বিহারিদের পাকিস্তান প্রীতি, বাঙালিদের অবহেলা, নাগরিকত্ব নিয়ে জটিলতা, জেলের ভেতর কয়েদিদের যৌন নির্যাতন আর যুদ্ধাপরাধীদের পরের জেনারেশনের কালো দিক খুব ভালভাবে দেখানো হয়েছে 'রিফিউজি'তে। সে কারণেই, সবমিলিয়ে, ইমতিয়াজ হোসেন সজীবের নির্মাণ 'রিফিউজি' বেশ দারুণভাবেই হয়েছে প্রাসঙ্গিক।
জিন্দেগী ভার হাম অ্যায়সে জিয়ে, অ্যায়সে জিয়ে!
'রিফিউজি' সিরিজকে এক বাক্যে বলতে গেলে এই হতাশা আর ক্ষোভের কথাটির প্রতিফলন বলা চলে। 'ওয়াসিম' চরিত্রটির এই আর্তচিৎকার শুধু একটি প্রশ্ন না, একটি স্টেটমেন্টও যার উত্তর লাখো বিহারি আজও খুঁজে ফিরছে চাতকের মত। দেখেও না দেখার মত রাজধানী ঢাকার বুকে যে তথাকথিত 'আটকে পড়া পাকিস্তানি'রা আছে, তাদের বুক ভাঙা দীর্ঘশ্বাস যেন হাওয়া হয়ে মিলিয়ে যায় ওইটুকু ক্যাম্পের ভেতরেই।
ওয়াসিম ছাড়াও 'রিফিউজি'র গল্পে আরো তিনজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি আছে। ইকবাল, খুনের ঝামেলায় জড়িয়ে জেলহাজতে আটকে থাকা ছোট ভাইকে ছাড়াতে মরিয়া এক বিহারি যুবক। মারিয়া, ব্যক্তিগত ব্যথা বেদনার অতীত সঙ্গে করে এগিয়ে চলা এক সাহসী ইন্টেলিজেন্স অফিসার। আছে 'কার্বন'ও। যদিও 'কার্বন' তার আসল নাম না, তবে সে এই সিরিজের এক্স ফ্যাক্টর। বিহারিদের দোদুল্যমান জীবন আর পুলিশের তৎপরতায় এই ওয়ান্টেড কোড নেম 'কার্বন' এসে বিভক্ত করে দেয় বন্ধু ইকবাল আর ওয়াসিমকে। ওয়াসিমের মনেও আছে অসন্তোষ, যার বাবা আজীবন চান পাকিস্তানে তার কবর হোক। গল্প এগিয়ে যায় মারিয়ার ইনফর্মার হিসাবে ইকবালের মাধ্যমে বিহারি ক্যাম্পের তথ্য পাচার আর ওয়াসিম ইকবালের দ্বন্দ্বের জেরে অঘটন নিয়ে। পারিপার্শ্বে জড়িয়ে থাকা স্বাধীনতার পক্ষের মুক্তিযোদ্ধা আর কার্বনের পক্ষের ক্রিমিনালও আছে গল্পের ইট পাথর হয়ে।
'রিফিউজি'র সবচেয়ে বড় পজিটিভ দিক, যে থিমের ওপর গল্পের ভিত তার সাহসী রূপায়ন। গল্পটির সময়কাল দেখানো হচ্ছে স্বাধীনতার ৩৬ বছর পার হবার পর। আজ এই সময়ে দাঁড়িয়েও মিরপুর, মোহাম্মদপুরসহ কিছু জায়গায় একচ্ছত্র হয়ে বাস করা মানুষগুলোর কথা তাদের মুখ থেকে শোনা যায় নি। এই সিরিজে উর্দু হিন্দী মিশ্রনে কথা বলা মানুষের আওয়াজ, আর্তনাদ, চাহিদা, অভাব আর ভয়ংকর রূপ সব দেখানো হয়েছে খোলাখুলিভাবে।
তারপর অবশ্যই সিরিজের পারফরমেন্স অফ অ্যাক্ট! সোহেল মণ্ডলকে দেখে মনে হয়েছে নিজের মাঠে সমানে ছক্কা পেটাচ্ছেন। ভাষার দ্রুততা ঠিক রেখে আর দশটা বিহারি যুবকের মত ইকবাল চরিত্রে তাকে দেখা গেছে পুরোটা জুড়ে। তার যোগ্য সহযোগী 'ওয়াসিম' চরিত্রে শরীফ সিরাজ ছিলেন দুর্দান্ত । কে ভেবেছিল 'জ্যাকসন ভাই' এখানেও মিশে যাবেন চরিত্রে। নির্মাতা মূলত এই দুই চরিত্রে বিহারিদের অবস্থানের দুটো উল্টো পিঠ দেখিয়েছেন। একজন যখন চায় অধিকার আদায় করে বাঙালিদের সাথে মিশে যেতে, সেখানে অন্যজন চায় ফিরে যেতে পাকিস্তানে। 'মারিয়া' চরিত্রে অনেকদিন পর জাকিয়া বারী মম'কে পেলাম একটা রাফ এন্ড টাফ চরিত্রে। সাহস, অ্যাঙ্গার আর ইমোশনের দারুন মিক্স আপ যেন তিনি। তবে হতাশ হয়েছি আফজাল হোসেনের অসম্পূর্ণ ও অপ্রাপ্তিতে মোড়া 'কার্বন' চরিত্রে। তার আসা, যাওয়া আর গল্পে চরম প্রভাব থাকলেও ছিল না যথাযথ বিল্ড আপ। দ্বিতীয় সিজনে সেটার ইঙ্গিত থাকছে শুধু। এছাড়া বেশ ভাল করেছেন শাহেদ আলী, ঝুনা চৌধুরী, মনির খান শিমুল সবাই।
এই সিরিজে ভাষার সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে একজন ট্রেইনার রাখা হয়েছিল, যিনি ডাবিং পর্যন্ত ছিলেন উর্দু হিন্দী মিক্স বিহারিদের কথ্য ভাষার তদারকিতে। সিরিজ শো রানারদের একজনের নাম যেখানে আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ, সেখানে চাহিদা একটু বেশি থাকেই। গল্পে আহামরি কোন থ্রিল বা অনাকাঙ্ক্ষিত দৃশ্য নেই। আবার নেই কোন অভাবনীয় চমকও। তবে চিত্রায়ন আর সেট দেখে যে ভাবনার সৃষ্টি তা আপনাকেও নিয়ে যেতে পারে বিহারিদের সেই ঘিঞ্জি পট্টিতে।
সিরিজে গল্পের আবহে উঠে এসেছে মারাত্মক কিছু ইস্যু। বিহারিদের মাঝে এখনো পাকিস্তান প্রীতি, বাঙালিদের অবহেলা, নাগরিকত্ব নিয়ে জটিলতা, জেলের ভেতর কয়েদিদের যৌন নির্যাতন আর যুদ্ধাপরাধীদের পরের জেনারেশনের কালো দিক খুব ভালভাবে দেখানো হয়েছে 'রিফিউজি'তে।
সবমিলিয়ে ইমতিয়াজ হোসেন সজীবের দারুন নির্মাণ বলা যায় 'রিফিউজি'কে। অল্প জায়গা আর প্রতিকূল সেটের মাঝে সুন্দর চিত্রায়ন করে তুহিন তমিজুল প্রশংসার দাবিদার। সাদ এর 'রেহানা মরিয়ম নুর'এর কালার টোনের সাথে সাদৃশ্য অনেক দৃশ্যকে করেছে আরো দুর্দান্ত! মাত্র ১২৫ মিনিটে সত্যিকার অর্থে কম হয়েছে অনেক কথা বলার। তাই বাকি কথা জানতে অপেক্ষা থাকবে আরেক সিজনের।