কণ্ঠের মাদকতায় শ্রোতাদের জীবন ভরিয়ে দিয়েছেন যে কিংবদন্তী
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

ষাটের দশকে শুরু, শূন্য দশকেও তিনি চুটিয়ে গেয়েছেন গান৷ কবরী-শাবানা থেকে হাল আমলের মিম-পরীমনি, সিনেমায় সবাই ঠোঁট মিলিয়েছেন তার গানের সঙ্গে। আধুনিক গান হোক, সিনেমায় প্লেব্যাক হোক, কিংবা হোক দেশাত্মবোধক গান- প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে তিনি নিজেই নিজের তুলনা হয়ে থেকেছেন...
এ কি সোনার আলোয় জীবন ভরিয়ে দিলে
সত্যিই সৃষ্টিকর্তা উনাকে সুরের ভুবনে সোনার আলোয় জীবন পূর্ণ করে দিয়েছিলেন। 'শুধু গান গেয়ে পরিচয়', 'সে যে কেন এলো না' কিংবা 'সব ক টা জানালা খুলে দাও না', 'জন্ম আমার ধন্য হলো'- এরকম অসংখ্য কালজয়ী গানে মোহনীয় কন্ঠ দিয়ে তিনি শ্রোতাদের প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম বিমোহিত করে রেখেছেন। বাংলাদেশে সঙ্গীত জগতের সবচেয়ে দুইজন উজ্জ্বল তারকার একজন তিনি, শ্রোতাদের ভালোবাসায় পেয়েছেন 'কোকিলকন্ঠী' খেতাব। তিনি বাংলাদেশের গানের পাখি খ্যাত জীবন্ত কিংবদন্তী সাবিনা ইয়াসমিন।
তুমি যে আমার কবিতা
বড় দুই বোন বিখ্যাত শিল্পী ফরিদা ইয়াসমিন ও নীলুফার ইয়াসমিন, তাদেরই পথ অনুসরণ করে সঙ্গীত জগতে হাতেখড়ি। 'নতুন সুর' ছবিতে শিশুশিল্পী হিসেবে প্লেব্যাকে অভিষেক, এরপর 'আগুন নিয়ে খেলা' ছবিতে 'মধু রুপালী জোছনায়' গানে পরিনত বয়সে প্রথম চলচ্চিত্রের গানে কন্ঠ দান। ষাটের দশকেই তিনি বাংলা চলচ্চিত্রের গানের জগতে নিজেকে প্রতিশ্রুতিশীল গায়িকা হিসেবে পরিচিত করেন।
আমি আছি থাকবো, ভালোবেসে মরবো
সত্তরের দশকে একের পর এক জনপ্রিয় গান নিজের সমধুর কন্ঠে বেঁধে চলচ্চিত্রের গানে হয়ে উঠেন শীর্ষস্থানীয় গায়িকা। এই সময়ে প্রায় সব জনপ্রিয় গানেই ছিল তাঁর ছোঁয়া, একক কিংবা ডুয়েট সব মাধ্যমেই প্রতিভা ছড়িয়েছেন। 'সে যে কেন এলো না', 'শুধু গান গেয়ে পরিচয়', 'এই পৃথিবীর পরে', 'অশ্রু দিয়ে লেখা', 'এই মন তোমাকে দিলাম', 'ও আমার রসিয়া বন্ধুরে', 'একটুস খানি দেখো', 'ঈশারায় শীষ দিয়ে', 'চিঠি দিও প্রতিদিন', 'হায়রে কপাল মন্দ', 'কেউ কোনদিন আমারে তো' থেকে 'সব সখীরে পার করিতে' সহ অসংখ্য জনপ্রিয় গান নিজের কন্ঠে বেঁধেছেন। কালের প্রবাহে গানগুলো পেয়েছে কালজয়ীর মর্যাদা।
আমি রজনীগন্ধা ফুলের মতন গন্ধ বিলিয়ে যাই
আশির দশকেও তিনি নিজের জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছিলেন, এই দশকে সিনেমার ধারা বদলের পাশাপাশি সংগীতেও পরিবর্তন এসেছিল। সেই সময়টাতে 'দুঃখ ভালোবেসে', 'আহা চোখের লজ্জায়', 'সন্ধ্যারও ছায়া নামে', 'শত জনমের স্বপ্ন', 'তুমি ছাড়া আমি একা', 'আবার দুজনে' কিংবা 'সবাই তো ভালোবাসা চায়' এর মতো অসংখ্য জনপ্রিয় গানে শ্রোতাদের মাতিয়েছিলেন।

হাজার বছর পরে আমি আসবো ফিরে
আগের দশকগুলোর মতো নব্বই দশক ও নতুন শতকে অসংখ্য জনপ্রিয় গানে কন্ঠ দিয়েছিলেন সাবিনা ইয়াসমিন। 'পৃথিবীতে সুখ বলে', 'ও সাথীরে', 'উড়ে যেতে যেতে', 'হৃদয়ের আয়না', 'তুমি আমার মনের মানুষ' সহ দারুন সব গান কণ্ঠে বেঁধেছিলেন, এরপর চলচ্চিত্রের গানে ধীরে ধীরে অনিয়মিত হতে থাকেন। এরমাঝেও 'বরষার প্রথম দিনে', 'আমার ভাঙা ঘরে ভাঙা চালা', 'প্রেমে পড়েছে', 'সুখ পাখিরে' কিংবা 'চলো বৃষ্টিতে ভিজি' সহ তার সমধুর কন্ঠে বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় গান গেয়েছেন, এখনো মাঝে মাঝে চলচ্চিত্রের জন্য গান করেন, তবে তা সংখ্যায় একেবারেই কম।
জন্ম আমার ধন্য হলো
দেশাত্মবোধক গানেও তার জুড়ি মেলা ভার। সাবিনা ইয়াসমিনের গাওয়া অনেক দেশাত্মবোধক গানই আইকনিক হয়ে আছে। 'সেই রেললাইনের ধারে মেঠো পথটার পাশে দাঁড়িয়ে', 'একটি বাংলাদেশ তুমি জাগ্রত জনতার', 'মাঝি নাও ছাইড়া দে', 'সুন্দর সুবর্ণ তারুণ্য লাবণ্য' কিংবা 'সব কটা জানালা খুলে দাও না'র মত অবিস্মরণীয় গানের শিল্পী তিনি।
বাংলা চলচ্চিত্রে সবচেয়ে বেশি গানে কন্ঠ দেয়া এই গায়িকা খান আতাউর রহমান, সত্য সাহা, আলাউদ্দিন আলী, আলম খান, আর ডি বর্মন, আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল থেকে ইমন সাহা, হাবিব ওয়াহিদ সহ বিভিন্ন প্রজন্মের সব স্বনামধন্য সুরকারদের সাথে কাজ করেছেন। সহশিল্পী হিসেবে পেয়েছেন আব্দুল আলীম, মাহমুদুন্নবী, সৈয়দ আব্দুল হাদী, খুরশিদ আলম, কিশোর কুমার, এন্ড্রু কিশোর থেকে খালিদ হাসান মিলু, আগুন, আসিফ, মনির খান, হাবিবের মত জনপ্রিয় গায়কদের। কবরী, শাবানা, ববিতা থেকে দিতি, মৌসুমী, শাবনূর কিংবা এই যুগের মিম, পরিমনি- সবাই তার গানে ঠোঁট মিলিয়েছেন। প্রয়াত নায়িকা কবরীর নির্মিত ছবিতে প্রথমবারের মতো সংগীত পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন।
সঙ্গীত জীবনে চলচ্চিত্রের গানে বেশি মনোযোগ দেয়া এই সুকন্ঠীর চলচ্চিত্রের বাইরে তেমন জনপ্রিয় আধুনিক গান নেই। বর্ণিল ক্যারিয়ারে পেয়েছেন দেশের সর্বোচ্চ সম্মাননা একুশে পদক, স্বাধীনতা পুরস্কার। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন রেকর্ড সংখ্যক ১৪ বার। এছাড়া দেশে-বিদেশে বহু পুরস্কার পেয়েছেন, সংগীতের উপর ডক্টরেট ডিগ্রি নিয়েছেন এই কিংবদন্তী।
২০০৭ সালে মরনব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হন, সৃষ্টিকর্তার অশেষ কৃপা, শ্রোতাদের অগাধ ভালোবাসা আর শুভকামনা, পাশাপাশি সরকারের সার্বিক সহযোগিতা ও সঠিক চিকিৎসায় তিনি সুস্থ হয়ে ফিরেছিলেন।
শুভ জন্মদিন, সাবিনা ইয়াসমিন!