সন্ধ্যা মুখার্জী: গানের যে ইন্দ্রধনু বাঙালীর মনেপ্রাণে বেঁচে থাকবেন আজীবন
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছেন, শরণার্থীদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করেছেন। মৃত্যুর অল্প ক'দিন আগে কেন্দ্রীয় সরকারের পদ্মশ্রী সম্মাননা গ্রহণে অসম্মতি জানিয়েছেন শিরদাঁড়া সোজা রেখে। সুচিত্রা সেনের সঙ্গে তার অদ্ভুত একটা জুটি গড়ে উঠেছিল, তারা একে ছিলেন অন্যের পরিপূরক। তাই তো তার শেষকৃত্যে শ্রদ্ধা জানাতে এসে সুচিত্রা কন্যা বলেছিলেন- ‘আজ সন্ধ্যা মাসীর সাথে মায়ের কন্ঠটাও চলে গেল...’
বৃটিশ শাসনামলে কলকাতার ঢাকুরিয়ায় ১৯৩১ সালের ৪ঠা অক্টোবর রেল অফিসার নরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় এবং হেমপ্রভা দেবীর ছয় সন্তানের মধ্যে সবচেয়ে ছোট সন্তান হিসেবে জন্ম নেয়া মেয়েটি যে একদিন বাংলার সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং প্রশংসিত গায়িকা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবেন- তা বোধহয় কেউ কল্পনাও করেননি। তবে অকল্পনীয় ঘটনাটিই ঘটে গেল ১২ বছর বয়সে কলকাতা আকাশবাণীর ‘গল্পদাদুর আসর’ নামক একটি জনপ্রিয় প্রোগ্রামে গীতিকার অজয় ভট্টাচার্যের লেখা একটি গানে কন্ঠ দানের মধ্য দিয়ে।
গানের প্রতি ভীষণ ঝোঁক ব্যাপারটা বাবার নজর এড়ায়নি। তিনিই নিয়ে গিয়েছিলেন সংগীত আচার্য যামিনী গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে। তার পর থেকে সন্ধ্যার গান শেখার অধ্যায়ে আশীর্বাদ পেয়েছিলেন বড়ে গোলাম আলী, জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, মুনাওয়ার আলী খানের মতো সংগীতজ্ঞদের। সে বছরই মানে ১৯৪৩ সালে অল বেঙ্গল মিউজিক কনফারেন্স আয়োজিত সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় ভজন বিভাগে প্রথম হয়েছিলেন সন্ধ্যা। গায়িকা হিসেবে এই প্রাপ্তি যেনো তাকে এগিয়ে দিয়েছিলো বেশকিছুটা পথ। পরের বছরেই মানে ১৯৪৫ সালে ১৪ বছর না হতেই গিরিন চক্রবর্তীর কথা এবং সুরে এক দিকে ‘তুমি ফিরায়ে দিয়ে যারে’, উল্টো পিঠে ‘তোমারো আকাশে ঝিলমিল করে চাঁদের আলো’ গানে প্রথম বেসিক রেকর্ড করে জানান দিয়েছিলেন, তিনি আসছেন গানের জগতে।
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশদের ভারত ছেড়ে চলে যাওয়া, দেশভাগ সহ নানা ঘটনায় দুই বাংলা যখন বিভক্ত সেই বছরে ‘অঞ্জনগড়’ সিনেমায় কিংবদন্তি সংগীত পরিচালক রাইচাঁদ বড়ালের হাত ধরে বাংলা সিনেমায় প্রথম প্লেব্যাক গায়িকা হিসেবে নাম লেখান সন্ধ্যা। পরের তিন বছরে বেশকিছু জনপ্রিয় গান গাইলেন বাংলা সিনেমায়। তার কন্ঠ এবং গায়কীর ধরণ দেখে তখন বাংলার গীতিকার এবং সুরকার যারা তৎকালীন বোম্বে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে উপহার দিচ্ছেন কালজয়ী গান; তারা তাকে নিয়ে গেলেন হিন্দি চলচ্চিত্রে গায়িকা হিসেবে কাজ করার জন্য।
১৯৫০ সালে বোম্বাই যাত্রার মধ্য দিয়ে ক্যারিয়ারের অন্য এক সফল অধ্যায়ের শুরু করলেন সন্ধ্যা৷ অনিল বিশ্বাসের সুরে ‘তারানা’ সিনেমায় হিন্দি সিনেমার সবচেয়ে বড় গায়িকা কিংবদন্তি লতা মঙ্গেশকরের সাথে ডুয়েট গাইবার সুযোগ পান ‘বোল পাপিয়া বোল’ শিরোনামের গানে। সেই সময় ব্যাপক জনপ্রিয় হয়েছিলো গানটি। এরপরে বোম্বের ইন্ডাস্ট্রিতে আরো বছর দুই গান গেয়েছেন তিনি। না, বাংলা গান এর মধ্যে গাওয়া হয়নি এমনটা নয়, তবে সেটা সংখ্যায় কম। তবে সন্ধ্যা নিজেই মনে হয় বুঝতে পেরেছিলেন তার ভালোবাসার জায়গা হলো কলকাতা এবং বাংলা গান। তাই ১৯৫২ সালের শেষদিকে কলকাতায় পাকাপাকি ভাবেই ফেরত আসেন তিনি। এরপরে শুরু হয় এক দীর্ঘ সফল অধ্যায়ের, যা সুর এবং গায়কীর জাদুতে আমাদের বুঁদ করে রেখেছে পরবর্তী প্রায় সাত দশক।
তবে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের সাফল্যের জয়যাত্রা আক্ষরিক অর্থে শুরু হয় আরেক কিংবদন্তি মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের সাথে জুটির মধ্য দিয়ে। সেই সময় সুচিত্রা সেনের লিপে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কন্ঠ যেন 'মেড ফর ইচ আদার' এমন একটি মিথ। উত্তম-সুচিত্রা জুটির আবেদন যেমন আমাদের বাঙালীদের কাছে আজো অম্লান তেমনি সুচিত্রা-সন্ধ্যা জুটিও অমর। রেকর্ডিং রুমে একজনের অসাধারণ গায়কী এবং সেলুলয়েডে অন্যজনের অভিনয় সাথে চোখ এবং মুখের এক্সপেশন যেনো সোনায় সোহাগা।
সন্ধ্যার গানের অতুল ঐশ্বর্য আর সুচিত্রার সৌন্দর্য্য এবং অভিনয়ের দক্ষতার অদ্ভুত মিশেলে এক অন্যরকম রসায়ন দর্শকদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছিলো। এখন ভাবলে অবাক লাগে টেকনিক্যাল সুযোগ সুবিধা না থাকলেও একের পর এক কঠিন কঠিন গান দুইজনে উতরে দিয়েছেন সুনিপুণভাবে। সুচিত্রার ক্যারিয়ারে সন্ধ্যা যেমন জড়িয়ে আছেন ওতোপ্রোতোভাবে ঠিক তেমনি সন্ধ্যার ক্যারিয়ারে সুচিত্রাও তেমনি। উত্তম-সুচিত্রা পর্দায় যখন একের পর এক সফল সিনেমা উপহার দিয়ে রোমান্টিকতায় ভাসাচ্ছেন বাঙালীদের হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ছিলেন তখন বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ গানের জুটি। পর্দায় গল্প এবং চরিত্রের কারনে সুচিত্রার জুটি বদল হলেও গানের ক্ষেত্রে তা ঘটেনি বললেই চলে।

প্রথম এই দুজনের একসাথে কাজ ‘অগ্নিপরীক্ষা’ সিনেমার ‘গানে মোর ইন্দ্রধনু’। ব্যাস এই এক গান দিয়েই যে হিট জুটি হিসেবে তারা বাংলা সিনেমায় যাত্রা শুরু করেছিলেন তা পরবর্তীতে ‘সবার উপরে’ সিনেমার ‘জানি না ফুরাবে কবে’ বা ‘পথে হল দেরি’র ‘এ শুধু গানের দিন’ সাথে ‘তুমি না রহিতে কাছে’ হোক বা ‘সবার উপরে’ সিনেমার ‘ঘুম ঘুম চাঁদ’ অথবা ‘সপ্তপদী’ সেই বিখ্যাত ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’ একের পর এক সুপারহিট গান উপহার দিয়েছে এই নায়িকা- গায়িকা জুটি।
‘অগ্নিপরীক্ষা’ দিয়ে যে যাত্রা শুরু হয়েছিলো তা সেলুলয়েডে থমকে যায় সুচিত্রা সেনের শেষ সিনেমা ‘প্রণয়পাশা’র মধ্য দিয়ে। এর মাঝে যে সন্ধ্যা অন্য নায়িকাদের লিপের জন্য গান গাননি তা নয়। অনেক নায়িকার সাথেই অসংখ্য সুপারহিট গান উপহার দিয়েছেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় তবে সুচিত্রা সেনের সাথে তার জুটির ব্যাপারটাই আলাদা একটা অধ্যায়। তাই হতো সুচিত্রা সেনের মৃত্যুর পর সন্ধ্যা জানিয়েছিলেন ‘শরীর টা চলে গেলো, কন্ঠটা পড়ে রইলো’। আবার অল্প ক'দিন আগেই সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের শেষকৃত্যে শ্রদ্ধা জানাতে এসে সুচিত্রা কন্যা বলেছিলেন- ‘আজ সন্ধ্যা মাসীর সাথে মায়ের কন্ঠটাও চলে গেলো’।
কবি, গীতিকার শ্যামল গুপ্তের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন ১৯৬৬ সালে। সেই সময় মুখার্জি পরিবারের মেয়ে গুপ্ত পরিবারের ছেলেকে বিয়ে করবেন এটা মেনে নিতে পারেননি তার পরিবারের অনেকেই। তবে প্রেমের কাছে সব তুচ্ছ তা প্রমান করতেই যেনো বিয়ে করেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় এবং শ্যামল গুপ্ত। স্ত্রী স্বামীর থেকে জনপ্রিয় হলে পুরুষমন কি নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে? এই প্রশ্ন তার দাম্পত্য নিয়ে অসংখ্য বার সামনে এলেও সন্ধ্যা-শ্যামল সেসব কখনোই পাত্তা দেননি। কাছের মানুষজন জানিয়েছেন শ্যামল গুপ্ত ছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের জীবনের একটা শক্ত এবং আস্থার নাম। যিনি শেষ দিন পর্যন্ত স্বামী তথা ভালো বন্ধু শ্যামল তাঁর দায়িত্ব পালন করেছেন। আর তাঁর হাতে নিজেকে সঁপে দিয়ে নিশ্চিন্তে গান নিয়ে জীবন কাটিয়েছেন ‘গীতশ্রী’ সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। আলো ঝলমলে রূপালী জগতের মোহ পাশে রেখেই এক কন্যাকে নিয়ে সুখের সংসার ছিলো তাদের।
শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, সিনেমার প্লেব্যাক গানের পাশাপাশি রবীন্দ্র সঙ্গীত আর নজরুল গীতি, পুরাতনী গানেও সমান দক্ষতার সঙ্গে বাঙালির মন জয় করে গেছেন তিনি। সংগীতের প্রায় সব শাখায় গান গাওয়া এবং সফলতার শিখরে আরোহনের স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে দেয়া হয়েছিলো ‘গীতশ্রী’ উপাধি৷ মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর অনুরোধেই বছর কয়েক আগে ৮৮ বছর বয়সে একটি সরকারি অনুষ্ঠানে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় বহু বছর পরে জনসমক্ষে গান গেয়েছিলেন। এই বয়সেও তার গান শুনে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলো পুরো অডিটোরিয়াম। গানের শেষে স্টেজে বসা সকল শিল্পী এবং পুরো অডিটোরিয়াম দাঁড়িয়ে করতালি দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছিলো এই মহান গায়িকাকে।

শচীন দেব বর্মন, সলিল চৌধুরী, অনুপম ঘটক, রবীন চট্টোপাধ্যায়, মান্না দে, নচিকেতা ঘোষ, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মতো কিংবদন্তিদের সুরে যেমন অসংখ্য গান গেয়েছেন সন্ধ্যা, আবার নতুন প্রজন্মের সংগীতকার কবীর সুমনের কথা ও সুরেও গেয়েছেন নতুন সময়ের গান। গানের জগতে তিনি এক বিস্ময়ের নাম।
একজন সঙ্গীত শিল্পী হওয়ার পাশাপাশি প্রতিবেশী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেও পরোক্ষভাবে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। বাংলাদেশি উদ্বাস্তুদের জন্য অর্থ সংগ্রহ থেকে শুরু করে বাংলাদেশের জন্য বিশ্বব্যাপী সচেতনতা গড়ে তোলা, সবকিছুতেই অংশ নেন তিনি। এমনকি এছাড়া স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জন্য দেশাত্মবোধক গান রেকর্ড করা বা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জেল থেকে মুক্তি উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু তুমি এলের মতো গানও গেয়েছেন সন্ধ্যা। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার পল্টন ময়দানে যে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল তাতেও বিদেশী শিল্পীদের মধ্যে অন্যতম অতিথি ছিলেন কিংবদন্তি সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়।
১৯৭১ সালে 'জয় জয়ন্তী' এবং 'নিশিপদ্ম' ছবিতে গান গেয়ে শ্রেষ্ঠ গায়িকা হিসেবে জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। গান দুটি হলো- আমাদের ছুটি ছুটি এবং ওরে সকল সোনা মলিন হল। এছাড়াও ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁকে 'বঙ্গবিভূষণ' উপাধিতে সম্মানিত করে। মৃত্যুর কিছুদিন আগে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক ‘পদ্মশ্রী’ পুরস্কারের জন্য তার নাম ঘোষণা হলেও তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।
২০২২ এর ফেব্রুয়ারিতে আসে সংগীত জগতে একের পর এক শোক। প্রথমে কিংবদন্তি লতা মঙ্গেশকরের বিদায়। তারপর এলো সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে বিদায় জানানোর ক্ষন। বেশ কিছুদিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। গত ২৬ জানুয়ারি জ্বর নিয়ে কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর কোভিড সংক্রমণও ধরা পড়েছিল। সেটা থেকে সুস্থ হয়ে উঠলেও যমদূতকে এড়াতে পারলেন না এযাত্রায়। হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ৯০ বছর বয়সে সবাইকে শোকের সাগরে নিমজ্জিত করে চলে গেলেন বাংলা গানের ইন্দ্রধনু। তবে এই যাওয়াটা সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের মতো শিল্পীদের ক্ষেত্রে আসলে সমাপ্তি নয় কোনভাবেই। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়েরা চিরকালীন, চিরন্তন। তার রেখে যাওয়া সমৃদ্ধ গানের ভান্ডার তাকে আমাদের মাঝে মানে বাঙালীর মনে প্রাণে অমর হয়ে রইবে শতাব্দীর পর শতাব্দী জুড়ে। তাই যে পথের শেষ নাই সেই পথে গানের ইন্দ্রধনু হয়ে ঘুম ঘুম চাঁদ হয়ে আরো বহুক্ষন বহুকাল তিনি রইবেন আমাদের কাছে...