আধুনিক ক্রাইম থ্রিলার ফিকশনে পুলিশের ক্যারেক্টার মানেই যে পেটানো শরীর না, বরং তার একটা মানবিক জার্নি আছে, এমন রাইটিংয়ের জন্য কৃতজ্ঞতা জানাই শিহাব শাহীনের প্রতি। বাংলাদেশের কন্টেন্টেও যে কোনো ক্যারেক্টার রাইটিংয়ে ‘ধীরে চলো নীতি’তে এগুনো যায়, ক্যারেক্টারটির বিল্ডআপ দেখানো যায়, তার জন্য অগ্রীম ধন্যবাদ আপনাকে।
শেষ কবে কোন বাংলাদেশী কন্টেন্টে কোনো পুলিশ অফিসারকে আমরা ব্রাশ করতে দেখেছি স্ক্রিনে?
প্রশ্নটা হাস্যকর শোনাতে পারে। তবু একটু ভেবে বলেন তো? মরীচিকার ট্রেলারে পুলিশ অফিসার সিয়াম ব্রাশ করছে- এটা আমার কাছে একটা চমৎকার দৃশ্য মনে হয়েছে। ইউনিফর্মের বাইরেও আবার পুলিশের জীবন আছে! তারাও ব্রাশ করে! জিন্স আর শার্ট পরেও বের হয়! আচ্ছা, বড় কিংবা ছোট পর্দায় ইউনিফর্ম ছাড়া পুলিশ আমরা কল্পনা করতে পারি? এটা তো ‘ফিক্সড টেমপ্লেট’ হয়ে গেছে যে পুলিশ মানেই হয় সে ভীষণ সৎ কিংবা ভীষণ দুর্নীতিগ্রস্থ। কিন্তু একজন পুলিশও যে সাধারণ মানুষ, তারও যে স্ট্রাগল আছে, চ্যালেঞ্জ আছে, তিনিও যে কান্না করতে জানেন, ভেঙে পড়েন, আবার উঠে দাঁড়ান নিজেকে প্রমাণ করার মিশনে- এসব তো আমাদের কন্টেন্টে ভীষণরকমের উপেক্ষিত।
মরীচিকার ট্রেলারে নিশো যে কাঁপিয়ে দিয়েছেন, এটা প্রত্যাশিতই। নিশোর যে ব্যক্তিত্ব, তিনি যেমন পারফরমার; নতুন করে তাকে নিয়ে তো কিছু বলার নেই। স্রেফ অবিশ্বাস্য একজন অভিনয়শিল্পী। তার সাথে সিয়ামের ফেস অফ; কিন্তু অনেকেই হয়তো সিয়ামকে দেখে হতাশ। সিয়ামের সিক্স-প্যাক নেই, তার হিমশীতল চাহনীতে প্রতিপক্ষ অসাড় হয়ে যাচ্ছে না, তার চরিত্রের সেই গ্ল্যামার নেই। প্রটাগনিস্ট হিসেবে সিয়ামের ক্যারেক্টারটি নিয়ে তাই অনেকের সংশয়। আমার ঠিক এই জায়গাটাই মুগ্ধতা। একটু সময় নিয়ে বলি।
বরাবরই দূর্বলের প্রতি পক্ষপাত আমার। ঠিক এ কারণেই ফুটবল সবচাইতে পছন্দের খেলা। কারণ ৯০ মিনিটের যে অ্যাড্রেনালিন রাশ, তাতে যে কেউ যে কাউকে হারিয়ে দিতে পারে, র্যাংকিং এখানে শেষ কথা নয়। আমরা যদি সেকরেড গেমসের সারতাজ সিংয়ের (সাইফ আলী খান) ক্যারেক্টারটির ব্যবচ্ছেদ করি, সিজনের শুরুতে তাকে দেখানো হয়েছে একজন ডিপ্রেসড, মোরালি ডাউন পুলিশ অফিসার হিসেবে। মুম্বাইয়ের কেইলাশপাড়া থানার এক চুনোপুঁটি পুলিশ সারতাজ। সে সৎ, কাজেই আপস করতে জানে না। সে জুনিয়র, তাই বড় কোনো ইনভেস্টিগেশন তার কাঁধে জুটে না। সহকর্মীদের দুর্নীতি তাকে বিবেকের দংশনে বিদ্ধ করে। সহকর্মীদের এই মেরুদণ্ড ভেঙে যাওয়ার ব্যাপারটা দেখতে পাই মরীচিকার ট্রেলারেও, যখন সিয়ামকে আরেকজন পুলিশ অফিসারের সঙ্গে বাক্যবিনিময় করতে শুনি, ‘পুলিশবাহিনীর সদস্য না আপনি? পুলিশের মতো কথা বলেন!’
ক্রাইমলর্ড গনেশ গাইতোন্ডের কেইসটা সারতাজ দেখতে চায়, কিন্তু সুযোগই মেলে না। নিজেকে প্রমাণের দায় সিয়ামেরও, ট্রেলারে আমরা সিয়ামকে বলতে শুনি, ‘স্যার, আমি অনেক বড় একটা ক্লু পেয়েছিলাম আজকে স্যার!’ প্রতিউত্তরে সিনিয়র কর্মকর্তা চেঁচিয়ে বলছেন, ‘ডিপার্টমেন্ট কি তোমার কথামত চলবে?’
ধান ভানতে গিয়ে শিবের গীত গাইছি মনে হতে পারে আপনার কাছে। না, আমি কোনোভাবেই স্যাকরেড গেমসের সাথে মরীচিকার কিংবা সারতাজের সাথে সিয়ামের ক্যারেক্টারটির তুলনা করছি না, তুলনা করা সাজেও না। সেকরেড গেমসে যতই সিজন সামনে এগিয়েছে, সারতাজের ক্যারেক্টারের লেয়ার খুলেছে। ধীরে ধীরে তার চোয়াল শক্ত হয়েছে, ইস্পাতদৃঢ় প্রতিজ্ঞা ঠিকই তার চোখমুখ থেকে ঠিকরে বেরিয়েছে। আমার ধারণা, মরীচিকাতেও সিয়ামের ক্যারেক্টারটাও ধীরে ধীরে দারুণ একটা শেপে চলে আসবে। অ্যান্টাগনিস্ট নিশোর প্রতিপক্ষ হিসেবে সিয়াম মরীচিকায় তার অভিনয়দক্ষতার প্রমাণ দেখাবে, এটাই প্রত্যাশা। ‘তোর একবারের জন্যেও মনে হয় না লাশটা উপ্রে থেইকা পাইপের উপ্রেই ক্যান পড়লো’ কিংবা নাজনীন হাসান চুমকির ‘এই, আপনি কি শুনতে পাচ্ছেন, আমি আর এখানে থাকতে পারবো না’র জবাবে ‘অ্যাইইইইইইইই’ বলে সিয়ামের অভিব্যক্তি যেন সেই আশার পালেই হাওয়া দিচ্ছে।
আধুনিক ক্রাইম থ্রিলার ফিকশনে পুলিশের ক্যারেক্টার মানেই যে পেটানো শরীর না, বরং তার একটা মানবিক জার্নি আছে, এমন রাইটিংয়ের জন্য কৃতজ্ঞতা জানাই শিহাব শাহীনের প্রতি। চাইলে নিশোর বিপরীতে একজন ‘কম্প্যাক্ট’ পুলিশ অফিসারকে দেখাতে পারতেন তিনি, যার ধামাকাদার এন্ট্রি হয়তো অডিয়েন্সের কাছে মসলাদার মনে হতো। কিন্তু বাংলাদেশের কন্টেন্টেও যে কোনো ক্যারেক্টার রাইটিংয়ে ‘ধীরে চলো নীতি’তে এগুনো যায়, ক্যারেক্টারটির বিল্ডআপ দেখানো যায়, তার জন্য অগ্রীম ধন্যবাদ আপনাকে।
বকবক শেষ করি। বিকট শব্দে মিশা সওদাগরের ‘এইইইইইইই… ইন্সপেক্টর’ বলে দেখে নেয়ার হুমকি থেকে নতুন যুগে পদার্পণ করুক বাংলাদেশের কন্টেন্ট। সিয়ামের জন্য শুভকামনা। সব সময়ই ‘ইফোর্ট’ দেখি, ‘আউটকাম’ আমার কাছে সেকেন্ডারি। এই সময়কার অভিনেতাদের মাঝে সিয়ামের ইফোর্টে কোনো খামতি দেখি না। স্ক্রিপ্ট চুজিং থেকে শুরু করে প্রতিটা ক্যারেক্টারেই বিশ্বাসযোগ্য অভিনয়ের চেষ্টা, সত্যিই দারুণ প্রশংসনীয়। এই যে মরীচিকায় সিয়ামের মুখে একটা কৃত্তিম ‘তিল’ দেখতে পেলাম, আমার ধারণা এটাও সিয়ামের নিজের সিদ্ধান্ত। এক ক্যারেক্টারের সাথে আরেক ক্যারেক্টারের লুক যেন মিলে না যায়, সেজন্যেই হয়তো!
মরীচিকা এক সময় ‘কাল্ট ক্ল্যাসিক’ হয়ে উঠবে, এমনটা প্রত্যাশা করছি না। শুধু চাই আর্টিস্টরা যার যার ক্যারেক্টার অনুযায়ী পরিমিত অভিনয় করুক, স্টোরিটেলিংয়ে যেন মেদ না থাকে, দারুণ কিছু সংলাপ যেন শুনতে পাই, কিছু চেজিং সিন যেন সত্যিই ইন্টেন্সড হয়। আমরা যেন শেষ সিকুয়েন্স শেষে কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থাকি, কিছুক্ষণ পর অস্ফুট স্বরে বলে উঠি, ‘সাবাস! এমন বাংলাদেশী কন্টেন্টই তো দেখতে চাই!’