আরআরআর কি আসলেই এতটা প্রশংসার যোগ্য?
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

এই সিনেমা সিনেমা হলে দেখার জন্য বানানো। হলপ্রিন্ট বা ভালো প্রিন্ট আসলে টিভি-ল্যাপটপের স্ক্রিনে দেখেও এর স্বাদ পুরোপুরি পাওয়া যাবে না। রাজামৌলি সিনেমার যে কম্যুনিটি ভিউয়িং এক্সপেরিয়েন্স সেটি ফিরিয়ে আনছেন, এজন্যই তিনি ইতিহাস হয়ে থাকবেন, ইতিহাস হয়ে থাকবে তার সিনেমাও...
Only Rajamouly can do this. Only 'Raja The Freaking Mouly' can do something like this.
এটা হচ্ছে উপমহাদেশীয় কমার্শিয়াল সিনেমার স্বরূপ। আবেগ, দেশপ্রেম, ভালোবাসা, প্রতিশোধ এসব মানবীয় অনুভূতির সাথে থাকবে মিথিক্যাল ট্রিটমেন্ট, আউটল্যান্ডিশ একশন সিকোয়েন্স আর ফ্যান্টাসি। আপনি কল্পনা করে নিন যে এসব জিনিসগুলো হল একেকটা রঙ, আর রাজামৌলি হচ্ছেন শিল্পী। তিনি ক্যানভাসে যা আঁকবেন সেখানে প্রতিটা রঙ কীভাবে একে অপরের সাথে মিশে সুন্দর একটা চিত্রকর্ম হয় সেটাই বারবার অবাক করে দেয়। মাঝে মাঝে অবাক হতে হয় এই ভেবে যে কীভাবে প্রতিবার সম্ভব ভিন্ন ভিন্ন গল্প নিয়ে এরকম নিখুঁত সিনেমা বানানো।
নিখুঁত এই অর্থে না যে সিনেমা হিসেবে যেগুলোকে আমরা গ্রেট মানি সেগুলোর কাতারে যাবার মতো সিনেমা এগুলো। নিখুঁত এই অর্থে যে এই গল্পগুলো আমাদের উপমহাদেশীয় জিনোমে গাঁথা গল্প। উপমহাদেশের ঘরে ঘরে পৌরাণিক গল্প খেলা করে। যেখানে আমরা খুঁজে পাই বীর যোদ্ধাদের, যাদের পক্ষে যেকোনো কিছু করা সম্ভব। তাদের কোন সুপার সিরাম বা ইনফিনিটি স্টোনের পাওয়ারের প্রয়োজন হয় না। তাদেরকে অসুরিক শক্তি এনে দেয় তাদের আবেগ।
আমি সিনেমায় যেকোনো কিছু বিলিভ করতে রাজি আছি যদি সেটা বিলিভেবল করা যায়। গ্রিক মিথলজির ডেমি গডদের শক্তি বিলিভ করি, সুপারহিরোদের আনইমাজিনেবল পাওয়ার বিলিভ করি, বিলিভ করি কোমারাম ভীম আর সীতারাম রাজুকেও। রাজামৌলি নিজেই সেভাবে দেখেন তাঁর গল্পের চরিত্রদের, তাই বলে আর দশটা সাউথ সিনেমার মতো সেটাকে হাস্যকর বানিয়ে না বরং সেটার পেছনে আবেগ মথিত করে।
কে ভি বিজয়েন্দ্র প্রসাদ গল্পকার হিসেবে অনন্য। কারণ, দুটো রিয়েল লাইফ যোদ্ধাকে একই প্রেক্ষাপটে একইসাথে কল্পনা করে গল্প গাঁথা মুখের কথা নয়। কোমারাম ভীম ও আল্লুরি সীতারাম রাজু ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের দুই শক্তিশালী নাম। যারা দুজনেই ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন। কেমন হত যদি তাদের দেখা হত তখন? ব্রিটিশরা কী টিকতে পারতো তখনও?

এস এস রাজামৌলী সে গল্পটাই ভাবলেন। আদিবাসী ভীমকে জঙ্গলের বাঘের সাথে লড়াই করিয়ে দিল্লি নিয়ে এলেন, অন্যদিকে রামকে হাজারো তপ্ত জনতাকে কাবু করে ভীমের সামনে দাঁড় করালেন। এর পরের গল্পটা বন্ধুত্বের, ভালোবাসার সাথে প্রতিশোধেরও। ব্রিটিশদের নির্যাতনকে রাজামৌলি এমনভাবে দেখিয়েছেন যে দর্শক নিতে পারবে না, বারবার দাঁতে দাঁত চেপে ধরে অপেক্ষা করবে ভীম আর রামের জেগে ওঠার।
রাজনীতি আর শোষণের চরম বাস্তবিক গল্পকে রাজামৌলি নিয়ে এসেছেন কাল্পনিক রূপে আরও অনেকগুণ শক্তিশালী করে। ভীম আর রামের যেভাবে এন্ট্রি হল সেটাই কল্পনাতীত। দুটো এন্ট্রি সিনই রাজামৌলি আলাদা করে ভেবেছেন, ভেবেছেন ইন্টার্ভাল আর ক্লাইম্যাক্সের একশন নিয়েও। এই যে একশন মন্টাজ নিয়ে আলাদাভাবে ডিজাইন করা, এক্সিকিউট করা এটাই রাজামৌলির একশনকে আর দশটা একশন সিনেমা থেকে আলাদা করে। সাথে ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর আর মিউজিক তো আরও দশগুণ বাড়িয়ে দেয় সেসব দৃশ্যের স্বাদ।
রাম চরণ ও এনটিআর নিঃসন্দেহে যার যার ক্যারিয়ারের সেরা কাজ দেখিয়েছেন। ভীমের গল্প দিয়ে শুরু হয়ে রামের গল্পে শেষ হওয়া রাজামৌলির মাস্টারমেকিং এরই অংশ। রাম চরণের চরিত্রের যে জটিলতা, এনটিআরের চরিত্রের যে সরলতা পুরোটাই রাজামৌলি খুব যত্ন করে লিখেছেন। অন্যান্য চরিত্রগুলোও দারুণ সঙ্গ দিয়েছে। বিশেষ করে ব্রিটিশদের চরিত্রে অভিনয় করা প্রতিটি অভিনেতা দারুণ, রাজামৌলি সময় নিয়ে এই অভিনেতাদের কাস্ট করেছেন। হলিউডের বেশ বড় বড় অভিনেতাদেরই জড়ো করেছেন এখানে।
ভিএফএক্সের কাজ অনেক উন্নত হয়েছে বাহুবালির তুলনায়। এমন লেভেলের ভিএফএক্স ইন্ডিয়ান সিনেমায় দেখা যায় নি এর আগে। আমি নিশ্চিত রাজামৌলি হলিউড লেভেলের বাজেট পেলে হলিউডের অনেক সিনেমার চেয়ে বেটার ভিএফএক্স দেখাতে পারবেন।
RRR কী আসলেই এতোটা প্রশংসার যোগ্য? আমি বলবো- হ্যাঁ। প্যান্ডেমিকের পর সিনেমা ও সিনেমা হলের যে অবস্থা সেখানে রাজামৌলি এমন একটি সিনেমা উপহার দিয়েছেন যে দলে দলে মানুষ গিয়ে উপভোগ করে আসতে পারবে। এই সিনেমা সিনেমা হলে দেখার জন্য বানানো। হলপ্রিন্ট বা ভালো প্রিন্ট আসলে টিভি-ল্যাপটপের স্ক্রিনে দেখেও এর স্বাদ পুরোপুরি পাওয়া যাবে না। রাজামৌলি সিনেমার যে কম্যুনিটি ভিউয়িং এক্সপেরিয়েন্স সেটি ফিরিয়ে আনছেন, এজন্যই তিনি ইতিহাস হয়ে থাকবেন, ইতিহাস হয়ে থাকবে তার সিনেমাও। যে সিনেমাগুলো দেশের গল্প বলে, মাটির গল্প বলে, কাল্পনিকতার আড়ালে বলে মানবিকতার গল্প। কমার্শিয়াল সিনেমা এট ইটস বেস্ট!