প্রফেসরের ক্ষুরধার বুদ্ধি, অ্যালিসিয়া সিয়েরার ক্ষিপ্র পদক্ষেপ, ডাকাতদলের বিচিত্র কীর্তিকলাপ, ইমোশনাল হোমাজের একেকটা টুকরো টুকরো সীন, দারুণ ডায়লগ এবং তুখোড় ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর... নির্মাতারা যেন শেষ সিজনকে স্মরনীয় করার জন্যে আদাজল খেয়েই নেমেছিলেন। এবং তারা যে তাতে বেশ সফল, তাতেও সন্দেহ নেই এতটুকুও!

বহুদিন ধরে চলতে থাকা কোনো সিরিজ হুট করে শেষ হয়ে গেলে,  বেশ আক্ষেপ হয়। চরিত্রগুলোর সাথে আর দেখা না হওয়ার আক্ষেপ। গল্পের যাত্রাপথে আর না থাকার আক্ষেপ। অভ্যস্ততার ইতি ঘটার আক্ষেপ। অদ্ভুত এক খচখচানি যেন। 'গেম অব থ্রোন্স' এর শেষে এরকম আক্ষেপের মুখোমুখি হয়েছিলাম। 'ব্রেকিং ব্যাড' কিংবা 'ফ্রেন্ডস' এর ক্ষেত্রেও একই অনুভূতি। একই অনুভূতির মুখোমুখি হলাম 'মানি হাইস্ট' শেষেও। 

যদিও 'মানি হাইস্ট' তার আপেক্ষিকতা মাঝের কিছু সময়ে অনেকটাই হারিয়ে ফেলেছিলো। অতিরিক্ত নাটকীয়তা, অর্থহীন সহিংসতা, প্রফেসরের বালখিল্যতা... বহুবিধ কারণেই এই সিরিজের উপর থেকে বারবার মনোযোগ ছুটে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। তবুও কোথায় যেন একটা অদৃশ্য সুতোর টানও ছিলো, দূরে যেতে গিয়েও যে সুতোতে টান খেয়ে ফিরে এসেছি বারবার। সে কারণেই হয়তো প্রফেসর, বার্লিন, পালেরমো, লিসবন, টোকিও, নাইরোবি, হেলসিঙ্কি, অসলো, ডেনভার, স্টকহোম... বৈচিত্র‍্যের এই চরিত্রগুলোকে উপেক্ষা করা সম্ভব হয়নি খুব বেশিদিন। 

যদিও 'মানি হাইস্ট' এর যে কনসেপ্ট, চাইলে আরো বহুদিন এ সিরিজকে টানা যেতো, কিন্তু নির্মাতারা এক্ষেত্রে আদর্শ মেনেছিলেন 'ব্রেকিং ব্যাড'কেই। প্রবল জনপ্রিয়তার পরেও মাত্র পাঁচ সিজনেই শেষ হয়ে যায় 'ব্রেকিং ব্যাড' এর গল্প। সেটি মেনেই 'মানি হাইস্ট'ও পাঁচ সিজনেই শেষ হওয়ার ঘোষণা আসে। দুই কিস্তিতে শেষ হবে সিজন, সেটাও জানা যায়। দুই কিস্তির প্রথম কিস্তি যদিও আহামরি কোনো নতুনত্বের সন্ধান দেয়নি, কিন্তু দ্বিতীয় ও শেষ কিস্তি এমন অসাধারণ ভাবেই শেষ করা হয়েছে, শেষে এসে এটা ভেবে আক্ষেপ বেড়েছে, চাইলে আরো দুই-এক সিজন কি করা যেতো না?

'সিজন ফিনালে'র প্রথম কিস্তিতে যেসব লুপহোল অমীমাংসিত রেখে পর্ব শেষ করা হয়েছিলো, দ্বিতীয় কিস্তি শুরু হয়েছে ঠিক সেখান থেকেই। প্রফেসরের সাথে  অ্যালিসিয়া সিয়েরার মুখোমুখি দ্বৈরথ, কর্নেল টামায়োর সাথে লড়াই, 'মিন্ট অব স্পেন' এ আটকে থাকা সহযোদ্ধাদের পরিণতি, ভল্ট থেকে নব্বই টন সোনা পাচারের পরিকল্পনা, ফ্ল্যাশব্যাকে বার্লিনের ফিরে ফিরে আসা, টাটিয়ানা ও রাফায়েলের সরব উপস্থিতি কিংবা শেষবার সবাই একত্রে 'বেলা চাও' গেয়ে ওঠা... ভক্তদের দুর্দান্ত ট্রিবিউট দেয়ার পাশাপাশি গল্পকেও এমন দারুণভাবে সমাপ্ত করা হবে, সব লুপহোলকে এমনভাবে যুক্ত করা হবে গল্পের সাথে, তা বোধহয় কেউই ভাবেনি। সিরিজ শেষে তৃপ্তির ঢেঁকুর উঠবে, এও তো ছিলো ভাবনার অতীত! 

মাস্টারমাইন্ড প্রফেসর এবারেও দেখিয়েছেন চমক! 

'মানি হাইস্ট' এর প্রথম থেকেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক- টানটান স্ক্রিনপ্লে, রোলার কোস্টার গতি। প্রথম সিজনের প্রথম পর্ব থেকেই যে গতির মুখোমুখি হয়েছিলো দর্শক।  সে গতি মাঝখানে শ্লথ হলেও সিজন ফিনালের শেষাংশে এসে আবার দারুণভাবেই হয়েছে উপস্থিত। পাশাপাশি মাস্টারমাইন্ড প্রফেসর! বিখ্যাত 'ভি ফর ভেন্ডেটা'র কালজয়ী উক্তি- 'আইডিয়াস আর বুলেটপ্রুফ' এরই যেন সার্থক উদাহরণ প্রফেসর। আইডিয়ার ক্ষুরধার প্রদর্শনীই দেখেছে সবাই এবার। পাশাপাশি ডাকাতদলের বাকিদের বৈচিত্র্যময় কার্যকলাপ তো ধ্রুবক। মাঝে মাঝে অ্যালিসিয়া সিয়েরার 'আউট অব দ্য বক্স' মুভমেন্ট৷ শেষাংশে এসে প্রফেসরকে নাকানিচোবানি খাওয়ানো বড়সড় এক টুইস্ট! ইমোশনাল হোমাজের একেকটা টুকরো টুকরো সীন। দারুণ ডায়লগ এবং তুখোড় ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর... নির্মাতারা যেন শেষ সিজনকে স্মরনীয় করার জন্যে আদাজল খেয়েই নেমেছিলেন। এবং তারা যে তাতে বেশ সফল, তাতেও সন্দেহ নেই এতটুকুও।

এই চরিত্রেরা ক্রমশই করবে স্মৃতিকাতর! 

'লা কাসা দে পাপেল' কিংবা 'মানি হাইস্ট' এর শেষটা হলো শুরুর মতই; দুর্দান্ত। 'শেষপাতে দই' বলে যে একটা কথা আছে বাংলায়, সেটারই সার্থক প্রতিফলন ঘটলো। যদিও 'মানি হাইস্ট' ফুরোলেও, গল্প ফুরোয়নি মোটেও। সামনেই আসবে 'মানি হাইস্ট' এর কোরিয়ান ভার্সন এবং 'বার্লিন' এর স্পিন-অফ। প্রত্যাশা থাকবে, এই দুই নির্মাণ ছাড়িয়ে যাবে মূল সিরিজের জনপ্রিয়তাকেও। আশাবাদ জানিয়ে যবনিকাপাতের মঞ্চ প্রস্তত। দালি মাস্ক, রেড জাম্পস্যুট এবং বেলা চাও এর জন্যে বিষাদ। যদিও খুব করে চাওয়া, এই অনুষঙ্গগুলো ফিরে আসুক ক্ষণেক্ষণে। স্মৃতিতে। প্রেরণায়। ভাবনায়। বিষাদগ্রস্ত 'মানি হাইস্ট' এর লাল-কালো বইয়ের পৃষ্ঠা যদিও অদৃশ্য। তবুও অদূরে কোথাও অস্ফুটে বাজুক 'বেলা চাও।' এই তো! জীবনই ফুরিয়ে যায়। গল্প কোন ছার! বিদায়! 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা