুস্থ থাকেননি। কাউকে সুস্থ থাকতে দেনওনি তিনি! অনবদ্য! 

পদ্মাবত! 

৯. ক্রিস্টোফ ওয়াল্টজ (দ্য ইনগ্লোরিয়াস বাস্টার্ডস)

উচ্চাকাঙ্খী, একই সাথে নিষ্ঠুর, পিশাচ এক নাজি অফিসার 'হ্যান্স ল্যান্ডা'র চরিত্রে ক্রিস্টোফ ওয়াল্টজ যে রক্ত হিম করা অভিনয় করেছিলেন এ সিনেমায়, তা অবিস্মরণীয়। কোল্ড ব্লাডেড এক ক্রিমিন্যাল, যে কিনা মারাত্মকভাবে নৈরাশ্যবাদীও, এরকম এক চরিত্র যেরকম অভিনয় প্রত্যাশা করে, তার পুরোটাই দিয়েছিলেন ক্রিস্টোফ ওয়াল্টজ। এই সিনেমা দেখার পরে 'হ্যান্স ল্যান্ডা' চরিত্রটির প্রতি ঘৃণার উদ্রেক হয়নি, এমন মানুষ বোধহয় খুঁজলে একটিও পাওয়া যাবে না।

দ্য ইনগ্লোরিয়াস বাস্টার্ডস! 

১০. কেভিন স্পেসি (সেভেন)

ডেভিড ফিঞ্চারের 'সেভেন' সিনেমার হিমশীতল চরিত্রের সেই সাইকোপ্যাথকে নিশ্চয়ই মনে আছে, যে অদ্ভুত এক আইডিওলজিতে সওয়ার হয়ে একের পর এক খুন করে চলেছিলো অসহায় মানুষকে। অনুভূতিহীন, পাথরের মতন নিরেট, ভোঁতা এক সিরিয়াল কিলার 'জন ডো' চরিত্রে যে অভিনয় করেছিলেন কেভিন স্পেসি, সে অভিনয় দেখে ভয়ে চমকে ওঠেনি, এমন মানু্ষ খুঁজতে গেলে বিস্তর গলদঘর্ম হতে হবে। চরিত্রটিকে ভাবাও হয়েছিলো এমন দারুণভাবে, এবং সেখানে কেভিন স্পেসি করেছিলেন এমন দুর্দান্ত অভিনয়, সিনেমাপ্রেমীদের কাছে এ চরিত্র ভিন্ন এক দ্যোতনাতেই থেকে গিয়েছে বরাবর।

সেভেন! 

দুই-আড়াই ঘন্টার সিনেমায় অল্প রানটাইমে এসেও এসব চরিত্রেরা ক্রমশ যেভাবে সঞ্চার করেছে শঙ্কা, কেড়ে নিয়েছে রাতের নিরাপদ ঘুম, তা বিবেচনায়, এই তুখোড় শিল্পীদের প্রতি কুর্নিশ না জানানো হবে তীব্র অন্যায়। আকাশকুসুম চরিত্রগুলোকে জীবন্ত করে পর্দায় নিয়ে আসার ঐশ্বরিক ক্ষমতাপ্রাপ্ত শিল্পীদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানিয়েই কলমের লাগাম টানলাম আজ এখানে। 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা