রিফিউজি: বিহারী জনগোষ্ঠীর গল্প নিয়ে এমন নির্মাণ বাংলাদেশে বিরল!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
'বিহারী-বাঙ্গালী' দ্বৈরথ ছাপিয়েও এই গল্পে যেভাবে উঠে আসে কিছু কালপ্রিটের নগ্ন অবয়ব, যারা অসহায় মানুষদের 'উইক পয়েন্ট'কে 'ওয়েপন' বানিয়ে করে ব্যবসা, যে ব্যবসায় তাদের কেশাগ্রও ক্ষতিগ্রস্ত হয়না, কিন্তু এক কমিউনিটির সাথে আরেক কমিউনিটির মধ্যবর্তী সম্পর্কে ক্রমশ পড়ে ভাটা... এ সত্যটুকু 'রিফিউজি' বেশ ভালোভাবেই স্টাবলিশ করে। যেজন্যে, এই নির্মাণের কুশীলবেরা আলাদাভাবে একটা ধন্যবাদের অবশ্যই যোগ্য দাবীদার...
'দেশের মধ্যে দেশ' বলে যে কথাটা আছে, মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্পে গেলে সেটা বেশ ভালোই ঠাহর করতে পারা যায়। যুদ্ধের দামামার মাঝখানে ছোট্ট এক ফাটলে আটকে পড়ে যারা এখানে তড়পাচ্ছেন বহুদিন ধরে, তাদেরকে আমরা 'বিহারী' বলে চিনি। যারা সাতচল্লিশের দেশভাগের পরেই দলেবলে এসেছিলেন পূর্ব বাংলায়। যদিও বাংলার সাথে তাদের ভাষা-সংস্কৃতি-মানসিকতা কিছুই মেলেনা, তবুও বহুদিন ধরেই তারা আছেন ভূখণ্ডের এ বিশেষ অংশে। বাঙ্গালীরা তাদের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলে, আর বিহারীরাও বাঙ্গালীদের জন্যে বুকের ভেতর পুষে রাখে, ছোট্ট এক শব্দ- নফরৎ। ঘৃণা।
এই যে বাঙ্গালী-বিহারী দ্বৈরথ, কোন্দল... এখানে আবার ফায়দা লোটেন কেউ কেউ। মায়ানমার থেকে যখন রোহিঙ্গারা দলে দলে বাংলাদেশে এসে ভীড় করলো, তখন জানতে পেরেছিলাম, এদেশেরই কিছু উগ্রপন্থী গ্রুপ এই রোহিঙ্গাদের টার্গেট করেছে। ভালনারেবল রোহিঙ্গাদেরকে ফুঁসলে 'এক্সট্রিমিস্ট' বানানোর মিশনে নেমেছে। যেমনটা দেখতে পাই এখানেও। এখানে 'কার্বন' নামে এক চরিত্র পাই, যিনি কিছু বিহারীকে 'ব্রেইন ওয়াশ' করে ব্যবহার করা শুরু করেন নিজের স্বার্থের জন্যে। এই ভূখণ্ডের ভারসাম্য নষ্ট করার জন্যে।
'রিফিউজি'র লিড কাস্ট অবশ্যই 'কার্বন' না। বরং ইকবাল-ওয়াসিম-মারিয়া... এই থ্রি মাস্কেটিয়ার্সকে ট্রিট করা যেতে পারে এই কন্টেন্টের প্রোটাগনিস্ট হিসেবে। যাদের মধ্যে ইকবাল, ওয়াসিম বিহারী। মারিয়া বাঙ্গালী। পুরো নির্মাণজুড়েই যাদের 'চোর-পুলিশ' ইঁদুর-দৌড় যেমন দেখি, তেমনি 'কার্বন'কে কেন্দ্র করে তাদের যে পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া, দেখি সেটিও। এবং, এসবের মাঝেমাঝে আসে চরিত্রগুলোর ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ-বিষাদও। বাঙ্গালী ও বিহারীদের মধ্যবর্তী অস্বস্তির সাত-সতেরোও যেমন এখানে আসে, তেমনি এখানে স্পষ্ট হয় কারাগারের অভ্যন্তরের কিছু কদর্য প্রাকটিসের হিন্টসও।
'রিফিউজি'র যে গল্প, এটাকে নতুন বলার সুযোগ নেই। এখানে নতুন যা, সেটা গল্পের প্রেক্ষাপট। বাংলাদেশের 'বিহারী'দেরকে উপজীব্য করে এরকম আর কোনো নির্মাণ হয়েছে কি না, জানি না। সেটুকু বিবেচনায়, বেশ সাহসী এক কাজই বলবো এটিকে। বিহারীরা আমাদেরকে কিভাবে দেখে, বা, আমরাও তাদের কিভাবে দেখি, সেসব নিয়ে সোজাসাপটা কিছু বয়ান পেয়েছি এ ওয়েব সিরিজে, যা বেশ দারুণ। প্রাসঙ্গিকও। এই ওয়েব সিরিজের চরিত্রেরা যাতে ঠিকঠাক উর্দু ভাষায় কথা বলতে পারে, সেজন্যে ল্যাঙ্গুয়েজ টিচারও রাখা হয়েছিলো। যিনি নির্মাণের শেষতক ছিলেন। ভাষার ব্যাপারে নজর রেখেছেন। ভালো লেগেছে নির্মাণ নিয়ে দায়িত্বশীলতার এই বিষয়টিও। এছাড়াও, শেষদিকে এসে গল্প গতি পেয়েছে। সেটাও ভালো লেগেছে। গল্প দ্বিতীয় সিজনের জন্যে রাখা হয়েছে, তবে প্রথম সিজনটাও আধাখেঁচড়াভাবে শেষ হয়নি, এটাও একটা প্রশংসার দিক।
তবে, এতসব প্রশংসার ভীড়ে ত্রুটিও আছে বেশকিছু। প্রথমত- স্ক্রিনপ্লে মসৃণ না। মাঝেমধ্যেই গতি পড়ে যাচ্ছিলো। তাছাড়া, কিছু চরিত্রের এক্সিকিউশনও বেশ খাপছাড়া লেগেছে। দ্বিতীয়ত- কালার টোন। ব্লুইশ একটা কালার টোন ছিলো পুরো নির্মাণে। যেটা প্রথমদিকে ভালো লাগলেও শেষদিকে এসে একঘেয়ে ও চোখের অত্যাচার মনে হয়েছে। তৃতীয়ত- ডাবিং রিয়েলিস্টিক লাগেনি। চরিত্রগুলো যে কোনো একটা বদ্ধ ঘরে বসে ডায়লগ বলছেন, এটা বোঝা যাচ্ছিলো। চতুর্থত- ক্যারেক্টার ডেভেলপমেন্টে ঘাটতি ছিলো। গল্পে যেমন দেখতে পাই- ওয়াসিম আর ইকবালের দারুণ বন্ধুত্ব। কিন্তু, কিভাবে এ বন্ধুত্ব হলো, এই প্রগাঢ় রসায়নের অতীত টা কি, এসব জানা দরকার ছিলো। 'কার্বন' নামের যে মানুষটি এ গল্পের এক্স ফ্যাক্টর, অনেককিছু জানা দরকার ছিলো তাকে নিয়েও। পাইনি। শূন্যস্থান রয়ে গিয়েছে।
তবে, এসব অসঙ্গতি বাদ দিলে, 'রিফিউজি' বেশ উপভোগ্য এক কাজ। 'বিহারী-বাঙ্গালী' দ্বৈরথ ছাপিয়েও এ গল্পে যেভাবে উঠে আসে কিছু কালপ্রিটের নগ্ন অবয়ব, যারা অসহায় মানুষদের 'উইক পয়েন্ট'কে 'ওয়েপন' বানিয়ে করে ব্যবসা, যে ব্যবসায় তাদের কেশাগ্রও ক্ষতিগ্রস্ত হয়না, কিন্তু এক কমিউনিটির সাথে আরেক কমিউনিটির মধ্যবর্তী সম্পর্কে ক্রমশ পড়ে ভাটা... এ সত্যটুকু 'রিফিউজি' বেশ ভালোভাবেই স্টাবলিশ করে। যেজন্যে, এই নির্মাণের কুশীলবেরা আলাদাভাবে একটা ধন্যবাদের অবশ্যই যোগ্য দাবীদার।