তাকদীর দেখিয়ে দিয়েছে, ভালো মানের বাংলা কন্টেন্ট আমরা লুফে নেই!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
চঞ্চল চৌধুরী মানেই বাংলাদেশি কন্টেন্টের নবজাগরণ, সেটা সিনেমা হোক কিংবা ওটিটি। চঞ্চল চৌধুরী সবসময় হাত ধরে দেখিয়ে দিয়েছেন যে এরকম গল্প, এরকম চরিত্র নিয়েও বাংলা কন্টেন্ট হয় যেগুলো আমরা দেখে-দেখিয়ে গর্ব করতে পারবো। তাকদীর ঠিক সেরকমই একটা কাজ। যদিও অরিজিনাল কন্টেন্ট হিসেবে প্রোডিউস করেছে ইন্ডিয়ার ওটিটি হইচই, তবুও ওটিটিতে বাংলা কন্টেন্ট যে আসলেই তাক লাগিয়ে দিতে পারে সেটির সূচনা হয়তো তকদীরের হাত ধরেই হলো।
আমাদের দেশে ওটিটির জন্য বড় একটা স্পেস ইতিমধ্যে তৈরি হয়ে গেছে। আমাদের দর্শক যারা ওয়ার্ল্ড সিনেমা, সিরিজের সাথে এখন সুপরিচিত তাদের সংখ্যাটা নেহাত কম না। আমাদের দেশে যে ওটিটির মার্কেট ধরার চেষ্টা হয় নি এমন না, কিন্তু আমরা বেশিরভাগ সময় গুছিয়ে কাজ করতে পারি না। এক্ষেত্রেও সেটির ব্যতয় হয় নি। আমরা ঠিকই বুঝতে পেরেছি চাহিদা, কিন্তু সে অনুযায়ী ডেলিভার করতে পারি নি। নেটফ্লিক্স বুম করলো আমাদের দেশে দু-তিন বছরের বেশি হবে না। এরপর একে একে অ্যামাজন, হইচই, ডিজনি প্লাস ইত্যাদির সাবস্ক্রিপশন আছে এমন দর্শকও দেশে এখন আর কম নেই। অনেক অনেক ফেসবুক পেইজ এখন সাবস্ক্রিপশন সার্ভিস দিচ্ছে, দারাজ-পিকাবুতে পাওয়া যাচ্ছে সাবস্ক্রিপশন কার্ড।
এই মার্কেট এনালাইসিস করে আমরা কী করেছি? গণ্ডায় গণ্ডায় ওটিটি নিয়ে এসেছি। আর এতো ওটিটি আনার কারণে কী হয়েছে, কন্টেন্টের মান পড়ে গেছে। কিছু ভালো কাজ যে হয় নি তা নয়। কিন্তু সেগুলোও প্রচার করতে পারে নি কেউ প্রপারলি। আমাদের এই দুর্বলতার সুযোগে বাংলাদেশের কারেন্সিতে সাবস্ক্রিপশন সেবা নিয়ে এসেছে হইচই, ইরোস, জি ফাইভের মতো ইন্ডিয়ার মিড লেভেলের ওটিটিগুলো। কলকাতার বাংলা কন্টেন্ট ও হিন্দি কন্টেন্ট থাকার কারণে খুব সহজেই আশানুরূপ সাবস্ক্রাইবারও পেয়ে গেছে তারা। এখন হইচই যে কাজটা করেছে সুযোগ বুঝে- আমাদের ওটিটিগুলোকে কাঁচকলা দেখিয়ে একঝাঁক প্রতিভাবান অ্যাক্টর-ডিরেক্টরদের নিয়ে গেছে বাংলা কন্টেন্ট তৈরির জন্য। এগুলো শুধুমাত্র বাংলাদেশের দর্শকদের টার্গেট করেই বানানো আসলে। তবে প্লাস পয়েন্ট হল হইচই এগুলো ডাব করছে হিন্দি ভাষাভাষীদের জন্যও। আমাদের কন্টেন্ট আস্তে আস্তে গ্লোবাল হওয়ার শুরুটা ইন্ডিয়া থেকেই হোক। সবকিছুই প্রস্তুত ছিল, শুধু অপেক্ষা ছিল তাকদীরের ভালো হবার। কেমন হলো তাকদীর?
তাকদীরের গল্পটা এক লাশবাহী ফ্রিজার গাড়ির ড্রাইভার তাকদীরকে ঘিরে। হুট করে সে একদিন তার গাড়িতে আবিষ্কার করে একটি অপরিচিত লাশ। কী করবে ভেবে না পেয়ে অস্থির হয়ে যায় তাকদীর, সঙ্গী মন্টুকে নিয়ে বিপদ থেকে উদ্ধার পাবার পথ খোঁজে। এরই মাঝে ফোনে অজানা কারও কাছ থেকে নির্দেশ পায় লাশ নিয়ে মুন্সিগঞ্জ আসার। টিভিসেটে দেখে লাশের চেহারার সাথে নিখোঁজ হওয়া দুঁদে সাংবাদিক আফসানার চেহারার হুবুহু মিল। তাকদীর টের পায় চোরাবালিতে আটকা পড়েছে সে, যতই বের হতে চায় আরও গভীরে প্রবেশ করছে।
তাকদীরের গল্পটা পুরোপুরি নতুন না আবার পুরোপুরি ক্লিশেডও নয়। ন্যারেশনের ক্ষেত্রে ডিরেক্টর পরতে পরতে গল্পের ভাঁজ খুলেছেন, একেবারে সবকিছু দেখাতে চান নি। তবুও মাঝামাঝি এসে মনে হচ্ছিল আরেকটু বিস্তৃত করতে পারতেন বা আরও একটু ইনফরমেশন দিতে পারতেন দর্শকদের। দর্শক হিসেবে আমাদের অবস্থাও তাকদীর আর মন্টুর চেয়ে ভিন্ন কিছু ছিল না, তাদের সাথে সাথে আমরাও ইনফরমেশন পাচ্ছিলাম, কিন্তু পাজল মেলানো যাচ্ছিল না। শেষে এসে এ কারণেই একটু তাড়াহুড়ো লেগেছে, তবে পুরো আভাসই আছে যে সেকেন্ড সিজন পাওয়া যাবে তাকদীরের। তা নাহলে অপূর্ণ থেকে যাবে গল্প। গল্পের এই দুর্বলতাটুকু ঢেকে দিয়েছে অভিনেতাদের অসাধারণ অভিনয়।
চঞ্চল চৌধুরী বরাবরের মতো দারুণ কাজ করেছেন। চঞ্চল যেন তাকদীরই হয়ে উঠেছিলেন, তবে শুরুতে তকদীরের চরিত্রের যে কমপ্লেক্সিটিগুলো ছিল সেগুলো পরে গিয়ে একঘেয়ে হয়ে গেছে এবং মনে হয়েছে ক্যারেক্টার রাইটিংটা তকদীরের জন্য আরেকটু ভালো হতে পারতো মেইন লিড হিসেবে। সানজিদা প্রীতি অল্প সময় ছিলেন কিন্তু ইফেক্টিভ ছিলেন। মনোজ কুমার ভালো অভিনেতা, ভালো কাজ করেছেন তবে এই ক্যারেক্টারেও আরেকটু বৈচিত্র্য থাকতে পারতো। ইন্তেখাব দিনার, পার্থ বড়ুয়া অল্প স্ক্রিন টাইমেই দাপিয়ে বেড়িয়েছেন। পার্থ বড়ুয়ার ক্যারেক্টারটার রাইটিং অবশ্য হতাশাজনক।
তবে এই সিরিজের সবচেয়ে ওয়েল রিটেন আর ওয়েল এক্টেড ক্যারেক্টার হল মন্টু। মন্টু শুধু এই সিরিজের কেন রিসেন্ট টাইমের যেকোনো বাংলা কন্টেন্ট (সিনেমা, সিরিজ যাই হোক) থেকে পাওয়া সেরা চরিত্র। সোহেল রানা যে অসাধারণ কাজ করেছেন এই চরিত্রে, আর এই চরিত্র যে অসাধারণভাবে লেখা হয়েছে সেটা এই সিরিজ না দেখলে আসলে টের পাওয়া যাবে না। তাকদীর এই সিরিজের নামচরিত্র হলেও মাঝপথ থেকে শেষ পর্যন্ত এই সিরিজকে মন্টুই টেনেছে। কখনো কখনো তাকদীরকেও ওভারশ্যাডো করে ফেলেছে মন্টু। এই সিরিজ মনে দাগ না কাটলেও, মন্টু দর্শকের মনে দাগ কাটবে নিশ্চিতভাবেই।
নির্দেশনায় শওকি সৈয়দের কাজ প্রশংসাযোগ্য। প্রজন্ম টকিজ থেকেই শওকি মুগ্ধ করে চলেছেন। এরকম বড় পরিসরের কাজ পাওয়ার যোগ্য দাবীদার ছিলেন তিনি এবং দেখিয়েও দিলেন যে তিনি বর্তমান সময়ের অন্যতম প্রতিভাবান নির্মাতা। যেভাবে তিনি লোকেশনগুলো দেখিয়েছেন, বরফকল-আড়ত ঘুরিয়েছেন সেগুলো ঘটনাগুলোকে কন্টেক্সট অনুযায়ী মানানসই করেছে, একটা বিলিভেবিলিটি দিয়েছে। এই কাজটা অনেকেই করতে চান না। আরও দারুণ দারুণ কাজ এই গুণী নির্মাতার কাছ থেকে আশা করছি ভবিষ্যতে।
সব মিলিয়ে তাকদীর দেখিয়ে দিয়ে গেল চোখে আঙুল দিয়ে যে কীভাবে ভালো মানের বাংলা কন্টেন্ট আসলে আমরা লুফে নেই। কীভাবে ভালো গল্প, ভালো অভিনয়ের প্রশংসা করতে আমরা দ্বিধাবোধ করি না। শুধু প্রয়োজন ইনভেস্টমেন্ট, প্রয়োজন দেশীয় ওটিটির নবজাগরণ, প্রয়োজন প্রতিভাবানদের পেছনে অর্থ খরচ করা। আর সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সে কন্টেন্টকে প্রপারলি মার্কেটিং করা ও পৌঁছে দেয়া বিনোদনপ্রিয় মানুষের কাছে। তাহলেই আমরা আরও ভালো ভালো কাজ দেখতে পারবো, ভালো ভালো কাজ নিয়ে প্রশংসা করতে পারবো। দেখিয়ে দিতে পারবো বাংলা কন্টেন্টও কোন অংশে কম না।