অমিত মাসুরকার এর 'নিউটন' দেখে তাঁর নির্মাণগুলোর উপরে প্রত্যাশা বেড়ে গিয়েছিলো। 'শেরনি' সেই প্রত্যাশার যোগ্য সম্মানই দিয়েছে। একরত্তি জায়গা থেকে শুরু হয়ে মূল গল্পকে পৌঁছে দিয়েছে এমন এক পরিণতিতে, যে পরিণতি দর্শককে ভাবাবে অনেক দিন...

শ্বাপদসংকুল এক নিবিড় অরণ্য। সেই অরণ্যকে ঘিরে জীবনসংগ্রামে লিপ্ত একঝাঁক নিরক্ষর মানুষ। সেই অক্ষরজ্ঞানহীন মানুষদের ঘিরে গনগন আঁচে জ্বলছে গ্রাম্য হিংস্র রাজনীতির লেলিহান বলয়, এই ত্রিশঙ্কু বিব্রত জনপদের জন্যে আছে একটা নড়বড়ে, নাজুক ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট, সেই ডিপার্টমেন্টে ডিএফও (ডিভিশনাল ফরেস্ট অফিসার) হিসেবে একদিন সকালে এসে উপস্থিত হলেন আপনি। এরপর? নড়বড়ে অফিসের সবকিছু শক্তভাবে সামলাতে পারবেন তো? 

এমনই এক পরিস্থিতিতে শুরু হয় 'শেরনি'র গল্প। যেখানে পাণ্ডববর্জিত এক গ্রামে 'ডিএফও' হিসেবে আসেন বিদ্যা ভিনসেন্ট। জরাজীর্ণ ফরেস্ট অফিসে আসার পরে তিনি দেখেন অদ্ভুত এক চিত্র। কোনো কিছুই যেন ঠিক নেই এখানে। যে যার ইচ্ছে-স্বাধীন যা খুশি করে যাচ্ছে। টিপিক্যাল সরকারি অফিসের নিয়ম মেনে এই ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের কর্মচারীরাও উদাসীন তাদের দায়িত্বে। বন বিভাগের যিনি কর্তা, তিনি প্রচণ্ড রকমে দুর্নীতিপরায়ণ এক মানুষ। স্থানীয় এক নেতার তোষামোদিতেই তিনি নিজেকে নিয়োজিত রাখেন সিংহভাগ সময়ে। বাকি যারা রইলো,  তারাও কাজকর্ম এড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টাতেই মগ্ন থাকে দিনভর। 

দ্বন্দ্বমুখর এই কর্মক্ষেত্রে থিতু হওয়ার চেষ্টা করতে করতে বিদ্যার উপলব্ধি হয়, এভাবে রামরাজত্ব চলতে থাকলে, তার পক্ষে এখানে বেশিদিন থাকা সম্ভব হবে না। আবার হুট করে 'সবেধন নীলমণি' চাকরিও ছাড়া সম্ভব না। পরিবারেও আর্থিক নানা সংকট চলছে। বিদ্যা তাই সিস্টেমের মধ্যে থেকেই চেষ্টা করে সবকিছু মানিয়ে নিতে। চেষ্টা করে নিজের কাজে সৎ থাকতে। এরইমধ্যে হঠাৎ একদিন ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টে আসে এক খবর। জানা যায়, মানুষখেকো হয়ে উঠেছে নাকি এক বাঘিনী। যখন যাকে পাচ্ছে মেরে ফেলছে। গোটা গ্রামেরই ত্রাস হয়ে উঠেছে এই শেরনি। যে শেরনি পরবর্তীতে 'ত্রাস' থেকে হয়ে যায় স্থানীয় রাজনীতিকদের নির্বাচনী প্রচারণার ট্রাম্প কার্ডও! পরিস্থিতি ক্রমশই চলে যেতে থাকে নাগালের বাইরে৷ কতটুকুই বা করা সম্ভব বিদ্যার পক্ষে? ঘুনেধরা সিস্টেমের মধ্যে থেকে পালটে দেয়ার এই মহাযজ্ঞ কী আদৌ বাস্তব হয় কখনো? 

অমিত মাসুরকার এর 'নিউটন' সিনেমা দেখে তার নির্মাণগুলোর উপরে প্রত্যাশা বেড়ে গিয়েছিলো। 'শেরনি' সেই প্রত্যাশার যোগ্য সম্মানই দিয়েছে। 'নিউটন' এর মতনই একরত্তি জায়গা থেকে শুরু হয়ে মূল গল্পকে পৌঁছে দিয়েছে এমন এক পরিণতিতে, যে পরিণতি দর্শককে ভাবাবে অনেক দিন। 

গোটা পৃথিবীতে বাঘের সংখ্যা ক্রমশই কমছে। কমে যাওয়ার যে পরিসংখ্যান উপমহাদেশের প্রেক্ষাপটে এসে আরো মর্মান্তিক। ভারত, বাংলাদেশে বাঘের মোট সংখ্যার ক্রমহ্রাসমান হার একটু একটু করে চলে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। এরকম এক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুকে অ্যাড্রেস করে সিনেমা বানানোর এই যে প্রচেষ্টা, এটা অবশ্যই বিশাল এক ধন্যবাদ পাবার যোগ্য। সিনেমার পুরোটা জুড়ে যে মূলভাব ফুটে উঠলো, সেটাও দুর্দান্ত। বনের পশুর চেয়ে যে শতগুণে ভয়ঙ্কর মনের পশু, সেটাই বুঝিয়ে দিয়ে গেলো 'শেরনি।'

স্ক্রিপ্ট টা টানটান ছিলো। মাঝেমধ্যে যে গতি সামান্য শ্লথ হয়নি, তা বলবো না। তবে সবমিলিয়ে উতরে গিয়েছে পুরোটাই। যারা অভিনয় করেছেন, তারাও দুঁদে সব কুশীলব। বিদ্যা বালান, নিরাজ কবি, ব্রীজেন্দ্র কালা, মুকুল চাড্ডা, শরত সাক্সেনা...এরা প্রত্যেকেই অসাধারণ অভিনয় করেন। তারা পরীক্ষিত যোদ্ধা। বরাবরের মতন তাই এ সিনেমাতেও তাদের অভিনয়ের খামতি পাই নি। সিনেম্যাটোগ্রাফীও দুর্দান্ত। ঝিঁঝিঁর ডাক, পেঁজা তুলোর মেঘ, শুকনো পাতা ভেঙ্গে ডোরাকাটা বাঘের মন্থর সঞ্চারণ, ইতস্তত পাখির বিব্রত ওড়াউড়ি...সবগুলো ফ্রেম বাঁধাই করে তুলে রাখার মতন যেন। গাঢ় অরণ্যের উজ্বল  সবুজের মধ্যে ডুবে যাওয়ার উপক্রমই হয়েছে এ সিনেমা দেখতে দেখতে। 

স্ক্রিনটাইম অল্প থাকলেও দারুণ অভিনয় করেছেন নিরাজ কবি! 

তবে সবচেয়ে বেশি মনে ধরেছে, সিনেমার ন্যারেশন স্টাইল। 'শেরনি'তে অনেকগুলো সমস্যাকে দেখানো হয়েছে একসাথে। কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গবৈষম্য, আপোষকামি প্রশাসন, স্থানীয় রাজনীতির দৌরাত্ম্য, ভোটের জন্যে বনের বাঘ আর মানুষের লাশ নিয়ে রাজনীতি... খুব দুর্দান্ত কিছু প্রসঙ্গ টেনে এনেও পরিচালক নিজের কোনো মতামত দিয়ে যান নি এখানে। তিনি শুধু এটাই বলে গিয়েছেন, এগুলো সমস্যা। এই সমস্যাগুলো তোমার দেখা উচিত। তিনি কোনো সমাধানের পথে হাঁটেননি, বা, হাঁটার চেষ্টাও করেননি। সাদা-কালোর মাঝখানের ধূসর অঞ্চলে দাঁড়িয়ে তিনি শুধু এক গল্পই বলে গিয়েছেন। এই বিষয়টিই এই গল্পকে বা সিনেমাকে করেছে আরো দশটা নির্মাণ থেকে একেবারে আলাদা। 

শরত সাক্সেনা'র অভিনয় আলাদা করে নজর কেড়েছে! 

'শেরনি'তে তাই প্রচণ্ড উত্তেজনায় হাততালি দেয়ার মতন কোনো উপাদান নেই। অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর মত কোনো বজ্রকন্ঠও নেই। এ সিনেমায় আছে কিছু মানুষ। যে মানুষেরা অতিরঞ্জিত ফিকশনাল চরিত্র না। এই মানুষদের মধ্যে কেউ শোষক। কেউ শোষিত। প্রচণ্ড বাস্তব তাদের গল্প, আক্ষেপ, বিক্ষোভ। এই মানুষগুলোর সাথে মিলেমিশে  আছে এক বিস্তীর্ণ উদার অরণ্য ও সেই অরণ্যের কিছু অধিবাসী। এতসব উপকরণের মিশেলে যে ছিমছাম গল্প, সেটিই 'শেরনি।' 

অমিত মাসুরকার 'শেরনি'র ন্যারেশন স্টাইলে দিয়েছেন নতুনত্ব! 

এই বিচিত্র, বিস্তৃত অনুষঙ্গদের ঐকতানের নিষ্পৃহ, নিরাবেগ, নিরুত্তাপ গল্পই বলতে চেয়েছেন পরিচালক। যেখানে তিনি দারুণভাবে সফলও। 'শেরনি' তাই প্রাসঙ্গিক। আজকেও। আজ থেকে বিশ বছর পরেও।

কৃতজ্ঞতা রইলো পরিচালক ও গোটা টিমের জন্যে।  


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা