সোল: অন্তরাত্মার আত্মশুদ্ধির অপার্থিব আখ্যান!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
সামাজিক অবক্ষয়, প্রতিহিংসা, হতাশাগ্রস্ত জীবন, তীব্র পরশ্রীকাতরতার এ পৃথিবীতে 'সোল' শোনায় আত্মশুদ্ধির অবাক সুন্দর এক গল্প। যে গল্প আমার, আপনার, আমাদের। গোটা পৃথিবীবাসীর।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষে যখন পড়াশোনা করছি, আমার এক ক্লাসমেট রোড অ্যাক্সিডেন্ট করে মারা গেলো হঠাৎ৷ জানা গেলো, আমার এই বন্ধুটি পরিবারের একমাত্র সন্তান। তার আর কোনো ভাই-বোন নেই। আশ্চর্য হলাম জেনে, তার বাবাও নেই৷ পরিবারে আছে মা আর বৃদ্ধা দিদিমা। ওর বাড়িতে আমরা কয়েকজন মিলে বেশ ক'বার গিয়েছি৷ বিশাল বাড়ি, বিস্তীর্ণ জমিজিরাত। কিন্তু পুরোটাই যেন বিরানভূমি। বিশাল বিস্তীর্ণ অনিকেত প্রান্তরে দুটি মাত্র মানুষ। মা আর বৃদ্ধা দিদিমা৷
সেদিনই প্রথম বুঝতে পেরেছিলাম, জীবন যেতে যেতে হুট করেই থেমে যেতে পারে রাস্তার বাঁকে। কখনোই কোনো সংজ্ঞার ধার না ধারা জীবন, একেকজনের কাছে একেক অবতারে বিমূর্ত হয় নিয়মিত। এই প্রকট হয়ে বসা অবতার, আর অমোচনীয় জীবন-গল্প থেকে বের হওয়াও সম্ভব হয়না অধিকাংশ মানুষের। অনেকটা 'Rango' সিনেমার সেই বিখ্যাত ডায়লগের মতন-
No Man walk out of his own story.
সোজা বাংলায়-
ললাটের লিখন না যায় খণ্ডন!
'Human' নামে এক ডকুমেন্ট্রি ফিল্ম দেখেছিলাম বেশ ক'দিন আগে। সেখানে এক বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো-
What is life?
সে কিছুক্ষণ ভেবে বললো-
টাকাকে সময়ের বিনিময়ে কিনে একটু ভালো থাকার অভিনয়ই জীবন।
অর্থকড়ির মোহ, বিত্তের মোহ, জনপ্রিয়তার মোহ, প্রভাবের মোহ... এসব বিমূর্ত গোলকধাঁধায় আমরা আমৃত্যু চালাই অন্তবিহীন লড়াই। সময়ের আগে হাঁটতে চাওয়ার অভ্যেসে ম্লান হয় মিঠেকড়া রোদ, লিলুয়া বাতাস বা আদিম ধ্রুবতারা। এভাবে ক্রমশ 'রূপান্তরিত' হতে হতে যখন বেলাশেষের ঘন্টি বেজে ওঠে, আচমকাই বুক থেকে উঠে আসে এক দীর্ঘশ্বাস। তারাশঙ্করের 'কবিয়াল নিতাই' ফিসফিস করে গেয়ে ওঠে ভেতরে-
হায়, জীবন এত ছোট কেনে!
ডিজনি আর পিক্সারের কম্বিনেশন বরাবরই দারুণ৷ আমার অলটাইম ফেভারিট অ্যানিমেটেড ফিল্মের মধ্যে 'ইনসাইড আউট' এবং 'র্যাটাটুলি'কে আমি শীর্ষের দিকেই রাখি। দুটিই এসেছে পিক্সার- ওয়াল্ট ডিজনি ফ্রাঞ্চাইজি থেকে। এই ফ্রাঞ্চাইজি হতাশ করেনি 'সোল' এর বেলাতেও। বরং এই সিনেমা এত ছিমছামভাবে জীবনের মূল অথচ হারানো সুরকে তুলে আনে আমাদের সামনে, যা অনবদ্য। 'সহজ কথা যায় না বলা সহজে' কে ভুল প্রমাণ করে 'সোল' আমাদের দেখায়- টুকরো টুকরো সহজপাচ্য গল্প দিয়ে গাঁথা সূক্ষ্ম জীবনবোধের এক অপার্থিব আখ্যান।
জো গার্ডনার নামের এক মানুষকে দিয়ে শুরু হয় গল্প। ছোটবেলা থেকেই যার শখ, খুব ভালো একজন পিয়ানিস্ট হবেন তিনি। গোটা আমেরিকা তাকে এক নামে চিনবে৷ কিন্তু মানুষ ভাবে এক, হয় আরেক৷ 'বিখ্যাত পিয়ানিস্ট' হওয়ার তাঁর স্বপ্ন, বুকপকেটের ভাঁজ করা রঙিন খাম হয়েই থেকে যায়। ভাগ্যের শিকে আর ছেঁড়েনা৷ গড়পড়তা টানাপোড়েনের দিন চলতে থাকে তার। কিন্তু বেশিদিন না। 'ফরেস্ট গাম্প' সিনেমার 'লাইফ ইজ এ বক্স অব চকোলেটস' সূত্র মেনে হুট করেই আসে এক সুযোগ। জনপ্রিয় এক 'জ্যাজ ব্যান্ড' তাকে সুযোগ দেয় তাদের সাথে কাজ করার। সন্ধ্যা ৭টায় শো। কন্ট্রাক্ট হয়ে যায় দুইপক্ষের।
'স্বপ্ন হলো সত্যি'র চওড়া হাসি ঝুলিয়ে বাড়ি ফিরছিলো জো। এরইমধ্যে ছন্দপতন। খুলে রাখা এক ম্যানহোলে অসাবধানে পড়ে যায় সে৷ সেখান থেকে সোজা আগমন জীবন-মৃত্যুর মাঝখানের 'নো ম্যান'স ল্যান্ড' এ। সে বুঝতে পারে, তাঁর আত্মা চলে এসেছে এই অদ্ভুতুড়ে জায়গায়৷ দেহটা রয়ে গিয়েছে পৃথিবীতেই। পৃথিবীতে ফেরার জন্যে জো এর আত্মা বা 'সোল' এর তখন থেকেই শুরু হয় সংগ্রাম। সেখানে তার সাথে যুক্ত হয় '২২।' গল্পের মোড় ঘুরে যায় তখনই। এবং 'সোল' এর মূল গল্প শুরু হয় এর পর থেকেই।
'ইটস অ্যা ওয়ান্ডারফুল লাইফ' সিনেমা আমরা অনেকেই দেখেছি। সেখানে এক হতাশাগ্রস্থ ব্যবসায়ী 'বায়বীয়' থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছিলো, তাকে ছাড়া পৃথিবী কিভাবে চলছে। 'সোল' গল্পেও 'জো গার্ডনার' পায় সেই সুযোগ। দূর থেকে নিজের জীবনকে দেখতে দেখতে সে বুঝতে পারে, কিছু সাধারণ স্বপ্নের পেছনে ছুটতে গিয়ে, অসাধারণ জীবনটাই আর নেড়েচেড়ে দেখা হয়নি তার। ঠিক এ পর্যায়ে এসে, জো গার্ডনার হয়ে যায় আমাদের প্রতিনিধি। আমরা ক্রমশ বুঝতে পারি, এ গল্প আসলে কল্পিত কোনো মানুষের গল্প না৷ এটি আমাদের নিজেদের গল্পই।
জীবনানন্দ দাস তার রোজকার ডায়েরীর এক এন্ট্রিতে একবার লিখেছিলেন,
আলতো করে জীবন কাটাতে চাই৷
এই 'আলতো করে জীবন কাটানো' লাইনটি উপলব্ধি করা খুব গুরুত্বপূর্ণ। খুব বেশি চাহিদা, খুব বেশি আকাঙ্ক্ষা না রেখে ছিমছাম জীবনযাপন করার মধ্যেই নিহিত সব সুখ। কিন্তু এই ছিমছাম জীবনযাপন করা কী এতই সহজ? লক্ষ্য করা যেতে পারে, সেই বিখ্যাত লাইনটি-
It is simple to be happy. But, it is difficult to be simple.
আমাদের লক্ষ্য, আকাঙ্ক্ষা, হাপিত্যেশ বরাবরই সর্বোচ্চের দিকে। জীবন তো আছেই৷ কিন্তু একটা ভালো চাকরী, তুমুল জনপ্রিয়তা, প্রচুর অর্থবিত্ত না থাকলে, সেটা আবার জীবন নাকি! এই স্থুল চিন্তাভাবনার পার্থিব বস্তুগত লালসা ক্রমশই গ্রাস করে অপার্থিব সব সুকুমার অনুভূতিকে৷ ঠিক সেখানেই ধাক্কা দেয় 'সোল।' এই সিনেমা আমাদের শেখায় ওমর খৈয়ামের সেই বিখ্যাত উক্তি-
এই মুহুর্তই তোমার জীবন। এই মুহুর্তকে উপভোগ করো।
মজার ব্যাপার, এই সিনেমার শেষ লাইনটিও মিলে যায় ওমর খৈয়ামের এই উক্তির সাথে, যেখানে জো গার্ডনার উচ্চারণ করছে-
I am not sure, but I know, I am going to live every minute of it.'
যাপিত জীবনে আমাদের সব 'টু ডু লিস্ট' এবং 'গোল'কে ধাক্কা দেয় এই বাক্য। জো গার্ডনার আমাদের এটাই জানায়, জীবনে ধরাবাঁধা কোনো উদ্দেশ্য থাকা মোটেও কাজের কথা না৷ ছোটখাটো হাসিকান্না, আলো-আঁধারে ছাপিয়ে যাওয়া উচিত জীবন। বিশাল বিশাল মহীরুহ উদ্দেশ্যের সামনে থমকে দাঁড়ানো যে জীবন, সে জীবন শ্যাওলার মত আটকে থাকে হতাশার একপ্রান্তের দড়িতে। দিনশেষে গুরুত্বপূর্ণ কী? নিজের জীবন নিয়ে আত্মতৃপ্তি? নাকি, সফল হওয়ার জন্যে চির অতৃপ্তির এক জীবন যাপন? এ প্রশ্নের মুখোমুখি এসে দাঁড়াই আমরা 'সোল' দেখার পর। মাথায় চলে আসে, বং জুন হো'র অস্কারজয়ী 'প্যারাসাইট' সিনেমার সেই লাইন-
You Know what kind of plan never fails? No plan.
জীবনে ছোট ছোট চাওয়া পাওয়া অবশ্যই থাকবে। প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির মেলবন্ধনে যে জীবন, সে জীবনে হর্ষ-বিষাদও থাকবে। কিন্তু এমন কোনো লক্ষ্য থাকবে না সেখানে, যে লক্ষ্য কোনো কারনে পালন করা সম্ভব না হলে জীবনের সাম্যাবস্থাই নষ্ট হয়ে যায়। মাথায় রাখতে হবে, কুংফু পান্ডা সিনেমার সেই বিখ্যাত 'ইনার পিস'কেও। বুঝতে হবে, ছোটখাটো সন্তুষ্টি আর অন্দরমহলের প্রশান্তির চেয়ে জাগতিক কোনোকিছুই বড় নয় আর৷ 'সোল' এ কারণেই অসাধারণ। বৈষয়িক মোহের এ পৃথিবীতে যাপিত মূল্যবোধ, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে আরেকটু খোলামেলা ও পরিষ্কার ধারণা দেয় 'সোল।' সে সাথে নিজের জীবন নিয়ে স্বস্তির একখণ্ড বাতিঘর হওয়ার প্রেরণাও দেয় 'সোল।'
সামাজিক অবক্ষয়, প্রতিহিংসা, জীবন নিয়ে হতাশা ও পরশ্রীকাতরতার এ পৃথিবীতে 'সোল' শোনায় আত্মশুদ্ধির অবাক সুন্দর এক গল্প। যে গল্প আমার, আপনার, আমাদের। গোটা পৃথিবী বাসীর।
ঠিক সে কারণেই 'সোল' সাম্প্রতিককালে সবচেয়ে বেশি প্রাসঙ্গিক।