'ললিতা' থেকে 'সিল্ক স্মিতা'- সব চরিত্রেই যিনি অনন্যসাধারণ!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
এই দশকেই সেরা অভিনেত্রী হিসেবে চারটা ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড জিতেছেন তিনি, এমন অতিমানবীয় কীর্তি নেই আর কোন অভিনেত্রীর। সমাজবিজ্ঞানে পড়াশোনা করা মেয়েটা যে একদিন বলিউডের 'বিগ বি' হয়ে উঠবেন, সেটা কেউ ভাবেনি কখনও...
শরৎ বাবুর 'ললিতা' থেকে 'সিল্ক স্মিতা', সব চরিত্রেই তিনি দর্শকদের মুগ্ধ করেন। বলিউডের নারীকেন্দ্রিক সিনেমার ইতিহাসে নতুন 'কাহানী' সৃষ্টি করেছিলেন। 'পিউ বোলে' গান গেয়ে যেমন রোমান্টিকতা ছড়ান, তেমন 'উ লা লা' গেয়ে উন্মাদনাও বাড়ান। নায়িকাদের প্রচলিত ধারা ভেঙ্গে প্রতিষ্ঠিত এই তারকা বলিউডে 'ফিমেল হিরো' খ্যাত অন্যতম জনপ্রিয় অভিনেত্রী বিদ্যা বালান।
অনেক বাঁধা বিপত্তি পেরিয়ে ২০০৩ সালে গৌতম হালদারের বাংলা সিনেমা 'ভালো থেকো'র মাধ্যমে প্রথমবারের মতো চলচ্চিত্রের পর্দায় আসেন। মুক্তি পাবার পর বেশ প্রশংসাও জুটেছিল, অর্জন করে নিয়েছিলেন আনন্দলোক পুরস্কার। তারপর একের পর এক সিনেমা থেকে বাদ পড়ার পর বেশ সংখ্যক বিজ্ঞাপন ও মিউজিক ভিডিওতে অভিনয় করেন, যেগুলোর নির্মাতা ছিলেন প্রদীপ সরকার। সেই সুবাদেই বলিউডে আগমন, বিধু বিনোদ চোপড়ার প্রযোজনা সংস্থায় প্রদীপ সরকারের ছবি 'পরিনীতা' দিয়ে বলিউডে অভিষেক বিদ্যা বালানের। প্রথমেই সুযোগ পেয়েছিলেন শরৎ সাহিত্যের জনপ্রিয় চরিত্র 'ললিতা' দিয়ে, সুযোগটাও কাজে লাগিয়েছিলেন তিনি। ছবিটির আহামরি সাফল্য না এলেও বেশ প্রশংসিত জুটেছিল, বিদ্যা নিজেও পান প্রশংসা।
এরপর একে একে লাগো রাহো মুন্নাভাই, ভুল ভুলাইয়া, হেই বেবি, গুরুর মতো বাণিজ্যিক সফল ছবির অভিনেত্রী হয়েছিলেন, অন্যদিকে সালাম ই ইশক, একলব্য, হাল্লা বোল, কিসমত কানেকশন পেয়েছিল ফ্লপের তকমা। ২০০৯ সালে আর বালকির 'পা' সিনেমায় একজন সিঙ্গেল মাদারের ভূমিকায় অভিনয় করে ব্যাপক প্রশংসা পান, ছবিটিও পায় বাণিজ্যিক সফলতা। সেরা অভিনেত্রী হিসেবে প্রথমবারের মত অর্জন করে নেন ফিল্মফেয়ার।
২০১০ সালে মুক্তি পায় ব্ল্যাক কমেডি 'ইশকিয়া', বানিজ্যিক দৃষ্টিতে এই সিনেমাটি পেয়েছে সেমিহিটের তকমা। তবে এই সিনেমা দর্শক থেকে সমালোচক সবার কাছেই বিশেষ হয়ে আছে বিদ্যার অভিনয়। সমালোচকদের বিচারে ফিল্মফেয়ারের সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার জিতেন, অনেকের মতে দুইটি বিভাগেই বিদ্যা বালান পুরস্কার পেতে পারতেন।
২০১১ সাল, ক্যারিয়ারের সবচেয়ে সুবর্ণ বছর। 'নো ওয়ান কিলড জেসিকা', বাস্তব ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত এই সিনেমায় জেসিকার বড় বোনের চরিত্রে অভিনয় করে নিজেকে আরেক ধাপ এগিয়ে নেন। মুক্তির পর একের পর এক প্রশংসার ফুলঝুরি পড়েছিল বিদ্যার অভিনয়ে।
এরপর এলো সে মাহেন্দ্রক্ষণ, বিতর্কিত নায়িকা সিল্ক স্মিতার জীবনী নির্ভর ছবি 'দ্য ডার্টি পিকচার'। মহরতের দিন থেকেই এই ছবিটি ছিল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে, মুক্তির পর সমালোচনার মুখে পড়লেও, বাণিজ্যিক সফলতায় ছিল সেই বছরের অন্যতম সফল ছবি। অশ্লীলতার জন্য অনেকে সমালোচনা করলেও একবাক্যে সবাই মেনে নিয়েছিলেন সিল্ক স্মিতা রুপী বিদ্যা বালানের অমূল্য অভিনয়।
এই চরিত্রের জন্য নিজেকে ভিন্নভাবে গড়ে তুলেছিলেন বিদ্যা বালান। এই সিনেমার সাফল্যে তার জনপ্রিয়তা বেড়ে যায় বহুগুণ, বছরের শীর্ষ অভিনেত্রী হিসেবে জায়গা করে নেন। পুরস্কারের মঞ্চেও ছিল একক আধিপত্য, ফিল্মফেয়ার তো বটেই প্রথমবারের মতো অর্জন করে নেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। বিখ্যাত অভিনেত্রী শাবানা আজমী বলেছিলেন, 'ডার্টি পিকচার মুক্তি যদি না পেত, তাহলে নো ওয়ান কিলড জেসিকার জন্য বিদ্যাই সেরা অভিনেত্রী হতো'।
২০১২ সালে সিল্ক স্মিতার রেশ কাটার আগেই সুজয় ঘোষের দুর্দান্ত থ্রিল 'কাহানী' তে সম্পূর্ন ভিন্নরুপে আবির্ভূত হয়ে সবাইকে চমকে দিয়েছিলেন। সিল্ক স্মিতা থেকে বিদ্যা বাগচীর যে উন্মোচন এটা বিস্ময়কর হবার মতোই। কাহানীর মুক্তির পরপর আগের বছরের জাতীয় পুরস্কার নিতে দিল্লি গিয়েছিলেন বিদ্যা, তখন এক দর্শক ভক্ত বলেছিলেন কাহানীর জন্য একেবারেই এই বছরের জাতীয় পুরস্কার দিয়ে দেয়া হউক। অবশ্য মনোনীত হয়েও পরের বছর আর জাতীয় পুরস্কারে ভাগ্য সহায় হয়নি। সমালোচক থেকে বক্স অফিস দুইয়েই প্রচুর সাড়া ফেলেছিল। অভিনেত্রী হিসেবে পরপর চারবার ফিল্মফেয়ার পেয়ে অনন্য রেকর্ড করেন।
বলিউডে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার পর যেভাবে ক্যারিয়ার চলার কথা ছিল, সেভাবে আর চলেনি। ছবি করেছেন ঠিকই, তবে সাড়া ফেলেনি। প্রথম ধাক্কাটা পান 'ঘনচক্কর' দিয়ে, প্রশংসা পেলেও ফ্লপ হয়। শাদি কি সাইড ইফেক্টসের ব্যর্থতার পর নারী গোয়েন্দা ববি জাসুস করেও বিশেষ কিছু লাভ হয় নি। মুক্তির আগে গান হিট, অনেকেই ভেবেছিলেন হামারি আধুরি কাহানি দিয়ে অমানিশা কাটবে, কিন্তু বিধিবাম- এটাও ফ্লপ হল। কাহানীর সিরিজের দ্বিতীয় কিস্তিও তাকে প্রত্যাবর্তন করতে পারেনি, প্রশংসাও খুব বেশি আসেনি।
২০১৭ সালটা ছিল বিদ্যার ফিরে আসার বছর। বছরের শুরুতে মুক্তি পাওয়া কলকাতার রাজকাহিনীর রিমেক 'বেগমজান' দিয়ে সেভাবে সাফল্য না আসলেও, হতাশ করেনি। আর বছরের শেষে 'তুমহারি সুলু' খুব বড় বাণিজ্যিক সফলতা না আসলেও সবাই প্রশংসা করেছেন, বেশ জনপ্রিয়ও হয়েছে ছবিটি। পাঁচ বছরের বিরতি দিয়ে আবার পুররুদ্ধার করেন ফিল্মফেয়ারের সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার। আবারো মনোনীত হলেও জাতীয় পুরস্কার অধরা থেকে যায়।
২০১৯ সালে এসে পেলেন অভিনয় জীবনে অন্যতম সেরা সফল সিনেমা 'মিশন মঙ্গল'। সিনেমাটি নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া হলেও বিদ্যা বালানের অভিনয়ে সবাই মুগ্ধ হয়েছে। অক্ষয় কুমার আছেন, পাঁচজন নায়িকা আছেন তবুও মধ্যবয়সী মায়ের চরিত্রে সবচেয়ে সমুজ্জ্বল বিদ্যাই। গনিতবিদ শকুন্তলার বায়োপিকে অভিনয় করছেন বিদ্যা বালান, ছবি প্রশংসিত না হলেও বিদ্যার অভিনয়ের জয়গান গেয়েছেন সবাই।
দর্শকপ্রিয়তা থেকে পুরস্কারে আবার পূর্ণ হবে ক্যারিয়ার এমনটা আশা করাই যায়। প্রত্যাশা রইলো, বিদ্যার এই প্রত্যাবর্তনের ধারা যেন ধরে রাখতে পারেন। ক্যারিয়ারের জয়রথের জন্য বড় তারকার বাহুলগ্না হতে হয়নি, কথাবার্তাতেও বেশ সচেতন এবং প্রতিবাদী।
সমাজবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর করা এই অভিনেত্রী অভিনয় জগতে এসেছেন শাবানা আজমী ও মাধুরী দীক্ষিত থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে। ব্যক্তিজীবনে বিয়ে করেছেন স্বনামধন্য প্রযোজক সিদ্ধার্থ রায় কাপুরকে, নিজেকে যুক্ত করেছেন নানান সমাজসেবায়।
শুভকামনা, বিদ্যা বালান...