বাংলাদেশের 'রেহানা' নিয়ে 'ফিল্মস বুটিক' বিস্তর আশাবাদীও। এরকম এক দারুণ গল্পকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেয়ার গুরুদায়িত্ব তারা স্বেচ্ছায় কাঁধে তুলে নেওয়ার পাশাপাশি প্রশংসা করছেন বাংলাদেশের শিল্পজগতেরও...

যারা একটু আড়ালে থাকা গুনী মানুষ, তাদের জন্যে বরাবরই গভীর শ্রদ্ধাবোধ কাজ করে আমার। এই দেখনদারি, প্রচার, প্রসারের নির্লজ্জ সময়ে এসেও যারা নিজেদের আগলে রাখতে পারেন বাইরের ক্লেদ থেকে, তারা অবশ্যই ভিন্ন স্থানাঙ্কের মানুষ। হালফিলে এরকম মানুষের দৃষ্টান্ত টানতে গেলে আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ এর নাম আসবে সর্বাগ্রে। যার পরিচালিত সিনেমা 'রেহানা মরিয়ম নূর' বিশ্বসেরা 'কান চলচ্চিত্র উৎসব' এ মনোনীত হওয়ার সংবাদ বোধকরি জানি আমরা সকলেই। বিস্মিত হই, এই মানুষটি এমন এক দেশের মানুষ, যে দেশে প্রচারের প্রয়োজনে মানুষ যেতে পারে অসভ্যতার যেকোনো প্রকোষ্ঠে। অথচ, এত বড় একটা অর্জনের পরেও তিনি বরাবরের ধ্যানী সাধকের মতনই নিশ্চুপ। বৈপরীত্য ঠিক এখানেই। 

রেহানা মরিয়ম নূর

সাদ এর নির্মিত 'রেহানা মরিয়ম নূর' যখন ৭৪তম কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের 'আঁ সার্তে রিগার্দ' বিভাগে মনোনয়ন পায়, তখন তাকে নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে করতে তাঁর নির্মিত 'লাইভ ফ্রম ঢাকা' সিনেমার কথা জানতে পারি।

এরপর সাদা-কালো এই সিনেমা দেখি। দেখা শেষে স্থানু হয়ে বসে থাকি অনেকক্ষণ। এরকম টক্সিক, মেলানকোলিক সিনেমা আমি সাম্প্রতিক অতীতে দেখেছি বলে মনে পড়ে না৷ দেড় ঘন্টা ডিউরেশনের এ সিনেমা বিচ্ছিরি এক আত্মসংকটের বোধ দিয়ে যায় ভেতরে। সিনেমা শেষ করে দুটি উপলব্ধি হয়। এক- এরকমও জীবন হয়!  দ্বিতীয়-এরকমও সিনেমা হয়! 

লাইভ ফ্রম ঢাকা! 

'লাইভ ফ্রম ঢাকা'র সাদা-কালো মুগ্ধতার রেশ কাটেনি এখনও। মুগ্ধতা কাটেনি 'রেহানা মরিয়ম নূর' এর বিশ্বব্যাপী দাপট নিয়েও। এরইমধ্যে আরেক দারুণ সংবাদ পেলাম,  সিনেমাটির ইন্টারন্যাশনাল সেলস- এর জন্যে জার্মানভিত্তিক সেলস অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি ফিল্মস বুটিক চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। তারা এই সিনেমা নিয়ে বিস্তর আশাবাদীও। 'রেহানা'র মতন দারুণ নির্মাণকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেয়ার গুরুদায়িত্ব তারা স্বেচ্ছায় কাঁধে তুলে নেওয়ার পাশাপাশি প্রশংসা করছে বাংলাদেশের শিল্পজগতেরও। বিশ্বখ্যাত বিনোদন ম্যাগাজিন 'ভ্যারাইটি'তে 'ফিল্মস বুটিক' এর সিইও জানাচ্ছেন, বাংলাদেশ থেকে এরকম অসাধারণ সিনেমা আরো এলে তারা তখনও তাদের পাশে থাকবেন!  

কান চলচ্চিত্র উৎসবের ডিরেক্টর'স ফোর্টনাইটে আসা তারেক মাসুদের 'মাটির ময়না' সিনেমাও বিদেশে ব্যবসা করেছিলো বহুদিন৷ সে ঐতিহ্য বহাল থাকবে 'রেহানা'র ক্ষেত্রেও। হয়তো এ সিনেমা দোর্দন্ডপ্রতাপে ছাড়িয়ে যাবেন অতীতের ইতিহাসকেও। কে জানে! 

জীবনানন্দ দাশের মা কুসুমকুমারী দাশ লিখেছিলেন-

আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে
 কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে?

'রেহানা'র পরিচালক যেন কুসমকুমারী দাশের সেই 'আদর্শ ছেলে।' যে ছেলের সাফল্যে আজ দেশীয় শিল্পজগতের সম্মানই যেন বেড়ে গিয়েছে অনেকটা। যেদেশের প্রেক্ষাগৃহগুলোতে এখনও স্বাভাবিক রুচিবোধের মানুষ ঢুকতে বিব্রত হয়, সে দেশের এক পরিচালকের সিনেমার পোস্টার 'কান উৎসব' এ বড় বড় রথী-মহারথীদের সিনেমার সাথে পাল্লা দেবে, সেটা স্বপ্নের চেয়েও বড় কিছু ছিলো। সময় সেটাকে সম্ভব করেছে। আশা করি, এই কাজের প্রতিক্রিয়া হিসেবে এদেশের শিল্পসমাজ জাগবে। ভালো কিছু কাজ হবে। দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়বে বাংলাদেশের শিল্প-সংস্কৃতির সৌকর্য। এভাবে দেখতে দেখতে গুটিকয়েক নির্মাতা যদি হাল ধরেন, এদেশের সংস্কৃতিপট ঘুরে দাঁড়াতে বাধ্য। সেজন্যেই এত প্রত্যাশা ও আশাবাদ।

শুভকামনা রইলো সাদ ও তার পুরো টিমের জন্যে। অসাধ্যসাধনের যে যাত্রা শুরু হয়েছে, তা দিগ্বিজয়ী হোক স্বমহিমায়। 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা