রায়হান রাফির নির্মাণের যে টোন, অর্থাৎ- ভায়োলেন্স, ছিমছাম গল্প, অপ্রত্যাশিত থ্রিল... যারা পছন্দ করেন, তাদের বেশ ভালোই লাগবে এ ওয়েব ফিল্ম। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য- দহন, ডার্ক সাইড অব ঢাকা, খাঁচার ভেতর অচিন পাখি... রায়হান রাফির বিগত নির্মাণগুলোর চেয়ে 'টান' বেশ পরিপক্ক কাজ। এই নির্মাণের গতিতে যেমন এক সাবলীলতা ছিলো, পাশাপাশি পরিশীলিত হয়েছে বাদবাকি আনুষঙ্গিক প্রসঙ্গও...

অঞ্জন দত্ত গেয়েছিলেন- 

আর কিছু দিন তারপর বেলা মুক্তি,
কসবার ঐ নীল দেয়ালের ঘর।
সাদা-কালো এই জঞ্জালে ভরা মিথ্যে কথার শহরে,
তোমার আমার লাল-নীল সংসার! 

ঠিক এমনভাবেই এই নাগরিক জঞ্জালের যাপিত ক্লেদ ও গুমোট বাতাসের মধ্যেও ছিমছাম সংসার পাতে রাশেদ ও অবনী। যারা আপাতদৃষ্টে উলটো মেরুর দু'জন মানুষ। রাশেদ নেশাগ্রস্ত। ছন্নছাড়া যুবক। অবনী সংসারী মেয়ে। রাশেদের জীবনে 'লক্ষ্য' নামক বস্তুর লেশমাত্র নেই। এদিকে অবনীর জীবনজুড়ে ছোটখাটো কিছু লক্ষ্য, যাপিত সংগ্রাম। এরকম ভিন্ন পথের দুই মানুষকে  'ভালোবাসা' নামক পরশপাথর করে সহযাত্রী। যাত্রাপথের ভরসার হাত৷ শুরু হয় 'লাল-নীল' সংসার। যদিও 'জীবন' অঞ্জন দত্তের গান না। জীবন রূঢ়। নগ্ন বাস্তব। সে হিসেবে, রাশেদ-অবনীর এই আপাত 'রঙিন সংসার' বিবর্ণ হতে খুব একটা সময় লাগে না। 'বাটারফ্লাই এফেক্ট' এর মতন খুব ছোট এক বিচ্ছিন্ন ঘটনা তাদের জীবনের গতিপথ পালটে দেয়। যে গ'তে শুরু যাপিত জীবনের, সে জীবন এমন এক অতলস্পর্শী সর্পিল টানেলে অন্তরীণ হয়, অস্তিত্ব নিয়েই টানাটানি শুরু হয় যেন। অস্তিত্ব সংকটের এ গল্পই বলে 'টান।' যে গল্পের পুরোটাজুড়ে জোয়ার-ভাটার টান। নেশার টান। প্রিয় মানু্ষের মুঠোভর্তি ভালোবাসার টান।

রায়হান রাফির ওয়েব ফিল্ম 'টান' এর গল্পে খুব যে নতুনত্ব আছে, এমনটা বলার সুযোগ নেই মোটেও।  গড়পড়তা কাহিনীই বলা যেতে পারে। প্রেম, মাদক, টানাপোড়েন, খিস্তিখেউড়, ভায়োলেন্স... চেনাজানা বিষয়আশয় এর উপস্থিতি এখানেও ছিলো প্রবল। কিন্তু সেই চেনাপরিচিত গল্পই বলার ঢংয়ে খানিকটা অন্য মাত্রা পেয়েছে। গল্পের শেষাংশে এসে যেভাবে পাল্টেছে দৃশ্যপট ও  সমীকরণ... সেটাও ইতিবাচক। ক্যামেরার কাজ কিংবা নন-লিনিয়ার স্টোরিটেলিং... এক্সপেরিমেন্টাল কিছু বিষয়েরও উপস্থিতি ছিলো এখানে। সব নিরীক্ষা যে ঠিকঠাক উতরেছে, এমনটাও না। তবে সেসব উপাদান নির্মাণকেও যে খুব একটা প্রভাবিত করেনি, সেটিও বলাই বাহুল্য। 

রাশেদ-অবনী! 

'টান' এর কুশীলব কম থাকলেও সবাই নিজ নিজ জায়গা থেকে দারুণ। সিয়াম, বুবলি, সোহেল মণ্ডল, নীলাঞ্জনা নীলা, ফারজানা ছবি, আঞ্জুমান শিরিন... চরিত্রের ব্যাপ্তি দীর্ঘ কিংবা নাতিদীর্ঘ, কারো অভিনয়েই সেভাবে খামতি নেই। তবে এদের মধ্যেও আলাদা করে দুইজনের কথা না বলা অন্যায়।  প্রথমজন- বুবলি। দ্বিতীয়জন- সোহেল মণ্ডল। 'টান'কে যদি অভিনেত্রী বুবলির 'পুনর্জন্ম' হিসেবে ধরা হয়, তাহলে বোধহয় অত্যুক্তি হবেনা মোটেও। দেশীয় বানিজ্যিক সিনেমায় অভিনয়ের যে সুযোগটুকু তিনি কোনোদিনই পাননি, সেটাই পেয়েছেন 'টান' এ, এবং সুযোগের সদ্ব্যবহারও করেছেন দারুণভাবে। অন্যদিকে সোহেল মণ্ডল। অভিনেতা হিসেবে তিনি এমনিতেও দারুণ। এই নির্মাণের শেষদিকে গুরুত্বপূর্ণ যে ভার ছিলো তার কাঁধে, সেই দায়িত্বটুকু মিটমাট করেছেন তিনি প্রাসঙ্গিকভাবে। বলা ভালো, 'টান' এর শেষাংশে গল্পকে যুতসই 'প্রাণ' দেয়ার কাজটিই সফলভাবে করেছেন সোহেল মণ্ডল।

তবে 'টান' এ কিছু বিষয়ের অনুপস্থিতি এবং কিছু বিষয়ের অধিক উপস্থিতি মর্মপীড়া দিয়েছে বেশ। প্রথমত- নির্মাণের চরিত্রগুলোর শাখাপ্রশাখা কেন যেন সেভাবে তৃপ্তি দেয়নি। কেন প্রেম, কেন নেশা, কেন সংঘাত... এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া জরুরি ছিলো। সেখানে ঘাটতি ছিলো প্রকট। নির্মাণের গানগুলো শ্রুতিগ্রাহ্য। কিন্তু সেসব গানের ব্যবহার যথাযথ না মোটেও। তাছাড়া, এক ঘন্টা চুয়াল্লিশ মিনিটের নির্মাণে 'গান'কে এত গুরুত্ব দেয়ার বিষয়টিও খুব একটা প্রাসঙ্গিকতা পায়নি।  নির্মাণের শেষাংশে এসে যেভাবে গল্প পালটে গিয়েছে, সে পাল্টানোর প্রক্রিয়াও খুব একটা বিশ্বাসযোগ্য লাগেনি। অনেক যদি-কিন্তুর সুযোগ ছিলো সেখানেও। 

সিয়ামের চরিত্র আরেকটু খোলতাই হতে পারতো?

তবে এসব ছোটখাটো অসঙ্গতি বাদ দিলে, বাকিটুকু উপভোগ্য। বিশেষ করে রায়হান রাফির নির্মাণের যে টোন, অর্থাৎ- ভায়োলেন্স, ছিমছাম গল্প, অপ্রত্যাশিত থ্রিল... যারা পছন্দ করেন, তাদের বেশ ভালোই লাগবে এ ওয়েব ফিল্ম। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য- দহন, ডার্ক সাইড অব ঢাকা, খাঁচার ভেতর অচিন পাখি... রায়হান রাফির বিগত নির্মাণগুলোর চেয়ে 'টান' বেশ পরিপক্ক কাজ। এই নির্মাণের গতিতে যেমন এক সাবলীলতা ছিলো, পাশাপাশি পরিশীলিত হয়েছে বাদবাকি আনুষঙ্গিক প্রসঙ্গও। সেকারণেই তাই আক্ষেপ আরো ঘন হয়েছে, যদি 'টান' এর গতি আরেকটু টানটান হতো, যদি আরেকটু ভাবা হতো চরিত্রগুলো নিয়ে, তাহলে হয়তো ছোটখাটো চাপান-উতোরগুলোরও কোনো সুযোগ থাকতো না। আশা করি, সামনের কোনো নির্মাণে নির্মাতা এই আক্ষেপ ঘুচিয়ে দেবেন। ততদিন পর্যন্ত শুভকামনা।


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা