পার্সি থিয়েটার থেকে পঞ্চায়েত: দ্য সিনেম্যাটিক জার্নি অফ রঘুবীর যাদব
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
ছোট বয়সেই হারিয়েছেন মা'কে। জীবিকার অন্বেষনে করেছেন বহুকিছু। আড়াই রূপির চাকরী থেকে 'পাপেট থিয়েটার' এর গায়ক... বিচিত্র অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন। সেসব থেকে একসময় পৌঁছেছেন অস্কারের মঞ্চে, তাও একাধিকবার। রঘুবীর যাদবের গল্পটা কি সিনেমার চেয়ে কোনো অংশে কম?
মধ্যপ্রদেশের খুব প্রত্যন্ত এক গ্রাম জবলপুরে এ গল্প শুরু। জবলপুর গ্রাম এতটাই প্রত্যন্ত, মনে হতে পারে- মহাকাল এখানে নির্দিষ্ট এক বয়স পার করার পরে আর বাড়েনি৷ থমকে গিয়েছে। ভুটানি সিনেমা 'লুনানা'য় যেমন 'লুনানা' গ্রাম সভ্যতা থেকে পিছিয়ে ছিলো কয়েক যুগ পেছনে, জবলপুরও তেমনি। যদিও আশেপাশের পৃথিবী কতটুকু এগোলো, গ্রামে বিজলিবাতি এলো কি না... সেসব নিয়ে জবলপুরের নিবাসীরা খুব যে একটা আগ্রহী, এমনও না। গ্রামের অধিকাংশ মানুষের পেশা কৃষিকাজ। দিনের প্রায় পুরোটাতে তারা ক্ষেত-খামারেই পড়ে থাকে। কায়ক্লেশে পরিশ্রমের পরে তাদের বিনোদন বলতে, দু'বেলা পেটপুরে ভাত আর অবসরে গান৷ হ্যাঁ, গান। 'গান' এই গ্রামের মানুষের বিনোদনের সবচেয়ে প্রিয় মাধ্যম। আশ্চর্যজনকভাবে, এ গ্রামের মানুষের গলাও বেশ সুরেলা। সবাই-ই গান গায়। মাটির গান,ভাটির গান, আধ্যাত্মিক গান, ভজন, কীর্তন... বাদ যায়না কিছুই। এবং এ গানের সূত্রেই গল্পে ক্রমশ প্রবেশ করে এই গ্রামের এমন এক কিশোর, যার জীবন-গল্পের বৈচিত্র্যের কাছে হার মানবে সিনেমার স্ক্রিপ্টও!
মাত্র বারো বছর বয়সেই ছেলেটি হারায় তার মা'কে। বাবার ঘরের দিকে টান কম। সে হিল্লিদিল্লি ঘুরে বেড়ায়। ঘরে সময় দেয় না। টাকাপয়সাও না। অগত্যা, ছেলেটিকে বাধ্য হয়ে নেমে পড়তে হয় জীবিকার সংস্থানে। নানারকম কাজ করতে করতে জীবন এগোয়। যদিও মাঝেমধ্যে কাজের চাপে হাঁপ ধরে। ওঠে নাভিশ্বাস। আর তখনই কিশোরটি আশ্রয় নেয় গানে। গান তার খুব প্রিয়। রূঢ় জীবন থেকে খণ্ড অবসরে সে তাই প্রায়ই ডুবে যায় প্রিয় গানের জলাশয়ে। গান গেয়ে টু-পাইস ইনকামও হয় মাঝেসাঝে। সে খোলে ছোটখাটো এক গানের দলও। যে গানের দল নিয়ে ছুটোছুটি চলে গ্রাম থেকে গ্রাম, গ্রামান্তর।
যদিও এরকম বাউন্ডুলে জীবনযাপনে ছেলেটির উচ্চ মাধ্যমিকের ফলাফল ভালো হয়না। বাবা সাফ জানিয়ে দেন, পড়াশোনার পেছনে তিনি আর একটা পয়সাও খরচ করবেন না। ছেলেকে বিয়ে দেবেন আর স্থানীয় এক ফ্যাক্টরিতে কাজ জোগাড় করে দেবেন। এসব শোনার পরে, 'শিরে সংক্রান্তি'র খড়গ মাথায় নিয়ে এক রাতে ছেলেটি ঘর ছাড়ে। পালায়। তার ইচ্ছে সে মিউজিশিয়ান হবে। সে কেন এই বয়সেই বিয়ে করে কারখানার শ্রমিক হবে? অগত্যা, পলায়নই শ্রেয়।
জীবনে প্রথমবারের মত ট্রেনে উঠে ললিতপুর এসে পুরোনো এক বন্ধুর সাথে হয়ে যায় সাক্ষাৎ। এ বন্ধুটির আবার আছে বিশেষ এক অভ্যাস। নিয়মিত বাড়ি থেকে পালানোর অভ্যেস৷ আমাদের গল্পের প্রোটাগনিস্ট কিশোরটি যখন বাড়ি থেকে প্রথমবারের মত পালিয়ে এসেছে, ততদিনে তার এই বন্ধুটি কমপক্ষে পঁচিশ বার পালিয়েছে গৃহাভ্যন্তরের নিরাপদ কোন থেকে!
