দেশে প্রতিদিন যখন একটা একটা করে সিনেমাহল বন্ধ হচ্ছে, এরকম অস্থিতিশীল সময়েও 'স্টার সিনেপ্লেক্স' দেশের নানা প্রান্তে সিনেমাহলের শাখা খুলছে। এবং তারা শুধু সিনেমা দেখানোতেই সীমাবদ্ধ রাখেনি নিজেদের, তারা সিনেমা বানাচ্ছেও। ছবি যারা দেখায়, তারা ছবি বানাতে পারে না- এই ন্যারেটিভকে ধূলিসাৎ করার জন্যেই যেন উঠে পড়ে লেগেছে তারা। বাংলা সিনেমাকে গ্রহনযোগ্য এক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যেই যেন তাদের যাপিত আয়োজন!
সাতচল্লিশে ভারত-পাকিস্তান ভাগের পর উপমহাদেশের এই চেনাপরিচিত ভূখণ্ডে এক বিচিত্র ব্যাপার হয়। বিস্ময়ের সাথে দৃষ্টিগোচর হয়, র্যাডক্লিফের আঁকিবুঁকির চক্করে উপমহাদেশের অধিকাংশ সিনেমাহলের ঠাঁই হয়েছে এদেশে। আর চলচ্চিত্র-নির্মাতারা সীমান্তের কাটাকুটিতে থিতু হয়েছেন ওদেশে। যদিও এতে সামগ্রিকভাবে কপাল পুড়েছে এপার বাংলারই। সিনেমা যে বানাতে পারে, সে সিনেমা দেখার ব্যবস্থাও করতে পারে নিশ্চয়ই। কিন্তু যে সিনেমা শুধু দেখাতেই জানে, সে সিনেমা বানাবে কিভাবে? এই অসম সংকটেই হুট করে সীমান্তের এপ্রান্ত পড়ে যায় বিস্তর বিভ্রান্তিতে। ক্রমশ কলকাতা বা ওপার বাংলার নির্মাতারা প্রেক্ষাগৃহের অভাব দূর করতে পারলেও এপ্রান্তের আমরা যে মেধা-সংকটে পড়লাম, তা কাটে না কোনোদিন। নির্মাতাজনিত এ দুর্দশার কথা বারবার উঠে আসে অনেকের লেখায়। ঋত্বিক ঘটক, জহির রায়হান কিংবা তারেক মাসুদ... তাদের কলম, তাদের কথা বারবার মনে করায় এই সংকটের ক্লান্তিকর উপাখ্যান।
ইতিহাসের হলদেটে পৃষ্ঠা বলে, এককালে একগাদা সিনেমা হল ছিলো আমাদের। প্রশ্ন ওঠে, কালের নানা ঘাটের জল পেরিয়ে আজ কয়টা সিনেমাহল অবশিষ্ট? প্রতিদিন কতসংখ্যক সিনেমাহল বন্ধ হচ্ছে? যে সিনেমাহলগুলো বাকি আছে সেগুলোতে বাংলা সিনেমা দেখার পরিবেশ কতটুকু? আজকাল বাংলা সিনেমা দেখতে কয়জন দর্শক আসেন? অজস্র প্রশ্ন। এসব প্রশ্নের উত্তর কারো কাছে আছে কী না, জানা না থাকলেও ঠিক এ প্রসঙ্গে সাম্প্রতিক একটা অভিজ্ঞতা বলি। বছরের শুরুতেই বাংলা এক সিনেমা দেখতে গিয়েছিলাম স্থানীয় এক সিনেমাহলে। গিয়ে দেখি, সেখানে সবমিলিয়ে দর্শক চার জন! সিনেমা হলের 'জায়ান্ট স্ক্রিন' কিংবা যাকে আমরা গালভরা 'রূপোলী পর্দা' বলে ডাকি, সেই পর্দার অবস্থা ফর্দাফাই। খানিকটা বৃদ্ধের ঘোলাটে চোখের মত জটিল। আর শব্দযন্ত্রের বুকে শ্বাসকষ্টের রোগীর তীব্র ঘড়ঘড়! টিকেট কেটে বাংলা সিনেমা দেখতে গিয়ে এহেন বৈপরীত্যের মুখোমুখি হবো, তা একবিন্দু কল্পনাতেও ছিলোনা। তবে এই অভিজ্ঞতায় টনক নড়লো বিস্তর। বুঝলাম, কাগজে-কলমে সিনেমা হলগুলোর দৈন্যদশা নিয়ে যতটা জানি, বাস্তবে তাদের অবস্থা তারচেয়েও বেশি ভয়ঙ্কর!
হয়তো ব্যয়বহুল সিনেমা হল কিছু আছে, সেখানে প্রযুক্তির উৎকর্ষতাও হয়তো ঠিকঠাক, কিন্তু সেসব প্রেক্ষাগৃহে যেতে পারেন কয়জন মধ্যবিত্ত বাঙ্গালী? আবার এই যে ঝাঁ-চকচকে সিনেমা হল, সেগুলোর কয়টিতে বাংলা সিনেমা দেখানো হয়? এই সিনেমা হলগুলোর টার্গেট অডিয়েন্স মোটেও মধ্যবিত্তরা না। তাদের যারা টার্গেট অডিয়েন্স, তারা হলিউডি নির্মানের পাঁড়ভক্ত। এবং ঠিক সে কারণেই, বিলাসবহুল প্রেক্ষাগৃহগুলোর আগ্রহের পুরোটাজুড়ে হলিউডি নির্মাণ। এটা হওয়াটাই প্রাসঙ্গিক। এত অর্থ লগ্নি করে বানানো প্রেক্ষাগৃহে তারা বাংলা সিনেমা দেখানোর ঝুঁকি কেনই বা নেবেন? তাদের যুক্তি গভীরভাবে ভেবে দেখলে তাদের এই 'বাংলা সিনেমা বর্জন' নীতিকে খুব একটা অমূলকও মনে হয় না।
তবে এ প্রসঙ্গে এক ব্যতিক্রমও আছে। সেই ব্যতিক্রমের নাম- স্টার সিনেপ্লেক্স। মধ্যবিত্ত মানুষজন সাধ, সাধ্য ও মান মিলিয়ে এখন যেতে পারেন শুধুমাত্র এই একটি জায়গাতেই। এই একটি জায়গায়ই নানা চলকের বিপরীতে গিয়েও বরাবর পাশে থেকেছে বাংলা সিনেমার। এমন না, তারা বিদেশি নির্মাণকে উপেক্ষা করে। বরং, তারা নিয়মিত বিদেশি সিনেমাও দেখায়। সেসব নির্মাণ দেখতে প্রচুর দর্শকও আসে, তাতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের লাভও হয়। এই লাভজনক সওদার পরে বাংলা সিনেমা নিয়ে মাতামাতি কিংবা আগ্রহ না দেখালেও তাদের বানিজ্যে খুব যে একটা সংকট হতোনা, তাও স্পষ্ট। কিন্তু তারা 'বাংলা সিনেমা'কে উপেক্ষার কথা তো ভাবেইনি, বরং স্রোতের প্রতিকূলে গিয়ে বরাবরই বাংলা সিনেমার একনিষ্ঠ প্রতিনিধি হিসেবে হয়েছে সরব। দেশে প্রতিদিন যখন একটা একটা করে সিনেমাহল বন্ধ হচ্ছে, এরকম অস্থিতিশীল সময়েও তারা দেশের নানা প্রান্তে সিনেমাহলের শাখা খুলছে। এবং তারা শুধু সিনেমা দেখানোতেই সীমাবদ্ধ রাখেনি নিজেদের, তারা সিনেমা বানাচ্ছেও। ছবি যারা দেখায়, তারা ছবি বানাতে পারেনা- এই ন্যারেটিভকে ধূলিসাৎ করার জন্যেই উঠে পড়ে লেগেছে তারা। বাংলা সিনেমাকে একটা গ্রহনযোগ্য পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যেই যেন তাদের যাপিত আয়োজন।
মহামারীর প্রকোপে সারাবিশ্বের চলচ্চিত্রমাধ্যম। যখন বেশ বড় এক পালাবদলের টালমাটাল প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে ক্রমশ এগোচ্ছে, বৈশ্বিক মহামারীর যাপিত প্রকোপ আর ব্যবসায়িক মন্দার নিয়মিত বিরতিতে যখন একে এক প্রেক্ষাগৃহগুলোর দেউটি নিভছে, ওটিটি প্ল্যাটফর্মের বরাতে মুঠোফোন রূপান্তরিত হচ্ছে চলমান সিনেমাহলে- এরকম এক সময়ে সিনেমাহলগুলোর 'ব্রাত্যদশা'র সাপেক্ষে যেন 'বাতিঘর' হিসেবেই ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি 'স্টার সিনেপ্লেক্স'কে। এবং শুধু দাঁড়িয়েই থাকা না, 'আশার বাতিঘর' হয়ে তারা ক্রমশ ছুটে চলে দেশের নানা প্রান্তে। সংস্কৃতির সংকট কাটাতে। দেশীয় নির্মাণের অন্ধকার প্রতিবন্ধকতা দূর করতে। যে প্রচেষ্টা আমাদের আশাবাদী করে। এবং ভাবনার খোরাক যোগায়, 'বাংলা সিনেমা' নিয়ে তাদের অনমনীয় দৃঢ়তা ও বাংলা সিনেমার প্রতি দায়বদ্ধতার এ দৃষ্টান্ত হয়তো কিছুটা হলেও প্রভাবিত করবে সবাইকে। এবং এই বিরুদ্ধ সময়ে সেটুকু হলেই বর্তে যাবে অনেকে। সাহস পাবে বাকিরা। সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। প্রাসঙ্গিক। এই সংকটকালে পাশে থেকে এই ভরসাটুকু যোগানোটাই সবচেয়ে বড় সমর্থন।