পর্দায়  বহু বছর ধরে রাজত্ব করে আসা কিংবদন্তি শিল্পী ঋষি কাপুরের বিদায়টা যেন 'শর্মাজি নামকিন' সিনেমার সুবাদেই হয়ে রইলো অক্ষয় মিঠেকড়া গল্প! যে গল্পে মুগ্ধ হলাম। ভাবলাম। হালকা ভিজলো চোখও। সে সঙ্গে, বোধের প্রাচীরেও হলো গভীর কিছু ক্ষত। এবং, ঠিক এভাবেই, এক নির্মাণে 'সব পেয়েছি'র তৃপ্তিই দিয়ে শেষে এসে পর্দা নামালো বিশেষ এ নির্মাণ...

বাবার যখন কেমোথেরাপি চলছিলো, আমি বাবার সাথেই ছিলাম। একেবারে কাছে ছিলাম। বাবা তখন মাঝেমধ্যেই বলতো- একটু সুস্থ হয়ে নিই। সুস্থ হয়ে প্রথমেই একটা ভালো চাইনিজ মিল আর চার বোতল হুইস্কি খাবো। এরপর 'শর্মাজি নামকিন' এর শুটিং এ ফিরবো আবার। কাজ ছাড়া একটুও ভালো লাগছে না। 

বাবা ঋষি কাপুরকে নিয়ে স্মৃতিচারণে কথাগুলো বলছিলেন রনবীর কাপুর। খানিকটা আক্ষেপও ছিলো কন্ঠে। কারণ- এরপর আর ঋষি কাপুরের অভিনয়ে ফেরা হয়নি। চাইনিজ মিলে উদরপূর্তি করে 'শর্মাজী নামকিন' এর সেটেও ফেরা হয়নি। 'ললাটের লিখন না যায় খণ্ডন' বাক্যকে একপ্রস্থ প্রমাণ করে তিনি থিতু হয়েছেন নক্ষত্রমণ্ডলীর মাঝেই! ঋষি কাপুরের প্রয়াণের পরে সিনেমার কাজও বন্ধ ছিলো প্রায় দুই বছর। তাঁর বিকল্প হিসেবেও ভাবা হয়েছিলো অনেককিছু। রনবীর কাপুর'কে প্রস্থেটিক মেকআপ দিয়ে অভিনয় করানোর চিন্তাভাবনা হয়েছে। ভিএফএক্স ব্যবহার করারও কথাবার্তা চলেছে। কিন্তু শেষমেশ কিছুই ব্যাটেবলে মেলেনি।

নির্মাতা হিতেশ ভাটিয়া ও এই সিনেমার প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান 'এক্সেল এন্টারটেইনমেন্ট' শেষপর্যায়ে এও ভেবেছিলেন- এই সিনেমা নিয়ে আর না এগোনোই ভালো। কারণ 'শর্মাজী' চরিত্রে ঋষি কাপুরের যে অনন্যসাধারণ অভিনয়, তা আর অন্য কাউকে দিয়ে বের করা সম্ভব না। কিন্তু আচমকাই 'পরেশ রাওয়াল' এর নাম প্রস্তাব করলেন কেউ একজন। পরেশ রাওয়ালকে প্রস্তাবও দেয়া হলো। তিনিও একবাক্যে রাজি হলেন। এরপর যা হলো, তা বলিউডে কেন, ওয়ার্ল্ড সিনেমাতেই হয়েছে খুব কম। এক চরিত্রে দু'জন ভিন্ন ভিন্ন মানুষ অভিনয় করলেন। অথচ, তাদের অভিনয় এতটাই অতুলনীয় হলো, কেউ বিন্দুমাত্র প্রশ্ন তোলার সুযোগ পেলো না। এবং বলাই বাহুল্য, সুযোগ রইলো না 'শর্মাজী নামকিন' নিয়েও প্রশ্ন তোলারও! মুগ্ধতা বাদে বলার রইলো না মূলত কিছুই!

