১৯৫০ সালে চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে জন্ম নেয়া কবরী নামের মেয়েটা নিজের গুণে গোটা দেশের মানুষের হৃদয় জয় করেছিল, সিনেমায় নাম লিখিয়ে ভেঙেছিল সংকোচের আগল। নিজেকে ভীষণ একলা মানুষ হিসেবে দাবী করা কবরী আজ একাই পাড়ি জমালেন অন্য কোন ভূবনের পানে...

সারাহ বেগম কবরী- এই একটি নাম বাংলা সিনেমার ইতিহাসে উজ্জ্বল এক নক্ষত্র, সফলতম এক অধ্যায়। ষাট এবং সত্তরের দশকে পর্দা কাঁপিয়েছেন, দাপিয়ে বেড়িয়েছেন দর্শকের মনের আঙিনায়। অভিনেত্রী থেকে পরিচালক হয়েছেন, নির্মাণ করেছেন সিনেমা। রাজপথে প্রগতিশীল আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন, সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেছেন, জনগনের ভোটে জিতে সাংসদ হয়েছেন, নিজ এলাকার জন্য রেখেছেন নিজের বলিষ্ঠ ভূমিকা। সেই মিষ্টি মেয়ে কবরী করোনার সঙ্গে ১৩ দিনের লড়াই শেষে পাড়ি জমালেন না ফেরার দেশে, শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালের আইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে থাকা কবরী আর সুস্থ হয়ে ফিরে আসবেন না কখনও। সত্তর বছরের এই মানুষটার হৃদস্পন্দন থেমে গেছে কিছুক্ষণ আগে। 

খুসখুসে কাশি ও জ্বরে আক্রান্ত হয়ে করোনার নমুনা পরীক্ষায় দিয়েছিলেন সারাহ বেগম কবরী। ৫ এপ্রিল দুপুরে পরীক্ষার ফল হাতে পেলে জানতে পারেন, তিনি করোনা পজিটিভ। ওই রাতেই তাকে ঢাকার কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। শুরুর দিকে চিকিৎসকেরা তাকে পর্যবেক্ষণে রেখেছিলেন, নিয়মিত চিকিৎসাই দেয়া হচ্ছিল কবরীকে। অক্সিজেনের কমতি ছাড়া কোন শারীরিক জটিলতাও ছিল না। 

একটা পর্যায়ে অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাকে আইসিইউতে স্থানান্তরের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়, তখন সাবেক এই অভিনেত্রী ও সাংসদের জন্য আইসিইউ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালে আইসিইউ পাওয়ার পর সেখানে ভর্তি করা হয় তাকে। কিন্তু অবস্থার আরও অবনতি হওয়ায় বৃহস্পতিবার বিকেলে তাকে লাইফ সাপোর্টে নেয়া হয়। সেখান থেকে আর ফিরলেন না তিনি। 

সারাহ বেগম কবরী

১৯৭০ সালে সুভাষ দত্তের 'সুতরাং' সিনেমা দিয়ে রূপালী পর্দায় আগমন ঘটে কবরীর, অল্প সময়েই নিজের অভিনয়গুণে দর্শকপ্রিয়তা পেয়ে যান তিনি। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় সীমান্ত পাড়ি দিয়ে কলকাতায় গিয়ে সেখানে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠন ও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নেন কবরী। নিজের সাধ্য অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধে অবদান রেখেছিলেন এই চিত্রনায়িকা। 

ক্যারিয়ারে অজস্র ব্যবসাসফল ও জনপ্রিয় ছবি তিনি উপহার দিয়েছেন, রাজ্জাক ও ফারুকের সঙ্গে দুর্দান্ত দুটি জুটি গড়েছিলেন তিনি। বাংলাদেশী সিনেমার প্রথম রোমান্টিক জুটি বলতে এখনও লোকে রাজ্জাক-কবরীকে বোঝে। আবার ফারুকের সঙ্গে সুজন সখী, সারেং বউ সিনেমাগুলোও তুমুল জনপ্রিয় হয়েছিল। ঋত্বিক ঘটক তাকে নিয়ে বানিয়েছিলেন তিতাস একটি নদীর নাম সিনেমাটি। অভিনয়ের জন্য পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, মেরিল-প্রথম আলো আজীবন সম্মাননাসহ বহু পুরস্কার ও সম্মাননা।

পঁচাত্তরে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পরে তিনি রাস্তায় নেমে এসে সেই হত্যাকান্ডের বিচার দাবী করেছিলেন, যুক্ত ছিলেন প্রগতিশীল আন্দোলনের সাথে। ২০০৮ সালে নারায়ণগঞ্জ থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। এর আগে ২০০৩ সালেই পরিচালক হিসেবে অভিষেক ঘটিয়ে ফেলেছিলেন, সিনেমার নাম আয়না। সেই সিনেমায় গুরুত্বপূর্ণ একটি চরিত্রে তিনি অভিনয়ও করেছিলেন। 

১৯৫০ সালে চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে জন্ম নেয়া কবরী নামের মেয়েটা নিজের গুণে গোটা দেশের মানুষের হৃদয় জয় করেছিল, সিনেমায় নাম লিখিয়ে ভেঙেছিল সংকোচের আগল। নিজেকে ভীষণ একলা মানুষ হিসেবে দাবী করা কবরী একাই পাড়ি জমালেন অন্য কোন ভূবনের পানে, যেখান থেকে ফিরে আসে না কেউ কখনও। কবরীর এই প্রস্থান দর্শক হিসেবে, সিনেমাপ্রেমী হিসেবে আমাদের জন্য অপূরণীয় এক ক্ষতি।।আরও অনেক কিছুই হয়তো সিনেমাকে দেয়ার ছিল তার, সেগুলো অপূর্ণই থেকে যাবে আজীবন...


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা