তামিলনাড়ুর এক বক্স-অফিস স্ট্যাটের তো এমনও দাবী- তামিল ইন্ডাস্ট্রিতে যত সিনেমা হয়েছে, তার সবগুলোর মধ্যে 'বিক্রম' নাকি আয়ের দিক থেকে শীর্ষস্থানে আছে! প্রশ্ন উঠতে পারে, যে ইন্ডাস্ট্রিতে 'অধিক তারকা থাকলেই সিনেমা হিট' ফর্মুলা সেভাবে কাজ করেনা, সে ইন্ডাস্ট্রিতেই 'বিক্রম' এর মত সিনেমা কিভাবে এমন হিট হয়? প্রশ্ন উঠতে পারে- 'বিক্রম' এ কি এমন আছে, যা এভাবে আকৃষ্ট করলো মানুষকে? 

টাইটেল পড়ে অনেকেই হয়তো খানিকটা হলেও হতচকিত হচ্ছেন। কেউ কেউ ভাবছেনও, কি এমন করলো 'বিক্রম', যাতে তামিল ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির গোড়া ধরেই টানাটানি শুরু হলো? 'বিক্রম' সিনেমা হিসেবে অনবদ্য, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু 'পাথ-ব্রেকিং মুভি'র মত কিই বা আছে এখানে... চাইলে এমন প্রশ্নও করতে পারেন কেউ কেউ। এবং, এ প্রশ্নগুলোর উত্তর দেয়ার জন্যেই এ লেখার অবতারণা। 

আমরা যারা বহুদিন ধরে তামিল সিনেমা অনুসরণ করছি, তারা একটা বিষয়ে নিশ্চিত প্রায় সবাই- সিনেমার ক্ষেত্রে, তামিল ইন্ডাস্ট্রি নির্দিষ্ট কোনো টিপিক্যাল পলিসি ফলো করে না। তাদের প্রায় পুরোটাই এক্সিকিউশনের খেলা। এখানের সিনেমায় আপনি পদার্থবিজ্ঞানকে বুড়ো আঙ্গুল দেখানো অ্যাকশন কোরিওগ্রাফি যেমন দেখবেন, মাথা ঘুরিয়ে দেয়া দুর্দান্ত গল্পও দেখবেন। সিনেম্যাটোগ্রাফীর চমৎকারিত্ব বা মাস-অরিয়েন্টেড মাসালা ফিল্মস এর মুন্সিয়ানা... পাবেন সেসবও। কিন্তু, তামিল সিনেমায় এতকিছু থাকলেও একটা জিনিস নেই, অথবা, থাকলেও আছে খুব কম। কি সেটা? সেটি হচ্ছে- একই সিনেমায় একাধিক তারকার উপস্থিতি। অর্থাৎ, সোজা বাংলায়- তামিলের সিনেমায় 'মাল্টি স্টারার কাস্ট' এর উপস্থিতি খুব বিরল। নেই বললেই চলে।

যদিও, ১৯৫৪ সালের 'কুনদুক্কিলি' সিনেমায় এমজিআর এবং শিভাজি গনেশান এর মত সুপারস্টারকে একসাথে দেখা গিয়েছিলো। আবার, কমল হাসান এবং রজনীকান্তও একাধিক সিনেমায় একসাথে অভিনয় করেছিলেন। কিন্তু, সেসব উদাহরণ বেশিদিনের না৷ বেশ কিছু সিনেমা একসাথে করার পরে কমল-রজনীকান্ত সিদ্ধান্ত নেন, যৌথভাবে আর তারা কোনো সিনেমা করবেন না। তাদের এই সিদ্ধান্তের পেছনে যুক্তি ছিলো- একসাথে সিনেমা করলে যে অ্যামাউন্টের রেমুনেরেশন তারা পান, সেটা আসলে তাদের 'সুপারস্টার' স্ট্যাটাসের সাথে খানিকটা ইনজাস্টিসই করে। সিনেমার ব্যবসাও খানিকটা কমে। সে কারণেই এই সিদ্ধান্ত। 

কমল হাসান ও রজনীকান্ত একসাথে করেছিলেন বেশকিছু সিনেমা! 

এই সিদ্ধান্তের পর থেকে তামিল ইন্ডাস্ট্রির একটা অঘোষিত নিয়মই হয়ে যায়, যা খুশি হোক, কিন্তু কোনো সিনেমায় মাল্টি-স্টারার কাস্ট করা যাবেনা। যদিও, এরপরেও, এই স্ট্রাকচারে, কালেভদ্রে বেশ কিছু সিনেমা এসেছে, তবে তা সংখ্যায় খুবই কম। আহামরি ব্যবসাও করেনি তারা। আল্টিমেটলি, এরপরে যা হয়েছে, 'তারায় তারায় সয়লাব' না করিয়ে এই ইন্ডাস্ট্রি ফোকাস লক করেছে সিনেমার উৎকর্ষে। এবং, ঠিক এ সমীকরণে এসেই লোকেশ কানাগরাজের 'বিক্রম' তুলেছে প্রশ্ন। বলেছে- গল্প যদি ঠিক থাকে, তাহলে সে গল্পে একাধিক তারকা নিলে সমস্যাও বা কোথায়? 

'বিক্রম' এর প্রায় তিনঘন্টার ক্যানভাসে কমল হাসান, বিজয় সেথুপতি ফাহাদ ফাসিল আর সুরিয়া এসে যেভাবে ছত্রখান করলো সব, যেভাবে ব্যবসা করলো বক্স-অফিসে, এবং, এখনও যেভাবে ব্যবসা করছে, তা রীতিমতো অভূতপূর্ব! একটা উদাহরণ দিই- সিনেমা মুক্তির দুই সপ্তাহ পরেও 'বিক্রম' এর এখনও এতটাই প্রতাপ, চেন্নাইয়ের কয়েকটা সিনেমাহলে রাত দেড়টা কিংবা আড়াইটাতেও শো রাখা হয়েছে। এরইমধ্যে, তিনশো কোটির বেশি আয়ও করে ফেলেছে সিনেমাটা৷ পাশাপাশি, 'অধিক সন্ন্যাসীতে গাঁজন নষ্ট' হওয়ার বিষয়টিকেও করেছে তীব্র কটাক্ষ। 

এই সিনেমার আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, শুধু যে তামিলনাড়ুতেই এই সিনেমা ভালো করেছে, তা না, পুরো ইন্ডিয়ান বেল্টেই দেখিয়েছে দাপট। পাশাপাশি, বিশ্বের অন্যান্য জায়গাতেও আছে ভালো অবস্থানে। তামিলনাড়ুর এক বক্স-অফিস স্ট্যাটের তো এমনও দাবী- তামিল ইন্ডাস্ট্রিতে যত সিনেমা হয়েছে, তার সবগুলোর মধ্যে 'বিক্রম' নাকি আয়ের দিক থেকে শীর্ষস্থানে আছে! প্রশ্ন উঠতে পারে, যে ইন্ডাস্ট্রিতে 'অধিক তারকা থাকলেই সিনেমা হিট' ফর্মুলা সেভাবে কাজ করেনা, সে ইন্ডাস্ট্রিতেই 'বিক্রম' এর মত সিনেমা কিভাবে এমন হিট হয়? প্রশ্ন উঠতে পারে- 'বিক্রম' এ কি এমন আছে, যা এভাবে আকৃষ্ট করলো মানুষকে? 

এসব প্রশ্নের উত্তরে যদিও অনেকের অনেক মত, তবে, মূলত এখানে, প্রধাণ কারণ একটাই। একটাই শব্দ- স্টোরি। গল্পের ন্যারেশনটাই এমন, এখানে বাঘা বাঘা তারকা থাকলেও, তাদের চেয়ে বেশি প্রাধান্য পেয়েছে গল্পই। অর্থাৎ, গল্পের প্রয়োজনেই তাদের আবির্ভাব, তাদের আবির্ভাবে গল্পের রূপান্তর না৷ হয়তো মোটাদাগে এ গল্পকে গড়পড়তা 'গুড ভার্সাস ব্যাড' গল্পই মনে হবে। ভিলেনের বিরুদ্ধে ভালো মানুষদের সংগ্রাম... এরকম ন্যারেশন তো আকছারই দেখি। কিন্তু, এরমধ্যেও কথা আছে। ভিলেন 'সন্ধানম'ই হোক কিংবা প্রোটাগনিস্ট 'বিক্রম', শেষে এসে 'রোলেক্স' এর ক্যামিও, এবং সেসবের সাথে গল্পের মিক্সচার... সিনেমায় কিছু কিছু জায়গা এতটাই ওয়েল এক্সিকিউটেড, এবং, তাও গল্পের প্রয়োজনে... ব্রিলিয়ান্ট। 

'বিক্রম' এ মুগ্ধ করলেন কমল হাসান 

লোকেশ কানাগরাজ 'মাস-অরিয়েন্ট' সিনেমা বানাতে সিদ্ধহস্ত, দর্শকের পালস তিনি খুব দারুণভাবে ধরতে পারেন, এসব ছাপিয়েও সবচেয়ে অবাক করার বিষয়- তিনি সিনেমার শুরু থেকে শেষতক গল্পের প্রয়োজনে ঠিকঠাকভাবে একের পর এক তারকাকে ব্যবহারও করতে পারেন! তিনিই পারেন- ফাহাদ ফাসিলের মত এরকম প্যান-ইন্ডিয়ান সুপারস্টারকে ক্লাইম্যাক্সে একেবারে নিষ্প্রভ রাখতে। সিনেমার শেষাংশে এসে, গল্পের প্রয়োজনেই ফাফা'কে যেভাবে রাখা হয় পাদপ্রদীপের বাইরে, এ সাহস কয়জন করবে? আবার, বিজয় সেথুপতি'র এন্ট্রি সিন থেকে পুরো সময়েই, যেরকম মূর্তিমান আতঙ্কে তিনি এ চরিত্রকে ডেভেলপ করেন, সেটাও চমক জাগায় ক্ষণেক্ষণে। লিজেন্ড 'কমল হাসান' এর কথা নাই-বা বলা হলো। এই বয়সেও তিনি যা করলেন, বা, তাকে দিয়ে যা করানো হলো, তা টনক নড়াবে অনেকেরই। পাশাপাশি, এ সিনেমার সাইডকিকেরাও এমন অনবদ্য, বিশেষ করে 'এজেন্ট টিনা' পাঁচ-সাত মিনিটের স্ক্রিন-টাইমেও যে পারফরম্যান্স করেছেন, তাতে সিনেমাহলে যদি সিটি না পড়ে, তাহলে তা অন্যায়ই হবে। 

অনবদ্য 'বিজয় সেথুপতি' 

সবকিছু মিলিয়েই, 'বিক্রম' প্রমাণ করছে, 'গল্প'কে প্রপার জায়গা দিলে, গল্পও সিনেমাকে পৌঁছে দেয় কাঙ্ক্ষিত স্থানে। পাশাপাশি, রিয়ালাইজেশন হয় এটাও- সব সিনেমারই 'প্যান ইন্ডিয়ান' টেমপ্লেট নিয়ে আসার দরকার নেই। সিনেমার গল্পকে লোকাল প্রাইড ও প্রেজুডিস এর মধ্যে রেখেই চাইলে এমন সিনেমা বানানো যায়, যা সবাইকে স্থানু করবে। লোকেশ কানাগরাজ এই ন্যারেটিভ বেশ ভালোভাবেই সেট করেছেন।

তবে, এখানে খানিকটা রিস্কও আছে। 'বিক্রম' এর সাফল্য দেখে অনেক ডিরেক্টরই হয়তো এরপরের সময়টাতে এরকম মাল্টি-স্টারার ফিল্ম বানাতে চাইবেন। এবং, সেরকমটা হলে, এই স্ট্রাকচার 'ক্লিশে' হতেও খুব বেশি সময় লাগবেনা। পাশাপাশি, সেসব সিনেমা গল্প-নির্ভর না হয়ে, অনেকটুকুই যদি হেলে পড়ে 'তারকা'র ফেসভ্যালুর উপরে, তাহলে আদতেই সে সিনেমা কতটুকু দূরত্ব অতিক্রম করবে, প্রশ্ন থেকে যাবে, তা নিয়েও। তাই, যদিও বলা, সাকসেসফুল 'মাল্টি স্টারার ফিল্ম' এর জন্যে 'বিক্রম' বেশ ভালো একটা কেস স্টাডি, কিন্তু, সে সাথে এই সতর্কতাও জানিয়ে রাখা ভালো- শুধুমাত্র তারকাকে আনলেই হবেনা। সে তারকাকে ঠিকঠাক ব্যবহার করার ক্ষমতাও রাখতে হবে। নাহয়, পুরোটাই হবে অপচয়। অথবা, কেচে গণ্ডূষ।


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা