চার্লি চ্যাপলিনের পর তিনিই একমাত্র সিনেমা নির্মাতা, যাকে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি দিয়েছে। ঠিক এখন না, এই সময়ে এসেও এতটা না...

তানভীর মেহেদী:

আমাদের দেশের ডিরেক্টররা সত্যজিৎ রায়কে কীভাবে দেখেন, তাঁর কাজকে কীভাবে এক্সপ্লেইন করেন, সত্যজিৎ রায়কে কীভাবে ধারণ করেন সেটা জানার প্রতি আমার অত্যন্ত আগ্রহ। বেশ কিছু দিন আগে মোস্তফা সরওয়ার ফারুকীর একটা ইন্টারভিউ পড়েছিলাম, সেখানে তাকে সত্যজিৎ রায়ের সিনেমা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি জানালেন, তার প্রিয় সিনেমা "কাঞ্চনজঙ্ঘা"। ডিরেক্টর আদনান আল রাজীরের এক ইন্টারভিউতে তিনি জানালেন, সত্যজিৎ সৃষ্টির মধ্যে তার প্রিয় সিনেমাও "কাঞ্চনজঙ্ঘা"। ইভেন সত্যজিৎ রায়েরও সবচেয়ে প্রিয় কাজ ছিল "কাঞ্চনজঙ্ঘা"। এটা ছিল তার নিজের লেখা প্রথম মৌলিক স্ক্রিপ্ট।

সত্যজিৎ রায়ের সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন সিনেমা "কাঞ্চনজঙ্ঘা"। এই সিনেমায় একটা বিকেলের মধ্য দিয়ে তিনি সমাজের দুই স্তরের মানুষের জীবন দেখিয়েছেন। পুরো সিনেমায় কোনো অতিরিক্ত ডায়ালগ নেই। ইভেন খুব কম ডায়ালগের এ সিনেমায় তিনি আশেপাশের ডিটেল দেখিয়েছেন, যে ডিটেলের পেছনে তিনি ক্যামেরা হাতে ছুটেছেন সারাজীবন। যে কোনো ঘটনার, গল্পের ডিটেল তিনি দেখাতে চেয়েছেন। জীবনভর ক্যামেরায় আশেপাশের ডিটেল খুঁজেছেন। তার হাতের ছোঁয়ায় বিশুদ্ধ হয়েছে রিলের পর রিল, মুগ্ধ হয়েছে দর্শক। এজন্যই চার্লি চ্যাপলিনের পর তিনিই একমাত্র সিনেমা নির্মাতা, যাকে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি দিয়েছে। ঠিক এখন না, এই সময়ে এসেও এতটা না।

সিনেমা বানানো শুরু করার সাথে সাথেই তিনি পেয়েছিলেন ক্ষ্যাতি। পেয়েছিলেন সমসাময়িক সিনেমা নির্মাতাদের শ্রদ্ধা। ১৯৮৫ সালে কলকাতায় এক চলচিত্র প্রশিক্ষণ কোর্সে যোগ দিতে গিয়ে সত্যজিৎ রায়ের সাথে দেখা করেন চলচিত্রকার তারেক মাসুদ। তার কাছে বাংলাদেশের হালচাল জানতে চান সত্যজিৎ রায়। বাংলাদেশের নাটক- সিনেমার খবর নিতে গিয়ে তিনি জানান, মুস্তাফা মনোয়ারের বানানো "রক্তকরবী" নাটক তিনি দেখেছেন, অসাধারণ নাটক। দেশে ফিরে মুস্তাফা মনোয়ারকে এই ঘটনা জানালেন তারেক মাসুদ। মুস্তাফা মনোয়ার তার স্ত্রীকে ডেকে বললেন, "এই শুনেছ, আমার তো নোবেল পাওয়া হয়ে গেছে।"

আবার আমাদের অনেক ডিরেক্টরদের কোথাও আটকে গেলে সত্যজিৎ রায়কে টেনে আনার একটা খারাপ অভ্যাস আছে। সত্যজিৎ রায়কে তখন তারা ট্রাম কার্ড হিসেবে ব্যবহার করেন। অনিমেষ আইচের "ভয়ংকর সুন্দর" সিনেমা নিয়ে এত এত সমালোচনা আর ফেসবুকে নেগেটিভ রিউভি এর ব্যাপারে নিজের অবস্থান জানাতে তিনি একদিন লাইভে এসেছিলেন। তার মত করে কিছুটা আবেগ মিশিয়ে ইমোশনাল হয়ে কথা বলেছেন সেখানে। সত্যজিৎ রায়ের অমুক সিনেমার অমন একটা দৃশ্য দর্শক নিয়েছে কিন্তু তার সিনেমার এমন একটা দৃশ্য দর্শক কেন নিলো না এটা নিয়ে একটু রাগী ভাষায় আক্ষেপ দেখালেন। সত্যজিৎ রায়ের জায়গাটা আলাদা। তার কাজের প্রতি আমাদের দর্শকদের ভালোবাসা অন্য লেভেলের। তার সাথে কম্পেয়ার করে নিজেকে ছোট করার যে চেষ্টা অনিমেষ আইচ করেছেন সেটা একসেপ্ট করার মত না।

ইতালিয়ান সিনেমার মহাকাব্য "বাইসেল থিফ"( Ladri di biciclette) দেখে ইন্সপিয়ারড হয়ে মিস্টার রয় সিনেমা বানানো শুরু করলেন। পথের পাঁচালিতে বারবার বাজেট নিয়ে টানাটানিতে পড়ে, নিজেও চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছিলেন। এরপর এগিয়ে এসেছিলো পশ্চিমবঙ্গ সরকার। সরকারি টাকায় বানালেন প্রথম সিনেমা। সিনেমার গল্প খুঁজতে তিনি কখনো রবীন্দ্রনাথের কাছে গিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের গল্প মনে মনে সাজিয়ে পর্দায় এঁকেছেন। রবীন্দ্রনাথের "নষ্টনীড়" থেকে তিনি বানালেন "চারুলতা"। তার নিজের মতে "চারুলতা" তার বানানো সবচেয়ে নিখুঁত ছবি। বিভূতিভূষণের উপন্যাস থেকে তিনি বানালেন তার জীবনের শ্রেষ্ঠ তিন ছবি "পথের পাঁচালী", "অপরাজিত" আর "অপুর সংসার"। অপুর সংসার সিনেমায় অপু আর তার স্ত্রী অপর্ণার মধ্যে শরীরের স্পর্শ ছাড়াই যে রোমান্টিসিজম তিনি দেখিয়েছিলেন, গভীর চুম্বন দিয়েও উপমহাদেশের অন্য কোন পরিচালক তেমনটা আর কখনোই দেখাতে পারেন নি। কান চলচিত্র উৎসবের বিচারকরা অবাক হয়ে এসব কথা বলেছিলেন সিনেমাটা দেখার পর।

সিনেমার গল্পের খোঁজে তিনি গিয়েছেন নিজের দাদা উপেন্দ্রকিশোর রায়ের কাছেও। দাদার গল্পে বানিয়েছেন "গুপী গাইন বাঘা বাইন"। তারপর "হীরক রাজার দেশে"। এই উপমহাদেশে হীরক রাজার দেশের মত সিনেমা বানানোর সাহস দেখানোর জন্য ভদ্রলোককে আমি বিশেষ শ্রদ্ধা করি। তার সৃষ্টি করা ফেলুদা আমাদের সেরা গোয়েন্দা চরিত্র। তার বানানো ফেলুদা সিরিজের সিনেমা এরপর তার ছেলে সন্দ্বীপ রায়ের হাতেও আলো ছড়িয়েছে। আমরা সত্যজিৎ রায়ের মধ্যে এক উপেন্দ্রকিশোর রায়কে দেখি, নিজের কাজ অসমাপ্ত রেখে অকালে চলে যাওয়া সুকুমার রায়কে দেখি।

সারাজীবনভর সিনেমাকে এত এত কিছু দেয়া মানুষটাকে জীবনের শেষের দিকে এসে দেয়া হয়েছে একাডেমী অ্যাওয়ার্ড। তবে একটা পজেটিভ দিক হচ্ছে, আজকালকার জেনারেশনে যারা সিনেমা বানাতে আসছেন তারা সত্যজিৎ রায় পড়ে আসছেন। তার কাজ দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে আসছেন। একজন চ্যাম্পিয়ন ডিরেক্টরের এটই তো সফলতা। তার সিনেমা দেখে ছেলেরা সিনেমা বানানো শিখবে। এটাই তো প্রাপ্তি।

মানিক দা, সিনেমাটা আপনার মত করে আর কোন বাঙ্গালীই বানাতে পারে না।


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা