এই যে এমপ্যাথির অভাব, এই যে ঘৃণার এক অদৃশ্য দেয়াল, এতেই গোটা সমাজের পলেস্তারা খসে পড়ছে। কবে সেদিকে খেয়াল করব, বলেন তো?

একটা জিনিস খেয়াল করলে দেখবেন, মিডিয়ার সেলিব্রেটিদের সঙ্গে আমাদের অনেকেরই (অধিকাংশেরই?) সম্পর্ক অনেকটাই অশ্রদ্ধার। যেমন ধরুন, একজন অভিনেতা বা অভিনেত্রীর সংসার ভেঙ্গে গেলো। বেশিরভাগ দর্শকেরই মন্তব্য থাকবে, ‘বেশ হয়েছে, মিডিয়ায় কি সংসার টেকে নাকি?’ অথবা মনে করুন, একজন অভিনেত্রী সহিংসতার শিকার হয়েছেন। বেশিরভাগ দর্শকেরই মন্তব্য থাকবে, ‘ওমা, মিডিয়ায় কাজ করো, এসবই তো হবে!’ আমরা এমন একটা 'চমৎকার' সমাজ গড়ে তুলতে পেরেছি যেখানে ভাবনাটা এমন, অভিনেতা বা অভিনেত্রীরা ভালো পরিবারের নন। একজন মধ্যবিত্ত পরিবারে অভিনয়কে পেশা হিসেবে বেছে নেয়া যেন নিষিদ্ধ জগতের ব্যাপারস্যাপার!

কাল ঘটে যাওয়া দূর্ঘটনা নিয়ে মানুষের প্রতিক্রিয়া দেখেই মনে হলো কিছু লিখি। চরকির ওয়েব ফিল্ম ‘নেটওয়ার্কের বাইরে’ বেশ প্রশংসিত হলো দর্শকের মাঝে। আলোচনা, সমালোচনা হলো। একদমই অনাকাঙ্খিতভাবে এই ফিল্মে কাজ করা চারজন গভীর রাতে রাজধানীর গুলশানে সড়ক দূর্ঘটনার শিকার হলেন। মারাত্মকভাবে আহত হলেন দুজন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মচ্ছব শুরু হয়ে গেলো, ‘এত রাত্রে এরা কী করতেসিলো?’ ‘মিডিয়ার লোক তো হেহেহে, বুঝেন না?’ ‘রাইতের বেলায় মাতাল হইলে অ্যাক্সিডেন্ট তো হইবোই’। মনে হচ্ছে যেন ক্ষোভ উগড়ে দিচ্ছে সবাই।

নেটওয়ার্কের বাইরে ওয়েব ফিল্মে এই তরুণ অভিনয়শিল্পীদের অভিনয় আলোচিত হয়েছে

অথচ এই এরাই মাত্র কদিন আগে, এক সপ্তাহও পেরোয়নি তাদের অভিনীত দেড় ঘন্টার ফিল্মটি দেখেছে। যেই দেড় ঘন্টার ফিল্মটি তৈরি করতে দিনের পর দিন অভিনেতাদের ঘরের বাইরে থাকতে হয়েছে, বাসে, গাড়িতে, ইনডোরে, আউটডোরে শ্যুট করতে হয়েছে। তারও আগে রাতের পর রাত স্ক্রিপ্ট ও অভিনয়ের ব্যাপারে গ্রুমিং সেশনে থাকতে হয়েছে। কত রাত করে তাদের ঘরে ফিরতে হয়েছে। এসব কিছু হুট করে হারিয়ে গিয়ে আমাদের সেই আদিম ক্ষোভ উগড়ে পড়লো!

এসব নিয়ে কথা বলতে হবে। আত্মশুদ্ধির জন্য আত্মসমালোচনা করা উচিত। নিজেকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করানো উচিত। একজনের কাজ নিয়ে আমার আপত্তি থাকতে পারে, তাকে আমার ভালো না লাগতেও পারে। তার জীবনযাপনের ধরণে আমার মানসিক সমর্থন নাও থাকতে পারে। কিন্তু একজন মানুষের অসুস্থতায়, দুর্ঘটনায় কিংবা চরম খারাপ অবস্থায় তার উপর ক্ষোভ উগড়ে দেয়া, নেতিবাচকতা ছড়ানো এবং যাচ্ছেতাই মনোভাব পোষণ করা মূলত আমাদের মানসিকতার দেউলিয়াপনা ছাড়া কিছুই বোঝায় না।

এই যে এমপ্যাথির অভাব, এই যে ঘৃণার এক অদৃশ্য দেয়াল, এতেই গোটা সমাজের পলেস্তারা খসে পড়ছে। কবে সেদিকে খেয়াল করব, বলেন তো?


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা