দেশে একের পর এক ওটিটি প্ল্যাটফর্ম সৃষ্টির যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে, তা খানিকটা কমিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা যদি ভালো নির্মাণের প্রতিযোগিতায় নামেন, তাহলে তা সবার জন্যেই স্বস্তির। ক্রাইম, সাসপেন্স কিংবা রোমান্স নিয়ে নির্মাণ হচ্ছে। হোক। পাশাপাশি স্বাদবদলের জন্যে যদি 'পিরিয়ড ড্রামা' জনরায় মুক্তিযুদ্ধ নিয়েও মানসম্মত একটা ওয়েব সিরিজ হয়, ক্ষতি কী?

মোঘল সাম্রাজ্যের বৈচিত্র্যময় ইতিহাসকে উপজীব্য করে খুব দারুণ এক ফিকশন সিরিজ লিখেছিলেন অ্যালেক্স রাদারফোর্ড;  'অ্যাম্পায়ার অব দ্য মোঘল' শিরোনামে। সেই সিরিজের প্রথম বই 'অ্যাম্পায়ার অব দ্য মোঘলঃ রাইডার্স ফ্রম দ্য নর্থ' অবলম্বনে স্ট্রিমিং সাইট ডিজনি প্লাস হটস্টারে মুক্তি পাওয়া ভারতীয় ওয়েব সিরিজ 'দ্য এম্পায়ার' নিয়েও সাম্প্রতিককালে কথাবার্তা কম হয়নি।  মুক্তির আগে থেকেই বিস্তর আলোচনা হয়েছে এই ওয়েব সিরিজের নানা অনুষঙ্গ নিয়ে। বিশাল বাজেট, বিস্তীর্ণ সেট ডিজাইন, মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট বাবরের বর্ণময় জীবন... এই নির্মাণ নিয়ে দর্শকের আগ্রহ এতটাই তুঙ্গে ছিলো কেউ কেউ এই সিরিজকে 'ভারতের গেম অব থ্রোন্স' নামেও ডাকা শুরু করেছিলো।

আশা জাগিয়েছিলো 'দ্য এম্পায়ার!' 

তবে সবমিলিয়ে এই ওয়েব সিরিজের অভিজ্ঞতা খুব একটা সুখকর হয় নি। আকাশকুসুম প্রত্যাশার সাথে প্রাপ্তির মেলবন্ধন খাপ খায়নি। অতীতের রীতি মেনে ইতিহাস নিয়ে গোঁজামিল লক্ষ্য করা গিয়েছে কিছু কিছু ক্ষেত্রে। অর্থের কারিকুরিতে সেট ডিজাইন হয়তো হয়েছে চমৎকার, কিন্তু মূল গল্প ক্রমশ হয়েছে অচ্ছুৎ। সবমিলিয়ে তাই 'দ্য এম্পায়ার' রেকোমেন্ড করার মত কোনো নির্মাণ না। কিন্তু তবুও এই ওয়েব সিরিজের এক চমৎকারিত্ব আছে। সে চমৎকারিত্ব প্রথাগত গণ্ডির বাইরে এসে ভাবার চমৎকারিত্ব। ওয়েব কন্টেন্ট বলতেই যেখানে ক্রাইম, থ্রিলার, সাসপেন্সের বাড়াবাড়ি আধিক্য, সেখানে এই নির্মাণ দর্শকের সামনে 'পিরিয়ড ড্রামা' জনরা নিয়ে হাজির হওয়ার যে সাহস দেখিয়েছে, তা নিঃসন্দেহে ভূয়সী প্রশংসার।  

উপমহাদেশের প্রেক্ষাপটে 'পিরিয়ড ড্রামা' নিয়ে কাজ করা বরাবরই ঝুঁকিপূর্ণ। এর পেছনে কারণও আছে বেশ কিছু। প্রথমত- রিসার্চ। নিরপেক্ষ পিরিয়ড ড্রামা বানানোর জন্যে, ইতিহাসের বিশেষ কোনো সময়কে নিখুঁতভাবে পর্দায় তুলে আনার জন্যে গভীর গবেষণার প্রয়োজন হয়। হলিউড সহ অন্যান্য ইন্ডাস্ট্রিতে রিসার্চের এই কাজ করার জন্যে আলাদা টিম থাকে। আমাদের এই ভূখণ্ডে সেসবের বালাই নেই। যদি এরকম কোনো টিম থাকতো, তাহলে 'পিরিয়ড ফিল্ম মানেই ইতিহাস-বিকৃতি' নামক ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠিত হতো না। দ্বিতীয় কারণ- বাজেট। পিরিয়ড ফিল্মের জন্যে যে বাজেটের প্রয়োজন হয়, সে বাজেট উপমহাদেশের যেকোনো নির্মাণের প্রেক্ষাপটে বরাবরই বেশি। সত্যজিৎ রায় একবার আক্ষেপ করে বলেছিলেন-

টাকাপয়সার হাহাকারের মধ্যেও ভালো সিনেমা কিভাবে বানাতে হয়, তা ভারতবর্ষের পরিচালকদের  কাছ থেকে শেখা উচিত সবার।

সত্যজিৎ রায়ের কথাটুকু এখনও প্রাসঙ্গিক। গড়পড়তা সিনেমার বাজেট গোছাতেই যেখানে হিমশিম খান নির্মাতারা, সেখানে পিরিয়ড ফিল্মের বাজেট... সোনার পাথর বাটির মতনই এক বিষয়। অথচ ঠিকঠাক বাজেট পেলে উপমহাদেশেও যে বিশ্বমানের পিরিয়ড ফিল্ম হতে পারে, সেজন্যে বেশি দূরে যেতে হবে না। সুজিত সরকারের 'সরদার উধম' দেখলেই বুঝতে পারা যাবে সত্যিটা।

মুগ্ধ করেছে 'সরদার উধম!'

তাও আমরা প্রতিবছরই কমবেশি পিরিয়ড ফিল্ম দেখি উপমহাদেশে। ইতিহাস বিকৃতি হোক আর যা-ই হোক, এই ভূখণ্ডের সিনেমায় 'পিরিয়ড ড্রামা' জনরা নতুন কিছু না। কিন্তু যদি ওটিটি প্ল্যাটফর্মে আসা ওয়েব সিরিজগুলোর কথা চিন্তা করি, সেখানে 'পিরিয়ড ড্রামা'র অভাব বেশ ভালোভাবেই প্রকট। যদিও 'দ্য এম্পায়ার' এর মতন কাজ হয়েছে। কিন্তু তা মোটেও যথেষ্ট নয়। কেন ওয়েব সিরিজে 'পিরিয়ড ফিল্ম' আসছে না, এর পেছনেও আগের কারণগুলোই আসবে। রিসার্চের অভাব, বাজেট। তাছাড়া সিরিজে 'পিরিয়ড ড্রামা' আনতে গেলে যে প্রকাণ্ড রিসার্চের প্রয়োজন এবং প্রত্যেক পর্বের ডিজাইন কিরকম হবে এবং কিভাবে পর্ব শুরু হবে এবং কোন ক্লিফ হ্যাঙ্গারে পর্ব শেষ হবে, এসবের অভিনবত্ব নিয়ে গবেষণা করার মত যে দক্ষ জনশক্তির প্রয়োজন... সেরকম মানুষের অনুপস্থিতি প্রকট এই ইন্ডাস্ট্রিতে।

তবে আশার কথা এটাই, এসব বৈপরীত্য সামলেও ওয়েব সিরিজে 'পিরিয়ড ড্রামা' নিয়ে ভাবছে উপমহাদেশের অনেক নির্মাতা। 'দ্য এম্পায়ার' এর কথা আগেই বলা হয়েছে। পাশাপাশি বলা যেতে পারে 'বোসঃ ডেড অর অ্যালাইভ', 'আ সুইটেবল বয়' 'রামযুগ' কিংবা 'ছাত্রাসাল' এর কথাও। ওয়েব সিরিজে 'পিরিয়ড ড্রামা' এক্সিকিউট করার যে প্রতিবন্ধকতা, তা ক্রমশ 'পিরিয়ড ড্রামা' নির্মাণের মাধ্যমেই কাটিয়ে উঠবেন সংশ্লিষ্টরা, এ প্রত্যাশা করাই যায়। এবং ঠিক এভাবেই ওয়েব সিরিজেও বিশেষ এ জনরা'কে প্রতিষ্ঠিত করা গেলে তা যে আখেরে সংস্কৃতিপ্রেমীদের জন্যেই সুসংবাদ হবে, তা লেখাই বাহুল্য।

'বোসঃ ডেড অর অ্যালাইভ' এর নির্মাণেও ছিলো চমৎকারিত্ব! 

সে সাথে এটাও প্রত্যাশা থাকবে, বাংলাদেশের ওটিটি প্লাটফর্মগুলোতেও 'পিরিয়ড ড্রামা' নিয়ে নিয়মিত কাজ হবে। দেশে একের পর এক ওটিটি প্ল্যাটফর্ম সৃষ্টির যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে, তা খানিকটা কমিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা যদি ভালো নির্মাণের প্রতিযোগিতায় নামেন, তাহলে তা সবার জন্যেই স্বস্তির। ক্রাইম, সাসপেন্স কিংবা রোমান্স নিয়ে নির্মাণ হচ্ছে। হোক। পাশাপাশি স্বাদবদলের জন্যে যদি 'পিরিয়ড ড্রামা' জনরায় মুক্তিযুদ্ধ নিয়েও এক মানসম্মত ওয়েব সিরিজ হয়, ক্ষতি কী? যেহেতু এই জনরায় এখনো অনেক কিছু আবিষ্কার করার বাকি, তাই প্রতিভাবান নির্মাতারা এদিকে দৃষ্টি ফেরালে, তা যে অসাধারণ কিছুর সূচনা করবে, তাতে কারো কী কোনো সন্দেহ আছে? বা, সন্দেহ থাকা কি আদৌ উচিত? 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা