'রুনা লায়লাকে দিয়ে দাও, ফারাক্কার পানি নিয়ে যাও!'
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
ভারতীয় সাংবাদিক খুশবন্ত সিং একবার পত্রিকায় বাংলাদেশ সরকারের উদ্দ্যেশ্যে লিখেছিলেন, ‘প্লিজ গিভ আস রুনা লায়লা, এন্ড টেক অল দ্য ওয়াটার অব ফারাক্কা!' কিন্তু কেন বলেছিলেন এই কথাটা?
উপমহাদেশের প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী রুনা লায়লার জন্ম সিলেটে, বেড়ে ওঠা ও শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে উঠা পাকিস্তানের করাচীতে। পাকিস্তান রেডিওতে গান গেয়ে শিল্পী জীবনের শুরু, এরপর গান গেয়েছেন পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশের অসংখ্য চলচ্চিত্রে। বাংলা, উর্দু, হিন্দি, পশতু, পাঞ্জাবি সহ বিভিন্ন ভাষায় দশ হাজারেরও বেশি গান গেয়েছেন তিনি।
অথচ ছোটবেলায় নাচের প্রতি তার আগ্রহ ছিল বেশি, নাচের প্রশিক্ষণও নিয়েছিলেন। স্টেজ শো'তে গানের সাথে যে পারফর্মও করা যায় এটা উপমহাদেশের মানুষকে সর্বপ্রথম রুনা লায়লা দেখিয়েছেন। আজ যে গানের সাথে শিল্পীরা মঞ্চে অঙ্গ দুলিয়ে দর্শকদের সুরের দ্যোতনা আর নৃত্যের তালে তালে অদ্ভূত ঘোরে নেশাতুর করে ফেলেন এর প্রচলন রুনা লায়লাই শুরু করেছিলেন।
উপমহাদেশের আরেক কিংবদন্তি লতা মঙ্গেশকরের সাথে রুনা লায়লার সখ্যতার খবর মিডিয়ায় এসেছে অনেকবার। একবার ইন্ডিয়ান কালচারাল সেন্টারের আমন্ত্রনে রুনা লায়লা ইন্ডিয়ায় গিয়েছিলেন, সেবার মুম্বাইয়ে গান গাওয়ার জন্য ব্যাকস্টেজে রিহার্সাল করছিলেন তিনি। হঠাৎ দেখতে পান- পেছনের দরজা দিয়ে কয়েকজন মহিলা ঢুকছে, তাদের মধ্যে একজন সাদা শাড়ি পড়া। তাকে লতা মঙ্গেশকরের মতো মনে হল রুনা লায়লার কাছে। তারপর দেখলেন সেই মহিলা ফুল নিয়ে রুনা লায়লার দিকেই এগিয়ে আসছেন- লতা মঙ্গেশকর! তিনি এসেই রুনা লায়লাকে জড়িয়ে ধরলেন। পরেরদিন পত্রিকায় শিরোনাম হলো- ওয়ান নাইটেঙ্গেল মিটস এনাদার!
আশা ভোঁসলে আর লতা মঙ্গেশকরের সাথে রুনা লায়লার সম্পর্ক খুবই বন্ধুত্বসুলভ, যদিও লতা মঙ্গেশকর সিনিয়র। রুনা লায়লার ক্রাশ ছিলেন বলিউডের শশী কাপুর। মুম্বাইয়ের তাজ হোটেলে শশী কাপুর, রুনা লায়লা আর অমিতাভ বচ্চনের খোশগল্প নিয়ে মুখরোচক সুন্দর একটি গল্পও আছে। ইলাস্ট্রেটেড উইকলি অব ইন্ডয়ার সম্পাদক খুশবন্ত সিং একবার তার পত্রিকায় বাংলাদেশ সরকারের উদ্দ্যেশ্যে লিখেছিলেন, 'প্লিজ গিভ আস রুনা লায়লা, এন্ড টেক অল দ্য ওয়াটার অব ফারাক্কা!' (রুনাকে দিয়ে দাও, ফারাক্কার সব পানি নিয়ে যাও!)
কাশ্মীরের শ্রীনগরে রুনা লায়লার নামে একটা হাসপাতাল রয়েছে। এর আগে শ্রীনগরে কোনো হাসপাতাল ছিল না। কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী শেখ আব্দুল্লাহ রুনা লায়লাকে চিঠি লিখেন, ‘শ্রীনগরে একটা হাসপাতালের জন্য তহবিল গঠন করতে চাই। আপনি একটা গানের অনুষ্ঠান করে দেবেন? আপনার যা পারিশ্রমিক, তা আমাকে জানিয়ে দেবেন; আমি সেভাবে আয়োজন করব।’ জবাবে রুনা লায়লা লিখেন, ‘আপনি এত বড় একজন মানুষ হয়ে আমাকে আমন্ত্রণ করেছেন এত ভালো একটা কাজের জন্য, এটা আমার জন্য অনেক আনন্দের। আমি কোনো পারিশ্রমিক নেব না। কোনো পেমেন্টের প্রশ্নই আসে না। আমি আসব আর বেড়িয়ে যাব, আপনার হাসপাতালের জন্য অনুষ্ঠানে গান করব।’ তারপর শেখ আব্দুল্লাহ অত্যন্ত খুশি হয়ে লিখেছিলেন, ‘ইউ অ্যান্ড ইয়োর হোল ফ্যামিলি আর করডিয়েলি ইনভাইটেড টু কাম অ্যাজ মাই গেস্ট। আমি কৃতজ্ঞ আপনার কাছে।'
এরপর রুনা লায়লা সেখানে যান। বিমান থেকে নামার সাথে সাথে কাশ্মীর সরকার তাকে লাল গালিচা অভ্যর্থনা জানায়। শেখ আব্দুল্লাহর ছেলে ফারুক আবদুল্লাহ রুনা লায়লাকে কাশ্মীর ঘুরে ঘুরে দেখান। জেনে অবাক হবেন, শ্রীনগরে গান গাওয়ার সময় রুনা লায়লার নিরাপত্তার জন্য চৌদ্দশো মাউন্টেন পুলিশ নিয়োজিত করে কাশ্মীর সরকার। সেই অনুষ্ঠানে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে শ্রীনগরে বিশাল হাসপাতাল তৈরি করা হয়, হাসপাতালের গায়ে বড় অক্ষরে খোদাই করা আছে- ডোনেটেড বাই রুনা লায়লা!
বিশ্বের বহু দেশে গান গেয়েছেন রুনা লায়লা। ওয়াশিংটনের কেনেডি সেন্টার, নিউইয়র্কের লিংকন সেন্টার, ম্যাডিসন স্কয়ার, লন্ডনের এলবার্ট হল, ওয়েম্বলি স্টেডিয়াম, বার্মিংহামের এনইসি ইনডোর স্টেডিয়াম, সিডনির অপেরা হাউজ সহ বিশ্বের খ্যাতনামা সব যায়গায় গান গেয়েছেন তিনি। এরমধ্যে অপেরা হাউজে গান গেয়েছেন তিনবার, ওয়াশিংটনের কেনেডি সেন্টারে গান গাওয়া উপমহাদেশের প্রথম শিল্পী আমাদের রুনা লায়লা, কেনেডি সেন্টারে তার পোষ্টারটি এখনও জ্বল জ্বল করছে।
পিতার চাকরির সুত্রে বেড়ে উঠা পাকিস্তানে হলেও তিনি বাংলাদেশী হিসেবে গর্ববোধ করেন। বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে গান গাওয়ার সময় শুরুতে বলেন আ'ম রুনা লায়লা, ফ্রম বাংলাদেশ। রুনা লায়লার সময়ে পাকিস্তানে তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন, তার গানের সময়টাকে পাকিস্তানে এখনো 'গোল্ডেন পিরিয়ড অব পাকিস্তান' বলা হয়।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর রুনা লায়লা বাংলাদেশে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন। তখন পাকিস্তানের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিই শুধু নয়, পাকিস্তান সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে রুনা লায়লাকে অনুরোধ করা হয় পাকিস্তানে থেকে যাওয়ার জন্য। পাকিস্তানের চলচ্চিত্র শিল্প পড়ে যায় মারাত্মক হুমকির মুখে, কারণ ওদের সিনেমার অধিকাংশ গান গাইতেন রুনা লায়লা। তবু তিনি থাকেননি; আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা, সম্ভাবনাময় ভবিষ্যত- সবকিছুর মায়া ছেড়ে জন্মভুমির টানে ১৯৭৪ সালে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ফ্লাইটে জন্মভুমিতে ফেরেন আমাদের রুনা লায়লা।