চরকি'র 'ঊনলৌকিক' অ্যান্থোলজি সিরিজ টানা তিন পর্ব ধরে যেভাবে মান ধরে রেখেছে এবং ক্রমশই ছাড়িয়ে যাচ্ছে নিজেরই করা বেঞ্চমার্ক, তা অনবদ্য। একটাই আফসোস, মাত্র পাঁচ পর্বেই শেষ হয়ে যাচ্ছে এই সিরিজ। তবে এটাও ঠিক, ভালো জিনিস অল্পই হয়। ভালো জিনিস অল্প হওয়াই ভালো...
একবার এক মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে এলেন এক মহিলা। এসেই বেশ হন্তদন্ত হয়ে ডাক্তারকে বললেন- ডাক্তার সাহেব আমার সাথে একটু চেম্বারের বাইরে আসুন৷ আমার স্বামী সেখানে বসে আছে৷ সে কিছুতেই ভেতরে আসতে চাইছে না। ডাক্তার একটু বিরক্তই হলেন। কাজের সময় এখন। এসময়ে এসব উৎপাত কারই বা ভালো লাগে! তিনি একটু কড়াভাবেই সেই মহিলাকে জিজ্ঞেস করলেন- "তা, সমস্যা কার? আপনার? না আপনার স্বামীর?" মহিলা বললেন- "সমস্যা আমার স্বামীর। সে ভাবে, সে একটি সীল মাছ। আমি এতবার তাকে বলেছি, বুঝিয়েছি, কাজ হচ্ছেনা।
ডাক্তার বুঝলেন, ইন্টারেস্টিং একটা কেস পেতে যাচ্ছেন তিনি। মহিলাকে সাথে নিয়ে তিনি চেম্বারের বাইরে এলেন। বাইরে এসে দেখলেন- ভিজিটিং চেয়ারে বসে আছে একটি জ্যান্ত সীল মাছ!
খানিকটা প্রহেলিকা দিয়ে লেখা শুরুর লোভ সংবরণ করতে পারলাম না। অবশ্য যে গল্প নিয়ে লিখছি- সে গল্পের নামেও প্রহেলিকা আছে। গল্পের নাম- মিসেস প্রহেলিকা। খুবই আদ্যিকালের এক মনোরোগের ডাক্তার, যিনি এখনও নোকিয়ার সেই প্রস্তরযুগের মোবাইল ব্যবহার করেন, যার ঘরের সুইচবোর্ডে এখনও নব্বইয়ের দশকের ঘ্রাণ পাওয়া যায়, যিনি এখনও কথাবার্তা রেকর্ড করেন ফিতের ক্যাসেট এবং 'প্রাগৈতিহাসিক' খেতাব পাওয়া ক্যাসেট প্লেয়ারে, যার চোখের চশমা, গায়ের পোশাক সবখানেই বিগত যুগের আভাস...এরকম একজন ডাক্তারের কাছে একদিন এক রহস্যময় নারী আসেন। সিরিয়ালের শেষ পেশেন্ট। তিনি এসে ডাক্তারকে জানান, অনেকদিন তিনি স্বপ্ন দেখেন না। পরবর্তীতে তিনি জানান, তিনি গত দুই বছর ধরে ঘুমোন না, তাই তিনি স্বপ্ন দেখেন না। এরপরেই তিনি জানান, তিনি আসলে ঘুমের মধ্যেই আছেন৷ গত বহুদিন ধরে। এই ডাক্তার, এই ডাক্তারের চেম্বার, এই কথোপকথন... সবই তার ঘুমের অন্তর্ভুক্ত।
প্রহেলিকা মনে হচ্ছে? হওয়াটাই স্বাভাবিক। গল্পের নামের সাথে সুবিচার করেই গল্প শুরু হয় জমাটি-আঁধার কথোপকথন দিয়ে। পুরো নির্মাণ জুড়ে ডাক্তার (চঞ্চল চৌধুরী) এবং রোগী (নুসরাত ইমরোজ তিশা)'র কথোপকথনেই এগোয় পুরো গল্প। সাধারণত দুইজন কুশীলব দিয়ে পুরো গল্প টেনে নিতে গেলে, স্ক্রিপ্ট খুব শক্তিশালী হতে হয়। নাহয় গল্প ঝুলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে খুব বেশি। এ গল্পের শক্তির দিক, গল্পের স্ক্রিপ্ট। দুইজনের কথোপকথন অনেকটা সঞ্জীব চৌধুরীর গানের সেই লাইনের মতন; ভাঁজ খোলো, আনন্দ দেখাও। যেখানে কথোপকথনের নানা ভাঁজে ক্রমশই বেরিয়ে আসে গল্প, রোমাঞ্চ, বিস্ময়।
এক্ষেত্রে পরিচালক রবিউল আলম রবি আলাদা একটা ধন্যবাদ পাবেন। তিনি জানতেন, এই অসাধারণ স্ক্রিপ্টের সুবিচার করার জন্যে, এই স্ক্রিপ্টকে পর্দায় প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে পর্দায় দুইজন গুণী শিল্পী লাগবে, নাহয় ঠিকঠাক এক্সিকিউশনের অভাবে পুরো গল্পই মাঠে মারা যাবে, তিনি তাই বেছে নিলেন চঞ্চল এবং তিশা কে। এই দুইজন শিল্পীর শক্তি, সাবলীলতা এবং দক্ষতা নিয়ে কারো কোনো প্রশ্ন নেই, থাকা উচিতও না৷ তারা অভিনয়ও করলেন দারুণ। বুঝিয়ে দিলেন, কেন তারা এত প্রাসঙ্গিক।
সেট ডিজাইনও হয়েছে চমৎকার। কিছু আদিম অনুষঙ্গের কথা আগেই বললাম। সে সাথে চেম্বারের জানালার কাঁচের মধ্য দিয়ে গলে আসা বজ্রপাতের আলো, আদ্যিকালের ঘড়ি, টবের গাছ, একগাদা ইতস্তত বই, পুরোনো চেয়ার টেবিল, সাদা-কালো ছবি...সব মিলিয়ে ডাক্তারের চেম্বারও যেন খানিকটা প্রহেলিকা তৈরী করে। প্রোডাকশন ডিজাইনার সৈয়দ আহমেদ শাওকী গল্পের থিম মাথায় রেখে পুরো সেট সাজানোর যে কাজটি করেছেন, তা চমৎকার। 'দেবী' সিনেমা নিয়ে সামান্য ইঙ্গিতপূর্ণ কথাবার্তা দিয়ে 'মিসির আলী'র সাথে চঞ্চল চৌধুরীর খানিকটা সাটল কানেকশন, বিশেষ বিশেষ সময়ে টিকটিকির 'ঠিক ঠিক' বলে ডেকে ওঠা এবং পরিনতির বিশেষ চমক...সবমিলিয়ে এ গল্প এবং নির্মাণ তৃপ্তি দেবে, ভাবনার খোরাকও যোগাবে।
চরকি'র 'ঊনলৌকিক' অ্যান্থোলজি সিরিজ টানা তিন পর্ব ধরে যেভাবে মান ধরে রেখেছে এবং ক্রমশই ছাড়িয়ে যাচ্ছে নিজেরই করা বেঞ্চমার্ক, তা অনবদ্য। একটাই আফসোস, মাত্র পাঁচ পর্বেই শেষ হয়ে যাচ্ছে এই সিরিজ। তবে এটাও ঠিক, ভালো জিনিস অল্পই হয়। ভালো জিনিস অল্প হওয়াই ভালো।