নায়লা আজাদ নূপুর: হলিউডি সিনেমায় অভিনয় করেছেন যে বাংলাদেশী অভিনেত্রী!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

দীপিকা-প্রিয়াঙ্কাদের হলিউডে অভিনয়ের সংবাদ শুনে উচ্ছ্বসিত হয় অনেকে। অথচ অনেকেই জানেন না যে, আমাদের দেশের একজন অসাধারণ অভিনেত্রী হলিউডের সিনেমায় অভিনয় করেছেন সেই নব্বইয়ের দশকেই! তিনি নায়লা আজাদ নূপুর...
বলিউডের প্রিয়াঙ্কা চোপড়া বা দীপিকা পাডুকোন হলিউডের কোনো প্রজেক্টে কাজ করলে ভারত তো বটেই আমাদের দেশ থেকে তাদের শুভেচ্ছা জানানো হয়, তাদের ভক্তরা খুশি হয়। তবে অনেকেই জানেন না যে, আমাদের দেশের একজন অসাধারণ অভিনেত্রী হলিউডের সিনেমায় অভিনয় করেছেন সেই নব্বই দশকেই। তিনি নায়লা আজাদ নূপুর।
নায়লা আজাদ নূপুর সত্তর এবং আশি দশকের দর্শকদের কাছে একটি নন্দিত অভিনেত্রী। বলা হয়ে থাকে সত্তর এবং আশির দশকে নূপুর টেলিভিশন নাটকে অন্যরকম সৌন্দর্য্য, অসাধারণ বাচনভঙ্গি, ফ্যাশন সেন্স, এবং অভিনয় দক্ষতা দিয়ে নিজেকে নিয়ে গিয়েছিলেন এক অন্য উচ্চতায়। অনেকেই জানেন না যে, তিনি হলিউডের বেশক'টি সিনেমায় অভিনয় করা প্রথম বাংলাদেশী অভিনেত্রী। এই সময়ের অনেকের কাছেই অজানা এবং অচেনা এই গুনী এবং নন্দিত অভিনেত্রীকে নিয়ে এই বিশেষ ফিচার।
১৯৫৮ সালের ফেব্রুয়ারীতে ঢাকায় জন্মগ্রহণ করা নায়লা আজাদ নূপুর ১৯৭৩ সালে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় সারাদেশের মধ্যে বানিজ্য শাখায় মেধা তালিকায় প্রথম স্থান লাভ করেন তিনি। টেলিভিশন নাটকে সেই সময় রাইসুল ইসলাম আসাদ, সুবর্না মুস্তফা, আফজাল হোসেন, শম্পা রেজা, মিতা চৌধুরী, পীযুষ বন্ধ্যোপাধ্যায় সহ বেশকিছু তরুন এবং সম্ভাবনাময় শিল্পীর আগমনে মঞ্চ, টেলিভিশন এবং সিনেমা প্রতিটা মাধ্যমেই একটা নতুন ঢেউয়ের আগমন হয়েছিলো। এই নামগুলোর প্রতিটা নামই পরবর্তীতে তাদের নিজ নিজ স্বকীয়তা দিয়ে জায়গা করে নিয়েছিলো আমাদের মিডিয়া জগতে।

সেই ধারাবাহিকতায় অন্যতম সফল একটি নাম নায়লা আজাদ নূপুর। ১৯৭৪ সালে ‘রত্নদ্বীপ’ নাটকে শিশুশিল্পী হিসেবে অভিনয়ের মাধ্যমে টেলিভিশন নাটকে অভিনয় শুরু করেন তিনি। পরবর্তীতে একে একে ভালোবাসি ঘাস, ডুবুরি, পটভূমি পরিচিতি, তুমি, শেষ বংশধর, ক্যাকটাস, সোনালি এক চাবি, মাছি, নির্জন জনারন্যে সহ আরো অনেক নাটকে অসাধারণ অভিনয় দক্ষতা দিয়ে জয় করেছিলেন দেশের মানুষের মন। আফজাল হোসেনের সাথে জুটিও বাংলা নাটকে আলোচিত এক জুটি।
তবে বিনোদনের সবচেয়ে বড় মাধ্যম মানে চলচ্চিত্রেও নায়লা আজাদ নূপুর নিজের ছাপ রেখেছেন। অল্প কিছু সিনেমায় অভিনয় করলেও প্রতিটি কাজই নন্দিত এবং প্রশংসীয়। ১৯৮০ সালে তিনি প্রথমবার সালাউদ্দিন জাকীর পরিচালনায় ‘ঘুড্ডি’ সিনেমায় অভিনয় করেন তিনি। সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকা সিনেমা হিসেবে ‘ঘুড্ডি’ সিনেমাপ্রেমীদের কাছে এখনো এক বিস্ময়ের নাম। সহশিল্পী হিসেবে সেই সিনেমায় ছিলেন রাইসুল ইসলাম আসাদ, সুবর্না মুস্তফা।
তবে সবার ভীড়েও নজর কেড়েছিলেন নূপূর। তার গ্ল্যামার, সৌন্দর্য্য এবং অভিনয় প্রশংসা কুড়ায় সকলের। দুই বছর বিরতি দিয়ে ১৯৮২ সালে আলমগীর কবীরের ‘মোহনা ’ সিনেমায় তিনি আবারো জানান দেন যে, তিনি অসাধারণ। এরপরে শেখ নিয়ামত আলীর ‘দহন’ এবং যৌথ প্রযোজনার ‘শক্তি’ সিনেমায় তার অভিনয় প্রশংসিত হয়। অনেক বছর বিরতি দিয়ে ‘কিত্তনখোলা’, ‘বেঙ্গলি বিউটি’ সিনেমাতেও তার উপস্থিতি নজর কেড়েছে৷
নাটক এবং সিনেমাতে নায়লা আজাদ নূপুর নিজের দক্ষতার প্রমান দেবার পাশাপাশি আমাদের দেশের সেই সময়ের মঞ্চ নাটকেও আলো ছড়িয়েছেন। ঢাকা থিয়েটারের নিবেদিতপ্রাণ কর্মীদের একজন তিনি। মুনতাসির ফ্যান্টাসি, কেরামত মঙ্গল, শকুন্তলা, ফনিমনসা সহ বেশকিছু নন্দিত এবং তুমুল জনপ্রিয় নাটকে অভিনয় করেন তিনি। ছোট্ট বেলায় বাফায় নাচ শিখতেন তিনি। পরবর্তীতে মঞ্চ, নাটক এবং সিনেমায় অভিনয় করার সময় এই নৃত্য পারদর্শীতা তাকে এক্সপ্রেশন দিতে সহায়তা করেছিলো বলেও জানান তিনি।
নূপুরের থিয়েটারে আগ্রহ ছিলো বরাবরই। তাই ভারতের পুনে শহরে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে থিয়েটার সম্পর্কিত একটি আট মাসের ডিপ্লোমা সম্পন্ন করেন তিনি। থিয়েটার নিয়ে উচ্চশিক্ষার আগ্রহের কারনে ১৯৮৯ সালে স্কলারশিপ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের একটি কলেজে অনার্স করার সুযোগ পেয়ে আমেরিকায় পাড়ি জমান তিনি। দেশে তখন তিনি অন্যতম জনপ্রিয় একজন অভিনেত্রী, তবে নাম, যশ,খ্যাতি পেছনে ফেলে তিনি আমেরিকায় চলে যান নিজের স্বপ্ন সত্যি করার জন্য। পরবর্তীতে ১৯৯৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া থেকে থিয়েটার ফিল্ম এবং টেলিভিশনে মাষ্টার্স ডিগ্রী লাভ করেন।

এরমাঝেই আমেরিকায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন তিনি। তবে অভিনয়কে বিদায় জানাননি নূপুর কখনোই। অভিনয় করেছেন বেশকিছু শর্টফিল্ম, স্টেজ শো এবং থিয়েটারে। তবে অভিনেত্রী হিসেবে তিনি আলাদাভাবে নজর কাড়েন ২০০৯ সালে ‘ক্রসিংওভার’ সিনেমায় অভিনয় করে। হ্যারিসন ফোর্ড এর মতো নামকরা অভিনেতার পাশাপাশি একই সিনেমায় তার অভিনয় প্রশংসিত হয়। হলিউডের আরেকটি আলোচিত সিনেমায় তাকে দেখা যায় নূপুরকে। ১৯৯৮ সালে ‘ষ্ট্রম ইন দ্যা আফটারনুন’ সিনেমাতেও তিনি নজর কেড়েছিলেন। এছাড়া তিনি অভিনয় করেছেন দুটি আমেরিকান টিভি সিরিজে।
স্থায়ীভাবে আমেরিকায় বসবাস করলেও যখনই দেশে এসেছেন গল্প এবং চরিত্র পছন্দ হলে কাজ করেছেন সিনেমায়। কিত্তনখোলা, বাঙালি বিউটি, ঘাসফুল সিনেমায় তার কাজ করা এভাবেই। ২২ বছরের লম্বা বিরতি দিয়ে ২০১১ সালে তিনি অভিনয় করেন নূরল ইসলাম আতিকের পরিচালনায় ধারাবাহিক নাটক ‘যাদুর শহর’ এ। ২৫ বছরের প্রবাস জীবন কাটিয়ে বর্তমানে দেশেই আছেন এই জনপ্রিয় অভিনেত্রী। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পাশাপাশি মঞ্চেও সময় দিচ্ছেন নায়লা আজাদ নূপুর। ইতিমধ্যে বেশকটি মঞ্চ নাটকে নির্দেশনাও দিয়েছেন তিনি। সাথে সাথে কাজ করছেন একটি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ফার্মে।
এখন খুব ধীরলয়ে হলেও আস্তে আস্তে বদলাচ্ছে বিনোদনের মাধ্যম এবং গল্প বা কনটেন্ট। নায়ক-নায়িকা নির্ভর গল্প থেকে আস্তে আস্তে অন্যরকম অনেক কাজ হচ্ছে আমাদের মিডিয়াতে৷ এই সময়ে নায়লা আজাদ নূপুরের মতো প্রতিভাবান এবং দক্ষ অভিনেত্রীদের কাজে লাগানো হবে ভিন্নধর্মী গল্প এবং চরিত্রে এমনটাই কামনা।
আমাদের নির্মাতারা এবং গল্পকাররা নায়লা আজাদ নূপুর এবং তার মতো আরো অনেক দক্ষ সিনিয়র শিল্পীদের নিয়ে ভাববেন এটা আমাদের চাওয়া। হয়তো মনে দাগ কাটার মতো গল্প এবং চরিত্র পেলে আবারো অভিনয়ে নিয়মিত হবেন এই নন্দিত অভিনেত্রী, হলিউডের মতো সবচেয়ে বড় ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করার অভিজ্ঞতা এবং নিজস্ব শক্তিশালী অভিনয় দক্ষতা তিনি ছড়িয়ে দিবেন পরবর্তী প্রজন্মের কাছে এই চাওয়াটা খুব বেশি বলে মনে হয়না।