সাধারণত কিংবদন্তি কেউ যখন মারা যান, এবং তার শেষ সিনেমা যখন মুক্তি পায় মৃত্যুর পরে, তখন সে সিনেমার 'আর্টিস্টিক এলিমেন্টস' এর চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায় প্রয়াত মানুষটি। দর্শকের মস্তিষ্কে ক্রমাগতই বাজতে থাকে 'এই দেখা শেষ দেখা'র সুর; ফলে যা হয়, সিনেমার যাবতীয় দোষত্রুটি উপেক্ষিত হয় একবাক্যে। শেষমেশ, পুরো সিনেমাটিই রূপান্তরিত হয়ে যায় 'ফেয়ারওয়েল' এর টুকরো নিদর্শনে। এবং ঠিক এখানে এসেই আলাদা তাৎপর্য পাই 'শর্মাজী নামকিন' এ। এই সিনেমার ফান এলিমেন্টস, ক্রাইসিস কিংবা সাসপেন্স এতটাই নিখুঁত, 'ঋষি কাপুর'জনিত যাবতীয় আবেগকে সরিয়ে রেখেও বিস্মিত হবার সুযোগ কমেনা মোটেও। টিপিক্যাল স্টেরিওটাইপ ফর্মুলার একঘেয়ে চর্বিতচর্বনে ত্যক্ত হয়ে প্রশ্নবাণে নিয়মিতই বিদ্ধ করি যে বলিউডকে, সে বলিউডেই  'শর্মাজী নামকিন' এর মত সিনেমা আচমকা এমনভাবে আসে, যারপরনাই চমকাতে হয়। টু শব্দ করার জায়গাটি টুঁটি চেপে বন্ধ করে যাবজ্জীবন স্তব্ধ করার কাজটিই যেন করে সিনেমার ডাকিনীবিদ্যা! 

'শর্মাজী নামকিন' শুরু হয় 'শর্মাজি' নামক ষাটোর্ধ্ব এক ব্যক্তির গল্প দিয়ে, দীর্ঘজীবন চাকরী সেরে যিনি অবসরগ্রহণ করেছেন সম্প্রতি। বলা হয়ে থাকে, 'মৃত্যু'র আগে দ্বিতীয় মৃত্যু হয় অবসরে, এবং  'রিটায়ারমেন্ট' নামক এই মৃত্যুদণ্ড শর্মাজী'র যে মোটেও পছন্দ হচ্ছে না, সিনেমার প্রথমাংশেই পরিষ্কার হয় তা। স্ত্রী'র মৃত্যু হয়েছে আগেই। দুই ছেলের বড়জন কর্পোরেট চাকরি নিয়ে ব্যস্ত। ছোট ছেলে ব্যস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুবান্ধব নিয়ে। এদিকে পুরো ঘরে একলামাত্র প্রাণী শর্মাজীর উঠতে থাকে নাভিশ্বাস৷ ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপে সারাদিন থেকে, আত্মীয়স্বজনদের সাথে মোবাইলে যোগাযোগ রাখার একঘেয়ে প্রক্রিয়ায় তার প্রাণ হয় ওষ্ঠাগতও। এবং ঠিক এরকম এক সময়েই, 'অবসর' নামক সিন্দাবাদের ভূতের হাত থেকে রেহাই পেতে তিনি শুরু করেন রান্নাবান্না। 

যারা 'ঋষি কাপুর'কে নিয়ে ছিঁটেফোঁটাও জানেন, তাদের জানার কথা- ঋষি কাপুর প্রচণ্ড ভোজনরসিক এক মানুষ। ক্যান্সারের ট্রিটমেন্টের জন্যে যখন তিনি লন্ডনে, ছেলের সাথে প্রায় প্রতিদিনই যখন হাজিরা দিতে হচ্ছে ডাক্তারের কাছে, তখনও প্রতিদিনই হাসপাতালে যাওয়ার পথে ছেলের সাথে তিনি নানারকমের খাবার গল্প বলতেন। চাইনিজ খাবার খাওয়ার উপর ডাক্তারদের বিধিনিষেধ ছিলো। ডাক্তারদের সাথে ঝগড়া করে, তাদেরকে বিতর্কে কাবু করে 'চাইনিজ খাবার' খাওয়ার পারমিশনও আদায় করেছিলেন তিনি৷ যখন সুস্থ থাকতেন, তখন প্রায়ই সবাইকে নিয়ে চলে যেতেন খেতে। খাবার পছন্দ হলে, সেই রান্না যে করেছে, তাকে ডেকে এনে প্রশংসাও করতেন মুক্তকন্ঠে! 

সেই খাদ্যপ্রেমী মানুষ 'শর্মাজী' হয়ে নানারকম রান্নাবান্না করছেন, রান্নার সাথে দিনানিপাত করছেন, সেটা দেখা মূলত একরকম চোখের শান্তিও। অবশ্য এখানে খানিকটা সতর্কতাও আছে। যারা খানিকটা ফুডি, যাদের খাবার দেখলেই খিদে পায়, তারা 'শর্মাজী নামকিন' দেখার সময়ে কিছু খাবার নিয়ে বসলেই মঙ্গল। কারণ, এ সিনেমায় 'খাবার' এর এতটাই ভূমিকা, এবং খাবারের দৃশ্যগুলো এতটাই পৌনঃপুনিক, ক্ষিদে পাবেই নির্ঘাত! 'উস্তাদ হোটেল' কিংবা 'শেফ' দেখলে যেমন খিদে চাগাড় দিয়ে ওঠে, ঠিক সেটা হওয়ার সম্ভাবনা এখানেও। এবং এই খাবারগুলো 'শর্মাজী' যখন বানাচ্ছেন, তখন তার চোখেমুখে শিশুর মত যে আগ্রহ এবং সেই খাবার খেয়ে যখন সবাই প্রশংসা করছেন, তখন পুরো অবয়বে যে তৃপ্তি... ঋষি কাপুর শেষবারের মত পর্দায় এসে বিদায়ের প্রতিটি ক্ষণে যেন স্মরণীয় অভিনয়েরই ঝাঁপি খুলে বসেছিলেন! 

শর্মাজী, ওরফে ঋষি কাপুর; মুগ্ধ করলেন ক্ষণেক্ষণে! 

ভয় পাচ্ছিলাম, এক 'শর্মাজী' চরিত্রে দু'জন মানুষকে দেখার অভিজ্ঞতা মস্তিষ্কে আসলে কতটুকু চাপ দেবে! যদিও পরেশ রাওয়াল যা করলেন, তা ঋষি কাপুরের অনুকরণ না মোটেও, কিন্তু খুবই সাবলীল। যখন কোনো 'চরিত্র'কে দুর্দান্তভাবে লেখা হয়, তখন সে চরিত্রে কে অভিনয় করছে, তা যে গৌণ হয়ে যায়, সেটাই যেন স্পষ্টভাবে প্রমানিত হলো এখানে। যদিও ঋষি কাপুরের 'সারল্যমাখা' শর্মাজী ব্যক্তিগতভাবে একটু বেশিই প্রিয় থাকবে, কিন্তু 'পরেশ রাওয়াল' যা করলেন, তা এতটা সাবলীলভাবে করা অনেকের পক্ষেই যে সম্ভব হতোনা, তাও হলফ করে বলা যায়। 'ইশ! এই জায়গায় ঋষি কাপুর করলে বোধহয় আরেকটু ভালো হতো' এই আক্ষেপের বিন্দুমাত্র সুযোগ না দিয়েই যে অভিনয় এ গুণী অভিনেতার, তা মুগ্ধ করলো ক্ষণেক্ষণেই। 

পাশাপাশি, অন্য চরিত্রেরাও কি দাগ কাটলোনা? কাটলো। 'মিসেস মানছন্দা' চরিত্রে জুহি চাওলা যতক্ষণ রইলেন পর্দায়, নাইন্টিজের সে উত্তাল জুহিকেই মনে করালেন। আশ্চর্য স্নিগ্ধতা রইলো তাঁর অভিনয়েও। এবং শর্মাজি'র সাথে তাঁর যে রসায়ন... জীবনের নানা বাঁকে পোড় খেয়ে আসা দু'জন মানুষের মিথস্ক্রিয়া এরচেয়ে ভালোভাবে দেখানো যেতে পারতো? বোধহয় না। শর্মাজির দুষ্টু বন্ধু চাড্ডা, কিটি পার্টির নারীসংঘ, মেয়র রবি... তাদের উপস্থিতি হয়তো কম সময়ের জন্যে, কিন্তু গল্পের পাজলে তাদের ভূমিকাও যে নেহায়েত ফেলনা না, সেটাও বেশ ইতিবাচক লাগলো। বিশেষ করে 'কিটি পার্টি'র কথা একটু আলাদাভাবেই আসে। 'কিটি পার্টি' মানেই আমরা ধরে নিই- পরনিন্দা পরচর্চা, অর্থহীন আড্ডা আর শাড়ি-গয়নার ময়নাতদন্ত। ইচ্ছের রকমফের এবং পুরুষতান্ত্রিক সমাজে হাপিত্যেশ করা নারীদের দীর্ঘশ্বাসেও যে এ আয়োজন ভারী হয় সময়ে সময়ে, গল্পে সেটাকে প্রাধাণ্য দেওয়াটাও বেশ প্রাসঙ্গিক লাগলো। 

দুই শর্মাজি! 

'শর্মাজী নামকিন' এর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক- ক্রমশ বড় হয়ে যাওয়া সন্তানদের সাথে ক্রমশ বুড়ো হয়ে যাওয়া বাবার মিথস্ক্রিয়া। 'লোকে কি বলবে' ন্যারেটিভের প্রতিনিধি ছেলে আর 'এখন বয়স ইচ্ছে-স্বাধীন চলা'র প্রতিনিধি বাবার মধ্যে যে চাপা অসন্তোষ, থমথমে দ্বৈরথ... তা এখানেও এসেছে। ছেলে পুরোনো বাড়ি ছাড়তে চায় আর বাবার ইচ্ছে আদি নিবাসেই শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করার, কেউ নতুনকে আঁকড়ে ধরতে চাইছে, আর কাউকে হয়তো পুরোনোই আগলে রেখেছে বহুকাল ধরে... ছেলে-বাবার এ দ্বন্দ্ব হয়তো সময়ে সময়ে বেড়েছে, কিন্তু কোথাও গিয়ে 'বাবা-ছেলে'র ভালোবাসাকে ছাপিয়ে যেতে পারেনি মোটেও। ছেলের ব্যবহারে আমরা হয়তো উশখুশ করছি, কিন্তু বাবার কাছে যখনই সে ফিরে আসছে, তখন আবার খুশিও হচ্ছি। ছেলেদের সাথে বাবার মিথস্ক্রিয়ার এই টুকরো টুকরো দৃশ্যগুলো দারুণ। হৃদয়ে বিদ্ধ হওয়ার মত। 

মুগ্ধ করলেন জুহি চাওলাও! 

এসবের পাশাপাশি, মুগ্ধতা থাকে গল্পবয়ানেও। ঋষি কাপুরের শেষ সিনেমা, গল্পেও টানাপোড়েনের উপাদান আছে বিস্তর... চাইলে ছটাকখানেক আবেগ দেয়া যেতেই পারতো এখানে। কিন্তু 'শর্মাজী' যেখানে জীবনকে নেড়েচেড়ে দেখার মানুষ, 'শর্মাজি' চরিত্রে অভিনয় করা ঋষি কাপুর যেখানে 'প্রতি মুহুর্তকে উপভোগ করা'র মানুষ, সেখানে সিনেমায় কেন বিষাদের তানপুরা বাজবে? এবং স্বস্তির বিষয়, বাজেওনি। মন ভালো করে দেয়ার একেকটা ঘটনা, দৃশ্যপট, সিচুয়েশনাল কমেডি, স্যাটায়ার, হিউমার ও সোশ্যাল নানা ডগমাটিজমকে সাটল ওয়েতে ব্লেন্ড করে এগোনো গল্পে মন খারাপ হওয়ার জায়গা নেই লেশমাত্রও। এবং এ সিনেমা শেষ করলে 'ঠোঁটের কোণে চিলতে হাসি' আসবেনা, এরকম মানুষও হয়তো খুঁজলে পাওয়া যাবেনা একজনও। 

'শর্মাজী নামকিন' এর পরিচালক হিতেশ ভাটিয়া গিয়েছেন হাসপাতালে, ঋষি কাপুরের সাথে দেখা করতে। ঋষি কাপুর তাকে ফিসফিস করে বললেন- আমার জন্যে একদিন চায়নিজ নিয়ে আসবে? হিতেশ অবাক হয়ে বললেন- ডাক্তার তো বলেছেন, আপনার চায়নিজ খাওয়া মানা! ঋষি কাপুর তখন ঠোঁট ফুলিয়ে বলেছিলেন-

এই বাজে ডাক্তারকেই তোমরা বরং আসতে মানা করে দাও! যে ডাক্তার চায়নিজ খেতে দেয় না, ও আবার কিসের ডাক্তার? 

জীবনকে এরকম 'ছেলেমানুষি দৃষ্টি'তে দেখতেন যে মানুষটি, তার শেষ সিনেমায় যে সেই ছেলেমানুষির টুকরো টুকরো নিদর্শন পাবো, জানা ছিলো। ঋষি কাপুরের সেকেন্ড ইনিংসের সিনেমাগুলো অর্থাৎ- 'কাপুর অ্যাণ্ড সনস', 'মুলক' কিংবা '১০২ নট আউট' এ যে তার অভিনয়, তাতে জানতাম- এ সিনেমায়ও তিনি দুর্দান্ত অভিনয়ই করবেন৷ করলেনও। কিন্তু পুরো সিনেমা যে এতটাই অনবদ্য হবে, এতটাই চমকের অনুষঙ্গ থাকবে এ নির্মাণে,  জানা ছিলোনা মূলত সেটিই। এবং ঠিক এভাবেই, কিংবদন্তি শিল্পী ঋষি কাপুরের শেষবিদায় এই 'শর্মাজী নামকিন' এর সুবাদেই যেন হয়ে রইলো অক্ষয় মিঠেকড়া গল্প! যে গল্পে মুগ্ধ হলাম। ভাবলাম। হালকা ভিজলো চোখও। সে সঙ্গে, বোধের প্রাচীরেও হলো গভীর কিছু ক্ষত। এবং এক নির্মাণে 'সব পেয়েছি'র তৃপ্তি দিয়ে এভাবেই শেষে এসে পর্দা নামালো 'শর্মাজী নামকিন।' 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা