'মৃধা বনাম মৃধা'র সেই খ্যাপাটে বাবা, 'সাদা প্রাইভেট' এর মধ্যবিত্ত বটবৃক্ষ কিংবা 'দৌড়' এর ডিবি অফিসার হায়দার.. চরিত্রের ডাইমেনশন বুঝে এই বয়সে এসেও যে অভিনয় উপহার দেন তারিক আনাম খান, তাতে ক্ষণেক্ষণে বিস্মিত হই। মুগ্ধতা বাড়ে, বাড়ে চমকও।

শাহরুখ খান অনেক সাক্ষাৎকারেই একটা কথা বলতেন- 

আমার আসলে কোনো আকৃতি নেই। আমার ভেতরে কোনো রঙও নেই। ডিরেক্টর যখন যে আকৃতি আর যে রঙ দেন, আমি সেভাবেই রূপান্তরিত হই।

যেকোনো গুণী অভিনয়শিল্পীর ক্ষেত্রেই কথাটা সত্যি। যেমনটা সত্যি, এদেশের সংস্কৃতিক্ষেত্রের অন্যতম মহীরূহ তারিক আনাম খানের ক্ষেত্রেও। আগের অভিনয় নাহয় বাদই দিলাম, এই বয়সে এসেও যেরকম অভিনয় তিনি করে যাচ্ছেন, তাতে মুগ্ধতা তো কমছেনা মোটেও, বরং, দিনদিনই যেন নতুন আকৃতি আর রঙে হাজির হচ্ছেন তিনি। এই মুহুর্তে যেমন তার সাম্প্রতিক তিনটি কাজের কথা মনে পড়ছে, যেগুলো দেখে চোখ সরাতে পারিনি মোটেও। সেসব নিয়েই কিছু কথা বলি।

শুরু করি, 'মৃধা বনাম মৃধা' সিনেমা দিয়ে৷ সত্যি বলতে, বাংলাদেশের রিসেন্ট পাস্টে এরকম ছিমছাম ফ্যামিলি ড্রামা দেখেছি খুব কম। এ সিনেমার গল্প, স্ক্রিপ্ট, ডায়লগ... তিনটি জায়গাই সুন্দর,  বিস্ময়কর। এবং, এই তিনটি বিভাগেই কাজ করেছিলেন রায়হান খান নামের একজন, যার কথা একটু পরেই আসবে আবার। যাই হোক, এই সিনেমায় আরেকটি বিষয়ও ছিলো খুব অসাধারণ। সেটি 'তারিক আনাম খান' এর অভিনয়! সিয়াম আহমেদের 'বাবা'র চরিত্রে যে অভিনয়টা তিনি করলেন, রীতিমতো আবেগতাড়িতই হয়ে পড়লাম কিছু দৃশ্যে। হয় কি, যখন একটা চরিত্রের সুখ-দুঃখের সাথে আপনি নিজেকে বা আপনার আশেপাশের কাউকে রিলেট করতে পারেন, তখন সে চরিত্রটি আলাদাভাবেই দাগ কেটে যায় ভেতরে। যেটা হয় 'আশরাফ মৃধা'রূপী তারিক আনাম খানের ক্ষেত্রে। এ চরিত্রের মধ্যে ফান, সাসপেন্স কিংবা ট্রাজিক এলিমেন্টস এত দারুণভাবেই উপস্থিত থাকে, মুগ্ধ হতেই হয় যেন।

Caption

দ্বিতীয় যে নাটকে তারিক আনাম খানের অভিনয় দেখে মুগ্ধ হলাম, সে নাটকের নাম 'সাদা প্রাইভেট।' এ নাটকে 'বজলুল সাহেব' চরিত্রে মধ্যবিত্ত এক পরিবারের বটবৃক্ষ হিসেবে যে অভিনয় তার থেকে প্রত্যাশিত ছিলো, তিনি করলেন সেরকমই অভিনয়৷ মাপা অভিনয়। একটা গাড়ি পাওয়া উপলক্ষ্যে তার চাপা উল্লাস, আবার সে গাড়ি না পাওয়া-জনিত আক্ষেপ, সেসব কিছু তিনি এমনভাবেই ফুটিয়ে তুললেন চরিত্রে, পোড় খাওয়া অভিনেতা ছাড়া যা যে কারো পক্ষেই অসম্ভব৷ বেশ সন্তুষ্টিই তিনি দিলেন।

বজলুল সাহেব

তৃতীয় কাজটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তারিক আনাম খানকে এর আগে এরকম চরিত্রে দেখিওনি আর৷ চরিত্রটি এক ডিবি অফিসারের। যে অফিসারের নাম হায়দার। হায়দার আদর্শ পুলিশ অফিসার, ঘুষ-অন্যায়-দুর্নীতি যাকে স্পর্শ করতে পারেনা, যিনি প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে বরাবরই দাঁড়ান অনমনীয় দৃঢ়তায়... এরকম টাফ ইনভেস্টিগেটিং অফিসার বাংলাদেশি কন্টেন্টে খুব বেশি দেখেছি বলে মনে পড়েনা। স্ট্রিমিং সাইট 'হইচই' এর ওয়েব সিরিজ 'দৌড়' এর বদৌলতে এরকম এক চরিত্র পেলাম, এবং, যে চরিত্রে অভিনয় করলেন তারিক আনাম খান৷ তার রানটাইমের কোনো অংশে তিনি একবিন্দুও হাসলেন না। সাদা হাফ শার্ট আর গোমড়ামুখো অফিসার হায়দার মুগ্ধ করলেন ক্রমশই। বিশেষ করে চোখে লেগে রইলো শিষ্য মোশাররফ করিমের সাথে তার মুখোমুখি দ্বৈরথের দৃশ্যগুলো। একজন খিটখিটে, অস্থিতিশীল মানু্ষের বিপরীতে একজন শীতল চাহনির ধীরস্থির মানুষ... জমে যেতে বিশেষ কিছু তাই আর লাগলোনা! 'দৌড়' দেখে যতটা ভালো লাগলো, তার অনেকটুকুতেই তাই রয়ে গেলেন ডিবি অফিসার হায়দার। এবং, এই 'দৌড়' এর নির্মাতা হিসেবে রইলেন সে মানুষটিই, যে মানুষটি ছিলেন 'মৃধা বনাম মৃধা'র স্টোরি, স্ক্রিপ্ট ও ডায়লগেও; অর্থাৎ, রায়হান খান। 

ডিবি অফিসার হায়দার

এই যে তিনটি চরিত্র- 'মৃধা বনাম মৃধা'র বাবা, 'সাদা প্রাইভেট' এর মধ্যবিত্ত পরিবারের ভরকেন্দ্র কিংবা 'দৌড়' এর 'নো ননসেন্স' ডিবি অফিসার হায়দার... এই তিনটি রোলেই আলাদা আলাদাভাবে প্রকাশিত হলেন তারিক আনাম খান৷ বোঝালেন, একজন অভিনেতার কোনো আকৃতি হয় না, হয়না কোনো রঙ। নির্মাণভেদে পাল্টে যায় সব৷

বাংলাদেশের সংস্কৃতিক্ষেত্রের বেশ বড়সড় অধ্যায় যে মানুষটি, সে তারিক আনাম খানের জন্মদিন গেলো দু'দিন আগে। এই বর্ষীয়ান গুণী অভিনেতাকে জানাই শুভ জন্মদিন। আরো বহুদিন বেঁচে থাকুন তিনি, দুর্দান্ত কাজ করুন... এই প্রার্থনাই করি৷


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা