যে মানুষগুলো ভারী অস্ত্রচালনা শিখছে, মৃত্যুকে শিখছে, তাদেরকেই পরিচালক দেখিয়েছেন সাধারণ আর দশটা মানুষের মতো যে কীনা ইঞ্জেকশন দিতে গেলে ভয় পায়, অস্ত্র চালাতে গিয়ে হাঁপিয়ে ওঠে, বিশ্রাম চায়; পরিবারের খোঁজ নিতে গিয়ে কাঁদে। এই যে মানুষগুলো, যারা নীল মুকুট মাথায় দিয়ে নিজেদেরকে সঁপে দিলো তাদের অজানা গল্পটাই বলতে চেয়েছেন কামার আহমাদ সাইমন...

“Until the lioness starts telling her own story, the hunter will always be the hero” 

-Old African proverb

ইতিহাসের পাতা ঘেঁটে আসলে দেখা যাবে আমরা সবসময়ই শিকারিদের গল্প শুনে এসেছি। এই শিকারি কখনো রাজা, কখনো শোষক, কখনো সমাজ, কখনো সংস্কার; কিন্তু মানুষের গল্পটা আর শোনা হয় নি। শোনা হয় নি যারা শিকারির শিকার হয় তাদের সারভাইভালের গল্প। 

নির্মাতা কামার আহমাদ সাইমন একবার প্লেনে করে যাচ্ছিলেন তখন দেখতে পেলেন এক বিমানবালা এক নারীকে বারবার বলছেন ফোন রাখার জন্য। তখন তিনি মন দিয়ে ঐ নারীর কথা শুনলেন ফোনে- 'আব্বু, তুমি একদম দুষ্টামি করবানা। রাস্তায় দৌড়াইয়া যাবা না। বড়দের কথা শুনবা, খাওয়া দাওয়া করবা ঠিকমতো। তোমার আব্বারে দাও। শুনেন, বাচ্চাটার সাথে রাগারাগি কইরেন না। ছাইপাঁশ খাইয়েন না, কাজের খোঁজ কইরেন। এক বছরই তো, চইলা আসমু। টাকা-পয়সা যা ই পাই, নতুন কইরা শুরু করমু আমরা। আপনি বাচ্চাটার গায়ে হাত তুলবেন না। কথা দেন আপনি, কথা দেন...'

সেখান থেকেই কামার আহমাদ সাইমন 'নীল মুকুট' এর গল্পের কথা ভাবলেন। তার ভাবনায় তিনি খুঁজে পেলেন জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে যাওয়া নারী পুলিশদের গল্প। পরিবার-পরিজন থেকে দীর্ঘ সময়ের জন্য দূরে চলে যাওয়া এই নারীরা প্রথমে শেখেন পুলিশ হয়ে উঠতে, কাঁধে ভারী অস্ত্র চেপে বসলে টের পান পথটা বন্ধুর। কখনো ব্যথায় কুঁকড়ে যেতে হয়, কখনো সহকর্মীদের সাথে হেসে কাটাতে হয়। কিন্তু মন পড়ে থাকে ঐ গ্রামে, যেখানে সে যেতে পারবে আরও অনেক সময় পর। 

বিদেশ-বিভূঁইয়ে যাত্রা করা লাগে, পরিবারকে আশ্বস্ত করা লাগে যে কিছু হবে না। আফ্রিকা বা উত্তর আমেরিকার কোন এক দেশে, অপরিচিত পরিবেশে যাপন করতে হয় কঠিন দিনগুলো। কখনো মৃত্যুর সম্মুখে দাঁড়াতে হয়, কখনো একঘেয়ে ক্লান্তিকর দিনটি শেষ হতে চায় না। ভিডিও কলের আবছা ছায়ায় প্রিয়জনদের দেখে তৃপ্তি খুঁজে নিতে হয়। এই যে মানুষগুলো, যারা নীল মুকুট মাথায় দিয়ে নিজেদেরকে সঁপে দিলো তাদের অজানা গল্পটাই বলতে চেয়েছেন কামার আহমাদ সাইমন।

নীল মুকুট ডকু-ড্রামার কিছু দৃশ্য 

নীল মুকুট মূলত বাংলাদেশ পুলিশের নীল হেলমেট/টুপির রূপক। আরও অনেকদিক থেকে মেটাফোরিক্যাল, নীল ব্যথার রঙ আর মুকুট পুরো রাজ্যের ভার যেন দিয়ে যায় মাথায়। আমাদের পুলিশ বাহিনী সে ভার নিয়েই থাকেন, কখনো ব্যথায় নীল হন। তাদের ব্যক্তিগত জীবনের দুঃখগাঁথা কেউ দেখে না, কেউ শোনে না। 

নীল মুকুট ডকু-ড্রামায় কামার আহমাদ সাইমন ক্যামেরা হাতে যেন সঙ্গী হয়ে গিয়েছিলেন বাস্তব চরিত্রগুলোর সাথে। পর্দায় থাকা মানুষগুলো অভিনেতা নয় বাস্তবেরই পুলিশ কর্মকর্তা অধিকাংশ। তাদের সাথে একাত্ম হয়ে গিয়েছিলেন সাইমন। তাদের হাসি, কান্না খুব কাছ থেকে দেখিয়েছেন যেন দর্শক নিঃশ্বাস দূরত্বে থেকে অনুভব করতে পারে। যে মানুষগুলো ভারী অস্ত্রচালনা শিখছে, মৃত্যুকে শিখছে, তাদেরই দেখিয়েছেন সাধারণ আর দশটা মানুষের মতো যে কীনা ইঞ্জেকশন দিতে গেলে ভয় পায়, অস্ত্র চালাতে গিয়ে হাঁপিয়ে ওঠে, বিশ্রাম চায়; পরিবারের খোঁজ নিতে গিয়ে কাঁদে।

কামার আহমাদ সাইমনের এই অনবদ্য ডকুড্রামা মুগ্ধ করেছে অনেক দিক থেকেই। ডকু স্টাইলের কাজ আমাদের দেশে হয় ই না বলতে গেলে। হলেও সেখানে কেন যেন পাশ্চাত্যের ছায়াই বেশি থাকে। নীল মুকুট একান্তই আমাদের গল্প, আমাদের চারপাশের গল্প, গল্প না আসলে বাস্তবতাই। সে বাস্তবতাকেই পর্দায় নিয়ে এসেছেন নীল মুকুটের কলাকুশলীরা।

একটু বাড়তি প্রশংসা নীল মুকুটের পোস্টারের জন্য। এতো কালারফুল, মিনিংফুল, ডায়ন্যামিক পোস্টার হ্যান্ডস ডাউন আমি আগে দেখিই নি কখনো। অসামান্য একটা পোস্টার, জাস্ট ব্রিলিয়ান্ট!


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা