শাহরুখ খান মানেই সর্ষে খেতের মাঝখানে দুই হাত উঁচিয়ে 'তুঝে দেখা তো ইয়ে জানা সানাম' নয়, শাহরুখ মানেই শুধু টিপিক্যাল রোমান্টিসিজমের আদিখ্যেতা নয়, শাহরুখ মানে সবসময় শুধু লার্জার দ্যান লাইফ কোন ক্যারেক্টার নয়। ক্যারিয়ারের তুঙ্গে থাকার সময়টাতেও শাহরুখ এমন কিছু সিনেমা করেছেন, ২০২১ সালে বসে সেগুলোর কথা ভাবতে গেলে অবাকই হতে হয়!
সাম্প্রতিক কিছু ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে গত কিছুদিন ধরেই তিনি উপমহাদেশের সবার মুখরোচক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। যদিও সবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা কিংবা পাদপ্রদীপের ঝলমলে আলোর ঠিক নীচে থাকা তার জন্যে নতুন কোনো বিষয় না। হয়তো নেতিবাচক কারণেই এবার সংবাদের মধ্যমণি ছিলেন তিনি। তাতেও বা কী? চড়াই-উতরাই এর এ জীবনে আসা ঘাত-প্রতিঘাত কে কিভাবে সামলাচ্ছে, পার্থক্য গড়ে দেয় সেটাই। ঠিক সেখানেই তিনি আবারও প্রমাণ করলেন, কেন তিনি বাকি সবার চেয়ে আলাদা।
সাল ১৯৯২। হিন্দি সিনেমা। দিওয়ানা। রূপোলী পর্দায় আলগোছে এলেন এক নবাগত তরুণ। অভিনয়ের সৌকর্যে জ্বালালেন দাবানল। সময়ের ব্যবধানে উপমহাদেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে যে সর্বভুক দাবানল ছড়ালো বিশ্ব-মানচিত্রের নানাবিধ প্রকোষ্ঠে। সেদিনের সেই তরুণ কিংবা আজকের বিশেষ এই মানুষটির নাম শাহরুখ খান। বলিউড বাদশা কিংবা কিং খান। ২৯ বছর ধরে সবার প্রিয় 'বাজিগর।' যিনি কোনো নির্দিষ্ট দেশের তারকা না। যিনি সুপারস্টার। গ্লোবাল সুপারস্টার।
এই সুপারস্টারের ফিল্মোগ্রাফির দিকে তাকালে চমকে উঠতে হয়। বলিউডের বাঁক বদলকারী অজস্র সিনেমার মালিকানা একচেটিয়াভাবে যেভাবে দখল করে রেখেছেন তিনি, তা বিস্ময়কর। তার প্রতিটি সিনেমা নিয়েই এত এত আলোচনা, আলাদা করে তাই কোনো সিনেমা নিয়ে বলা দুরূহ। চর্বিত চর্বণ হয়ে যাবার আশঙ্কা থাকেই। সেসব শঙ্কা মাথায় রেখে, খানিকটা সাহসী হয়েই আজ কথাবার্তা তার অভিনীত পাঁচটি এমন সিনেমা নিয়ে, যেসব সিনেমা গুণগতমানে এতটাই অসাধারণ, চাইলে আরো একটু বেশি আলোচনা এ সিনেমাগুলো পেতেই পারতো। সিনেমাগুলোর পরিণতি নিয়ে কিছু আক্ষেপ আর বাদবাকিটুকু প্রশংসা নিয়েই আজকের লেখার অবতারণা।
১. স্বদেশ
তালিকার শুরুতে এ নাম দেখে অনেকেই খানিকটা চমকে যাবেন। শাহরুখ খানের সিনেমা-ক্যারিয়ারের অন্যতম তুখোড় কাজ হিসেবে বিবেচনা করা হয় যে সিনেমাকে, সেই সিনেমাই বিস্ময়করভাবে মুখ থুবড়ে পড়েছিলো বক্স অফিসে। একজন ভারতীয় বিজ্ঞানীর জীবনের সত্যঘটনা অবলম্বনে নির্মিত এ সিনেমায় 'মোহন ভার্গব' চরিত্রে শাহরুখ খানের যে অভিনয়, তা তো অনবদ্য ছিলোই। পাশাপাশি দুর্দান্ত এক গল্প কিংবা অসাধারণ মিউজিক অ্যারেঞ্জমেন্ট...সব মিলিয়ে 'স্বদেশ' ২০০৪ সালের প্রেক্ষাপটে ভিন্ন স্বাদের এক সিনেম্যাটিক এক্সপেরিয়েন্স হিসেবেই প্রকট হয় সিনেমাপ্রেমীদের কাছে।
২. পেহেলি
এই সিনেমা নিয়ে সিনেমা-মহলে কথাবার্তা সবচেয়ে কম শুনি। অথচ যে সময়ে এ সিনেমা মুক্তি পায়, সে সময়ের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে এ ফ্যান্টাসি সিনেমা খানিকটা ভিন্ন দ্যোতনাই দিয়েছিলো। প্রাচীন এক উপকথা অনুযায়ী, একবার এক ভূত প্রেমে পড়ে সদ্যবিবাহিত এক নারীর। সে প্রেম এতটাই নাছোড়বান্দা, ভূত তার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যায় সে নারীর হৃদয় জয় করার। গল্পের অভিনবত্ব, এক্সিকিউশন এর চমৎকারিত্ব এবং কুশীলবদের দুর্দান্ত অভিনয়...সব মিলিয়ে 'পেহেলি' যতটুকু পাদপ্রদীপের আলো পেয়েছে, তা যথেষ্ট নয়। এ সিনেমা আরো আলোচনার দাবীদার।
৩. কাভি হা কাভি না
'রোমান্টিক কমেডি' জনরার সিনেমা তো আজকাল প্রচুর হয়। তবুও নাইন্টিজের কিড যারা, তাদের কাছে এই জনরার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সিনেমা হিসেবে অক্ষয় স্থান দখল করে থাকবে 'কাভি হা কাভি না।' এবং বলা বাহুল্য, চোখে লেগে থাকবে শাহরুখ খানের অভিনয়ও। 'সুনীল' চরিত্রে যে অভিনয় তার, সে অভিনয়কে শুধু 'অসাধারণ' বললে কম বলা হয়। গল্প, পরিচালনা, মিউজিক অ্যারেঞ্জমেন্ট... সব নাহয় উহ্য রইলো। শুধুমাত্র শাহরুখ খানের অভিনয় দেখার জন্যে হলেও এ সিনেমা দেখা যায় বারবার।
৪. ইয়েস বস
সিনেমার গল্প খুব যে অন্যরকম, তা বলার সুযোগ নেই মোটেও। কিন্তু আটপৌরে এক গল্প হওয়া সত্বেও 'ইয়েস বস' এর আবেদন কখনোই কমেনি। রাহুল নামের এক তরুণ, যে তার বসের সব আজ্ঞাকে পালন করাকেই বানিয়েছে জীবনের ব্রত, তাকে দিয়ে শুরু হয় সিনেমার যাত্রা। প্রভুর একনিষ্ঠ আজ্ঞাবাহক হয়ে রাহুলের জীবন কাটতে থাকে। কিন্তু যেদিন তার সাথে আকস্মিকভাবে সীমার পরিচয় হয়, গল্প ঘুরে যায় পুরোপুরি। এ সিনেমার গানগুলো এখনও তো নস্টালজিক করেই, পাশাপাশি শাহরুখ-জুহি জুটির দস্যিপনাও চোখে ভাসে।
৫. ফির ভি দিল হ্যায় হিন্দুস্থানি
মিডিয়া নিয়ে ডার্ক কমেডি... তাও ২০০০ সালের টাইমফ্রেমে দাঁড়িয়ে, খানিকটা চমকে ওঠার মতনই বিষয়। দুইজন প্রতিদ্বন্দ্বী সাংবাদিক একত্রিত হয়ে এক অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর গল্পই মোটাদাগে এ সিনেমার উপজীব্য। তবুও গল্পের ভাঁজে গল্প থাকে। ঘটনার অন্তরালে ঘটনা। সেসব কিছুই ক্রমশ এ সিনেমায় উঠে আসে। শাহরুখ খান বরাবরের মতনই দুর্দান্ত অভিনয় করেন। জুহি-শাহরুখ ক্যামেস্ট্রি নিয়েও আলাদা করে কিছু বলার নেই। অন্যায়ের প্রতিবাদ, ইন্ডিয়ান জিঙ্গোইজম এবং মিষ্টি মধুর খুনসুটি...সবমিলিয়ে এ সিনেমার রেশ আজও অম্লান।
পাঁড় শাহরুখ-ভক্তরাও স্বীকার করবেন, শাহরুখ খানের সাম্প্রতিক সিনেমাগুলো ঠিক শাহরুখ-সুলভ না। কিং খান অভিনীত বিগত তিন সিনেমার মধ্যে দুটি ফ্লপ করেছে। একটি সেমি ফ্লপ। যে মানুষ সময়ের নানা ভাগে মনে রাখার মতন অগুনতি কালজয়ী সিনেমা উপহার দিয়েছেন, তার নামের পাশে এই ধূসর বিষাদ কোনোভাবেই কাম্য না৷ 'বলিউড বাদশাহ' এর জন্মদিনে তাই একটাই প্রত্যাশা, প্রতিকূল স্রোত কাটিয়ে আবারও দোর্দণ্ডপ্রতাপে পর্দায় কামব্যাক হোক তার। কেন তিনি বলিউডের রাজা, তা প্রমাণ করার জন্যে তার খুব তাড়াতাড়ি ফিরে আসা জরুরিও। আশা করি, জাঁকালো এক প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষা দ্রুতই ফুরোবে।