শর্মিলা ঠাকুর: যে রত্নকে আবিস্কার করেছিল সত্যজিৎ রায়ের জহুরী চোখ
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
তেরো বছরের এক কিশোরীকে 'অপুর সংসার' সিনেমায় অপর্ণা হিসেবে উপস্থাপন করেছিলেন সত্যজিৎ রায়। এরপর সেই মেয়েটাকেই তিনি নিয়েছেন দেবী, নায়ক, অরণ্যের দিনরাত্রি এবং সীমাবদ্ধ- সিনেমায়, জন্ম দিয়েছেন শর্মিলা ঠাকুর নামের এক তুখোড় অভিনেত্রীর!
ভারতীয় চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি ব্যক্তিত্ব সত্যজিৎ রায়। তাকে নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নাই, তবে তার হাত ধরেই ভারতীয় চলচ্চিত্রে আরেকজন কিংবদন্তির আগমন ঘটেছিলো। তিনি এভারগ্রীন শর্মিলা ঠাকুর। বাংলা এবং হিন্দি সিনেমায় তার নন্দিত এবং দক্ষ অভিনয় তাকে অভিনেত্রী হিসেবে একটি তারকাখচিত স্বতন্ত্র জায়গা করে দিয়েছে। যে তারাটি এখনো জ্বলছে তার নিজস্ব স্বকীয়তায়।
বিশ্বখ্যাত নির্মাতা সত্যজিৎ রায়ের নির্দেশনায় পাঁচটা সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন এই শর্মিলা ঠাকুর। শুরুটা অপুর সংসার দিয়ে তারপর দেবী, নায়ক, অরণ্যের দিনরাত্রি এবং সীমাবদ্ধ সিনেমায় সর্বশেষ এই পরিচালক-নায়িকা জুটিকে দেখা গিয়েছিলো।
শর্মিলা ঠাকুর নিজেই জানিয়েছিলেন, যখন মানিক'দা (সত্যজিৎ রায়) ‘অপুর সংসার’-এর কাস্টিং করছিলেন তখন আমি মাত্র ১৩ বছরের। আমার মনে আছে উনি আমাদের বাড়ি এসেছিলেন আমার সঙ্গে কথা বলতে। আমার বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলতে। উনার স্ত্রী বিজয়া আমাকে একটি শাড়ি পরিয়ে, চুলে খোঁপা বেধে, কপালে টিপ পরিয়ে দিয়েছিল। সেদিনের ছবিটা এখনও আমার কাছে আছে। আর সেদিনের সেই দেখাতেই আমাকে চূড়ান্ত করা হয়। তারপরের গল্পটা তো আমাদের সবার জানা।
স্টেশনের পাশেই কলকাতায় নতুন বৌকে নিয়ে অপুর সংসার জীবনে দারিদ্র্য এবং সাধ ও সামর্থ্যর যে টানাপোড়েন তা বুঝতে পেরে নতুন বৌ হয়েও শর্মিলা ঠাকুরের একটি সংলাপ আজো যেকোনো বাঙালি যুবকের বুকে ঝড় তুলতে সক্ষম। স্বামীকে একটু বেশি সময় কাছে পাবার জন্য লাজুক ভঙ্গিতে ‘যে টিউশনিটা আছে সেটাও ছেড়ে দাও, তারপর আমার গরীব বর সন্ধ্যের আগেই বাড়ি ফিরে আসবে আর আমার কোনো অনুশোচনা থাকবে না।”
সিকোয়েন্স অনুযায়ী অভিমানী স্বামীর রাগ ভাঙাতে বলা সংলাপটি মুহূর্তেই বাংলা সিনেমার দর্শকদের হৃদয়ে অন্যতম শ্রেষ্ঠ রোম্যান্টিক মুহূর্ত হিসাবে জায়গা করে নিয়েছিল। আর এই সংলাপটি দিয়েই নজর কেড়ে নিয়েছিলেন মাত্র ১৪ বছর বয়সী হরিণী চোখের অপর্ণারূপী শর্মিলা ঠাকুরের সুনিপুণ অভিনয়। যার আবেদন এখনো অটুট।
এক বছরের ব্যাবধানে অপর্ণার পর দয়াময়ী হিসেবে সত্যজিৎ রায়ের সিনেমাতে আবার দেখা যায় শর্মিলা ঠাকুরকে। 'দেবী সিনেমায় প্রধান চরিত্র তিনিই। বড় ভুল হচ্ছে জেনেও প্রতিবাদ করতে না পারার কষ্ট শর্মিলা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন তার চোখ আর অভিব্যক্তির মধ্য দিয়ে। গলায় মালা পরে অসহায় মুখে ঠাকুরের আসনে বসে থাকা দেবী হয়ে তিনি এখনো অমলিন।
আবার মহানায়ক উত্তম কুমারের সাথে আইকনিক ‘নায়ক’ সিনেমায় আধুনিক এক শিক্ষিত এবং স্মার্ট নারী অদিতি রূপেও তিনি ছিলেন অসাধারণ। কমার্শিয়াল ফিল্ম দেখেন না, একজন সুপারস্টারের সামনেও নিজের সম্মানবোধকে অটুট রেখে সত্যি কথা বলেন। একজন সাংবাদিক যিনি নিজের সততা রেখেই কাজ করেন এমন একটি চরিত্রে পারফেক্ট কাস্টিং ছিলেন শর্মিলা ঠাকুর।
‘অরণ্যের দিনরাত্রি' সিনেমার মাধ্যমে ১৯৬৯ সালে আবারো অপর্ণা হয়েই সত্যজিৎ রায়ের সিনেমায় ফিরে আসেন শর্মিলা ঠাকুর। তবে ‘অপুর সংসার’ এর সেই কিশোরী বউয়ের অপর্ণার থেকে এই অপর্ণা একেবারেই আলাদ। চাল-চলন, কথাবার্তা, চোখের চাহনী সবকিছুতেই যেনো নতুন এক নারী চরিত্র। বুদ্ধিদীপ্ত, শিক্ষিত, সফিস্টিকেটেড চরিত্রটিকে সেই সময়ে দাঁড়িয়ে ভালোবাসতে বাধ্য করেছিলো মননশীল দর্শকদের।
এরপর ‘সীমাবদ্ধ’ সিনেমার সুদর্শনা রূপেও মন জয় করেন শর্মিলা ঠাকুর। সত্যজিৎ রায়ের সিনেমায় নারীরা একটি শক্তিশালী বিশেষ ভূমিকা রেখেছে বরাবরই। সুদর্শনা ওরফে টুটুল চরিত্রে শর্মিলা ছাড়া অন্য কাউকে ভাবা যায়না এখনো। স্পষ্টবাদী এবং হার না মানা এক চরিত্র, যে প্রতি মুহূর্তে তথাকথিত সভ্য সমাজ এবং এর নানা নিয়ম-কানুনকে প্রশ্নচিহ্নের মুখে দাঁড় করায় খুব সহজেই আবার শ্যামলেন্দুর সীমাবদ্ধ জীবনে এই নারীই একটা সময় বিবেকের ভূমিকায় আবিভূর্ত হয় যা দর্শকদের নতুন করে জীবন, কর্ম, সততা নিয়ে নতুন করে ভাবতে শেখায়।
খেয়াল করলে লক্ষ্য করা যায় যে, সেই সময় প্রতিষ্ঠিত শিল্পীদের নিয়ে কাজ কম করে সত্যজিৎ রায় নতুন মুখ নিয়ে আসতেন তার সিনেমা গুলোতে। অবাক করার মতো বিষয় হলো তার সিনেমার গল্প, চরিত্র অনুযায়ী, শিল্পীদের যেভাবে ভেঙে-গড়ে নিতেন তাতে সিনেমা রিলিজের পর সেই চরিত্রে সেই অভিনেতা অভিনেত্রী ছাড়া অন্য কাউকে ভাবা যেতোনা এমনকি এখনো যায়না। গল্প বলার ধরন বা নির্মানের মুন্সিয়ানা বোধহয় একেই বলে!
সত্যজিৎ রায় সবসময়ই চাইতেন সেটে একজন অভিনেতা বা অভিনেত্রী নয় বরং যে চরিত্রটিতে যে অভিনয় করছেন সে সেভাবেই থাকবে তাহলে কাজের সময়ই চারপাশের মানুষের মনে এই চরিত্র একটা ছাপ ফেলবে যার কারনে ওই শিল্পীও তার চরিত্রে আরো বেশি মনোনিবেশ করতে সক্ষম হবে।
শর্মিলা ঠাকুর নিজেই একটি আলাপচারিতায় বলেছেন যে, ‘দেবী’র সেটে কারও অনুমতি ছিল না আমার সঙ্গে কথা বলার। ভারি ফুলের মালা, ধুপের সামনে বসে থাকার কারণে ‘সত্যিকারের দেবী’ মনে করে একবার এক জুনিয়ার আর্টিস্ট আমাকে প্রণামও করেছিলেন! আর সিনেমা মুক্তির পর মাত্র ১৫ বছরের শর্মিলা ঠাকুরকে দেবী বলে মানতে কষ্ট হয়নি দর্শকদের।
সত্যজিৎ রায়ের সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতা শেয়ার করার সময় শর্মিলা ঠাকুর আরো জানান, যখন আমরা একসঙ্গে কাজ করা শুরু করি মানিকদা চাইতেন আমরা স্ক্রিপ্ট পড়ব, কিন্তু তা মুখস্থ করব না। সেটে কখনও সব অভিনেতাদের একসঙ্গে শট বোঝাতেন না, যদি না তা অনেকগুলো চরিত্রের শ্যুট একসঙ্গে হয়, ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’-র মেমোরি গেমের মতো। না হলে, সরাসরি আমাদের কাছে আসতেন, একটু ঝুঁকে পড়ে মুখোমুখি কথা বলতেন। একটা একটা করে শট বুঝিয়ে দিতেন। এবং শট ওকে হলেই ‘এক্সসিলেন্ট শট’ বলে যে মনোবল আরো বাড়িয়ে দিতেন মানিকদা তা বলে বোঝানো যাবেনা।
নারী চরিত্রের নানা দিকগুলি সূক্ষ্মভাবে সেলুলয়েডে ফুটিয়ে তুলেছেন সত্যজিৎ রায়। তার একাধিক সিনেমার মধ্যমণিও সেই নারী চরিত্রগুলো। নারীর জীবনের ওঠাপড়া, অন্তর্দ্বন্দ্ব, চাওয়া-পাওয়া ফুটে উঠেছিলো নান্দনিকভাবে। আর এই যাত্রায় সত্যজিৎ রায়ের পাশে যে কয়জন নারী নিজেদের সৌন্দর্য্য, মেধা এবং শক্তিশালী অভিনয় দক্ষতা নিয়ে সাহস যুগিয়েছেন তাদের মধ্যে অন্যতম একটি নাম যে শর্মিলা ঠাকুর তাতে কোনো সন্দেহ নাই।