যাই হোক, দুই বন্ধু মিলে এদিক-সেদিক ঘুরতে ঘুরতে পায় 'পার্সি থিয়েটার কোম্পানি'র খোঁজ। আড়াই রূপি করে দুটি টিকেট কেনা হয়। জীবনে প্রথমবারের মত থিয়েটারের ঝলমলে আলো। চোখ ছানাবড়া। সে চোখেই মুগ্ধ হয়ে থিয়েটারের প্লে দেখা। রাত বেশি হওয়াতে থিয়েটারের ভেতরেই কুন্ডলী পাকিয়ে ঘুম। এবং পরদিন সকালে উঠে কিশোরটির অবাক বিস্ময়ে আবিষ্কার- তার বন্ধু তাকে রেখে দিয়েছে চম্পট!
পকেটে টাকা নেই, পেটে খিদে... নিরূপায় ছেলেটি কি করবে ভাবতে ভাবতে চলে যায় 'পার্সি থিয়েটার কোম্পানি'র ম্যানেজারের কাছে। জানায়, সে গান গাইতে পারে। তাকে যেন এই থিয়েটারেই কোনো একটা কাজ দেয়া হয়। ম্যানেজার কিশোরটির গান শোনেন। বলাই বাহুল্য, যারপরনাই মুগ্ধ হন। পাশাপাশি, ছেলেটিরও জায়গা হয় থিয়েটারে। প্রতিদিনের বেতন আড়াই রূপি। শুরু হয় ছেলেটির নতুন জীবন৷ যে ছেলেটির নাম- রঘুবীর যাদব। যাকে সবাই চেনেন- ওয়ান অফ দ্য গ্রেটেস্ট অ্যাক্টরস অব দ্য সাব-কন্টিনেন্ট হিসেবে।
যাই হোক, 'পার্সি থিয়েটার' এ গান গেয়েই চলছিলো দিন। প্রতিদিনই নানারকম শো থাকতো। আর প্রতিটি শো'তেই রঘুবীরকে গান গাইতে হতো। নিজের এই দ্বিতীয় জীবনে বেশ সুখীও ছিলেন রঘুবীর। তবে, এরইমধ্যে, আচমকা সুযোগ আসে অভিনয়শিল্পী হিসেবে মঞ্চে আসার। চরিত্রটা এক সেপাইয়ের। এসে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। কাজ এটুকুই। এবং এই কাজটুকুই বেশ যত্ন নিয়ে করেন তিনি। আস্তে আস্তে রোল বাড়তে থাকে। একসময়ে এসে তিনি খেয়াল করেন, নির্বাক সেপাই থেকে ক্রমশ সবাক এক শিল্পীতেই রূপান্তরিত হয়েছেন তিনি।
'পার্সি থিয়েটার স্টুডিও' বন্ধ হয়ে যায় কয়েক বছরের মধ্যেই। রঘুবীরের পকেটেও ততদিনে জমেছে কিছু টাকা। সে চলে আসে লখনৌ। সেখানের এক 'পাপেট থিয়েটার'এ কাজ করেন কিছুদিন। এবং এখানে থাকা অবস্থাতেই খোঁজ পান এনএসডি (ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা) এর। 'পার্সি থিয়েটার স্টুডিও'তে থাকা অবস্থায় অভিনয়ের যে 'অআকখ' শিখেছিলেন, ভাবলেন- সেটাকে ঝালাই করার এই সুযোগ। এনএসডি'র ফর্ম ফিলাপ করেন। ভর্তি হয়ে যান। আবার শুরু করেন অভিনয়৷ চুটিয়ে অভিনয়। এখানে থাকা অবস্থাতেই তিনি একের পর এক সিনেমার অফার পান আর রিজেক্ট করতে থাকেন। থিয়েটার করে তিনি এতই মজা পাচ্ছিলেন, তার মনে হচ্ছিলো, সিনেমায় এ মজাটুকু তিনি পাবেন না।
তবুও শেষমেশ সিনেমায় তিনি নাম লেখালেন। তাও এমন এক সিনেমায়, যে সিনেমায় তিনিই লিড কাস্ট, এবং সেখানে তিনি করলেনও অসাধারণ অভিনয়। সিনেমার নাম- মাসি সাহিব। যে সিনেমার 'ফ্রান্সিস মাসি' চরিত্রে এমনভাবেই মিশে গেলেন তিনি, পেলেন 'সিলভার পিকক' এর মত প্রেস্টিজিয়াস অ্যাওয়ার্ড৷ পেলেন 'ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল' এর 'ক্রিটিকস প্রাইজ' অ্যাওয়ার্ডও। এবং, যে দুটি পুরস্কারের কথা বলা হলো এখানে, সে দুটির আপেক্ষিকতা ও গুরুত্ব ঠিক কতটা, তা সচেতনমাত্রেরই জানা। সে প্রসঙ্গে বাক্যব্যয় তাই অবান্তর।
রঘুবীর যাদব প্রথম সুযোগেই 'মাসি সাহেব' সিনেমায় যেভাবে বাজিমাত করলেন, এরপর পাদপ্রদীপের আলো তার উপরে যে গভীরভাবে নিবদ্ধ হবে, তা জানা ছিলোই। প্রথম সিনেমা, সেখানেই এত বড় বড় অর্জন...রঘুবীর যাদব যদিও তখন ব্যাপক চর্চিত এক নাম, তবুও মানুষটি পা মাটিতেই রাখলেন বরাবর। জনপ্রিয়তার সুবাদে যা-তা কাজে অভিনয় করতে চাইলেন না৷ অজস্র সিনেমার স্ক্রিপ্ট একবাক্যে নাকচ করলেন। বললেন-
যে চরিত্রের ব্যথা নেই, যে চরিত্র করতে গিয়ে আমি যন্ত্রণা পাবোনা... সে চরিত্র করার আবশ্যকতা কোথায়? আমার কাছে সিনেমার দুইটা সংজ্ঞা- ভালো সিনেমা আর খারাপ সিনেমা। খারাপ সিনেমায় আমি অভিনয় করবো না।
তিনি করলেনও না। ভেবেচিন্তে নিতে থাকলেন কাজ। এবং, এ কারণেই, যখন যে চরিত্রে তিনি অভিনয় করলেন, সেটা অভিনয়ের গণ্ডি ছাপিয়ে চলে গেলো বহুদূর। সে 'সালাম বোম্বে'র নেশাগ্রস্ত 'চিল্লুম' হোক কিংবা 'সন্দীপ অওর পিঙ্কি ফারার' এর সেই খিটখিটে শিক্ষক... তিনি চরিত্রের মাত্রাজ্ঞান বুঝে প্রতিবারই এত অসাধারণ, তার করা চরিত্রের রানটাইম কম অথবা বেশি, তা কখনোই প্রাসঙ্গিক হলো না৷ প্রাসঙ্গিক হলো তার অভিনয়জনিত মুগ্ধতাই। তিনি নিজেই যেমন বলেন-
আমি আসলে এত এত কাজ করেছি, এতরকম প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে গিয়েছি, যাত্রাপথে এত এত মানুষের সাথে পরিচয় হয়েছে, তাদেরকে এত কাছ থেকে দেখেছি... সেসবের বাইপ্রোডাক্ট হিসেবেই অভিনয় সড়গড় হয়ে গিয়েছে।
সে কারণেই হয়তো, 'পঞ্চায়েত' এর 'প্রধানজী' হয়ে যখন তিনি আসেন, তখন তাকে আসলেই মনে হয়, 'ফুলেরা' নামক পাণ্ডববর্জিত কোনো গ্রামের প্রধান, যিনি বহুকাল ধরে মিশে আছেন এই গ্রামের জল-কাদা-হাওয়ার সাথে। যার অভিনয় দেখে মনে হয় না, অভিনেতা 'রঘুবীর যাদব' কোনো এক গ্রামের প্রধানের চরিত্রে অভিনয় করছেন! এই যে, চরিত্রের সুখ-দুঃখ-বিষাদের সাথে নিজেকে এক করে ফেলা, চরিত্রের খোলসে এভাবে পুরোপুরি ঢুকে নিজের অস্তিত্বকে শূন্য করে দেয়া... সেখানেই এই ছোটখাটো মানুষটি বরাবর গড়ে দেন ব্যবধান।
তিনি এখন পর্যন্ত মোট আটবার নানা নির্মাণের সুবাদে অস্কারের মঞ্চে গিয়েছেন। পেয়েছেন দেশি-বিদেশি অজস্র পুরস্কার। তবু, এসবের কিছুকেই তিনি আনেননি নিজের জীবনে। তার একান্ত ব্যক্তিগত জীবনে তিনি এখনও জবলপুরের সেই ছোট্ট কিশোর, যে একটা স্যান্ডোগেঞ্জি আর হাফপ্যান্ট পড়ে গেয়ে যাচ্ছে 'শিরি ফরহাদ' নাটকের গান। যার ইচ্ছে, গান গেয়েই একদিন সবাইকে মুগ্ধ করবেন তিনি। যদিও, তিনি মুগ্ধ করেছেনও। তবে, যতটা না গান দিয়ে, তারচেয়েও বেশি অভিনয়ে। এবং সেখানেই তার মুন্সিয়ানা। ওস্তাদের মার। এবং, সেখানেই তিনি একমেবাদ্বিতীয়ম!