'মহানগর' সর্ষের মধ্যে ভূতের গল্প। আঙ্গুল বাঁকিয়ে ঘি ওঠানোর গল্প। সিস্টেমের মধ্যে থেকে সিস্টেমকে শায়েস্তা করার গল্প। কোথাও গিয়ে এ গল্প তীব্র মানবিক। আবার পরক্ষণেই তীব্র অমানবিক। এ গল্প তাই বুঝতে হবে সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে...

বাংলাদেশের যে কয়েকজন অভিনেতাকে নিয়ে বরাবরই আত্মবিশ্বাসী থাকি, যারা বড় প্ল্যাটফর্মেও কাঁপিয়ে দিতে পারে বলে বিশ্বাস রাখি তাদের একজন মোশাররফ করিম। সেই মানুষকে ফ্রন্টলাইনে রেখে যখন খ্যাতিমান নির্মাতা আশফাক নিপুন ওটিটি প্ল্যাটফর্ম 'হৈচৈ' এ ওয়েব সিরিজ 'মহানগর' নিয়ে এলেন, বুঝেছিলাম- পাথরে পাথরে ঘষা লেগেছে। এবার আগুন জ্বলা বাকি। সে আগুন যে এভাবে জ্বলে উঠে দাবানল হয়ে যাবে, ভাবিনি মোটেও। 

কোনো এক বিশেষ ঘটনাকে কেন্দ্র করে একটি নির্দিষ্ট জায়গার মানুষজনের কয়েক ঘন্টার টানাপোড়েন নিয়ে মলিউডে অনেক বিখ্যাত সিনেমা আছে৷ মালয়লাম সিনেমার এই ইনটেনসিভ ন্যারেশন স্টাইলটা বেশ ইন্টারেস্টিংও। আবার ড্যান ব্রাউনের বইতেও এই সিচুয়েশনাল ট্রিটমেন্ট প্রায়ই আসে। ইনফার্নো, দ্য ভিঞ্চি কোড, অরিজিন...রবার্ট ল্যাংডন কয়েক ঘন্টার অভিযানে রহস্য, রোমাঞ্চ, অ্যাকশন, সাসপেন্স, হিস্টোরি, সিম্বোলজি অনেক লেয়ারকে একসাথে নিয়ে আসেন বইয়ের পাতায়৷ 'মহানগর' এর ন্যারেশন স্টাইলও ঠিক এরকম। 

মোশাররফ করিম অতিমানবীয় অভিনয় করেছেন নিজের প্রথম ওয়েব সিরিজে! 

'মহানগর' এর গল্প ঘনীভূত হয় নগরের কোনো এক থানায়। যে থানায় ভিন্ন ভিন্ন অপরাধে এসেছে কিছু মানুষ। এক শিল্পপতি এসেছে মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালিয়ে এক সাইকেল আরোহীকে নিহত করে। এক ছন্নছাড়া চোর এসেছে ছিঁচকে চুরিচামারি করে। আবার আরেক চাকুরিজীবী এসেছে একেবারে কিছু না করেই।  'মহানগর' এর পুরোটা জুড়ে তাদেরই গল্প। আবার শুধুমাত্র তাদেরই গল্প না এখানে। এখানে আছে ওসি হারুন, এসআই মলয়, এসি শাহানা। যাদের গল্পেও নানারকম লেয়ার। আছে অদ্ভুত একেকটা সাটল মেটাফোর। আছে রাজনীতি। দুর্নীতি। অর্থনীতি। আছে মূদ্রার ভিন্ন ভিন্ন পিঠের বিব্রত নানা সমীকরণও। 

'মহানগর' প্রথমেই অবাক করেছে মাত্রাজ্ঞানে। ঠিক যেখানে সমাপ্তি টানা দরকার, ঠিক সেখানেই যবনিকাপাত হয়েছে। বিখ্যাত লেখক শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় যেমন বলতেন, ভালো লেখক শুধু ভালো গল্প লেখেনই না, তিনি এটাও ভালো জানেন, কোথায় গিয়ে থামতে হয়। ঠিক এই গুণটিরই সফল প্রয়োগ দেখি এখানে। আট পর্বের সিরিজ। প্রত্যেক পর্বই ত্রিশ মিনিটের মধ্যে। অথচ টানটান স্ক্রিপ্টে বিরক্ত হওয়ার সুযোগ একবিন্দু নেই৷ পশ্চিমবঙ্গের খ্যাতিমান পরিচালক সৃজিত মুখার্জী একবার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, আপনার গল্প যদি আড়াই ঘন্টা ধরে মানুষকে হলের মধ্যে বসিয়ে রাখতে চায়, তাহলে আপনার গল্পে মাদক থাকতে হবে। নেশায় বুঁদ হলেই মানুষ আটকে থাকবে গল্পে। 'মহানগর' এর গল্পে সে নেশা ছিলো।  বেশ ভালোভাবেই ছিলো। 

আসি ভিন্ন প্রসঙ্গে। সচেতন দর্শকেরা এটা ভালোভাবেই জানেন, স্বাভাবিক একটা কথাকেও দারুণ বিজিএম স্কোর দিয়ে অন্য মাত্রায় তুলে দেয়া যায়। কিন্তু আমাদের দেশের নির্মানগুলোতে এই বিষয়টিই থাকে বিস্তর উপেক্ষিত। সেই খেদ মিটেছে 'মহানগর' এ। বিজিএম স্কোরের পুরোপুরি ব্যবহারে যারপরনাই মুগ্ধ হয়েছি৷ এমনকী ভিন্ন ভিন্ন মানুষের মধ্যকার কথোপকথনেও আলাদা অথচ প্রাসঙ্গিক সব টিউনিং এর ব্যবহার হয়েছে সিরিজে। প্রশংসাযোগ্য একটি বিষয়। সিনেম্যাটোগ্রাফীর কথাও আলাদা করে বলতে হবে। ধনী-গরীবের মধ্যকার পাওয়ার গ্যাপ বোঝাতে পরিচালক যেভাবে ক্যামেরার হাইটকে ব্যবহার করেছেন এবং শুধুমাত্র ফ্রেমিং দিয়েই একেকটা মেটাফোরিকাল মেমোয়ার তৈরী করেছেন, তা দুর্ধর্ষ, অনবদ্য। 

বিজিএম, সিনেম্যাটোগ্রাফীতেও ছিলো চমক! 

তবে সব ছাপিয়ে 'মহানগর'কে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছেন একজন তুরুপের তাস। যে মানুষটির স্ক্রিনটাইম ছিলো সবচেয়ে বেশি। এবং এতটাই দুর্দান্ত অভিনয় তিনি করেছেন, স্রেফ ম্লান করে দিয়েছেন বাকি সবাইকে। হ্যাঁ, মোশাররফ করিমের কথাই বলছি। 'মহানগর' এর ট্রেলারে কেন মোশাররফ করিমকে 'কিংবদন্তি' বলা হয়েছে, তা নিয়ে সামান্য জলঘোলার চেষ্টা করেছিলেন কিছু প্রতিক্রিয়াশীল মানুষ। সেইসব সমালোচনার কী সুন্দর জবাব-ই না তিনি দিলেন! ঠিক কতদূর অভিনয়-নৈপুণ্য থাকলে একজন মানুষকে কিংবদন্তি বলা হয়, তা বিতর্কিত এক বিষয়৷ তবে এরকম অতিমানবীয় অভিনয়ের পরেও যদি মোশাররফ করিমকে সেই বিশেষ বিশেষণ দিতে কারো সমস্যা হয়, তাহলে এই বিশেষণ তুলে রাখা উচিত বিশেষ কোনো দেরাজে। ওসি হারুন' চরিত্রটির অনেকগুলো লেয়ার ছিলো এই গল্পে। সবগুলো লেয়ারকে এত আলাদা করে, এত দুর্দান্তভাবে তিনি নিয়ে এসেছেন পর্দায়, কুর্নিশ জানালাম। জানাতে বাধ্য হলাম। 

বাকিরা খারাপ অভিনয় করেছেন, তা বলার সুযোগ নেই মোটেও৷ জাকিয়া বারী মম, লুৎফর রহমান জর্জ, শ্যামল মাওলা দারুণ করেছেন। আলাদা ভাবে নজর কেড়েছেন খায়রুল বাসার। 'মহানগর'এ বেশ গুরুত্বপূর্ণ এক চরিত্রে ছিলেন তিনি। সেই চরিত্রের যে চাহিদা, তাও তিনি পূরণ করেছেন দারুণভাবে। এরকম নজর কেড়েছেন আরেকজন। 'এস আই মলয়' চরিত্রে অভিনয় করা মোস্তাফিজ নূর ইমরান। পর্দায় সাবলীল উপস্থিতি তো ছিলোই, কিছু ফ্রেমে মোশাররফ করিমের সাথেও পাল্লা দিয়ে অভিনয় করেছেন তিনি। চোখে লেগে থাকবে তাঁর অংশটুকুও। বাকিরাও অনবদ্য। এমনকি ওয়েব সিরিজের প্রথম পর্বে যেই চরিত্রহীন ভদ্রলোকটি 'আমও আছে, ছালাও আছে, এখন শুধু খাবি'র মতন রসালো লাইন বললেন, তার অভিনয়েও খুঁত নেই। সবাই যার যার জায়গা থেকে সেরা কাজটিই দিয়েছে।

'কমিক রিলিফ' হিসেবে এই জুটি ছিলো অনবদ্য! 

পরিচালক আশফাক নিপুনের যেকোনো নির্মাণেই কিছু না কিছু চমক থাকে৷ সে কষ্টনীড়ই হোক, ভিকটিম হোক অথবা 'মহানগর'। এই ওয়েব সিরিজে সুপিরিয়র পুলিশ অফিসার হিসেবে তিনি এক নারী চরিত্রকে এনে অর্থোডক্স এক মেন্টালিটিকে ধাক্কা দিলেন। এই নারীচরিত্রের মুখে সিগারেট দিয়ে আরেকটু ধাক্কা দিলেন পুরুষতান্ত্রিক হৃদয়ে। সংলাপে অভিনবত্ব আনলেন। সিস্টেমের মধ্যে কিলবিল করতে থাকা অজস্র ঘুণপোকাকে নগ্ন করে নিয়ে এলেন দর্শকের সামনে৷ সাদা-কালোর এমনসব দ্বন্দ্ব উঠিয়ে আনলেন রাতের এক থানায়, আবার সে দ্বন্দ্বকে তিনি এমনভাবে মিলিয়ে মিশিয়ে এক ধূসর ক্যানভাস বানালেন, কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেলো বিবেকের ব্যস্ত টানেল।

মহানগর, সর্ষের মধ্যে ভূতের গল্প! 

'মহানগর' সর্ষের মধ্যে ভূতের গল্প। আঙ্গুল বাঁকিয়ে ঘি ওঠানোর গল্প। সিস্টেমের মধ্যে থেকে সিস্টেমকে শায়েস্তা করার গল্প। কোথাও গিয়ে এ গল্প তীব্র মানবিক। আবার পরক্ষণেই তীব্র অমানবিক। এ গল্প তাই দেখতে হবে চোখ-কান খোলা রেখে। নীল সোফাসেটে মিঠে খুনসুটির গল্প 'মহানগর' না। উলঙ্গ ক্ষমতাশালীর আস্ফালন আর সমাজের ক্লেদাক্ত সব পাণ্ডুলিপির মধ্যবর্তী মনস্তত্ব বুঝতে হলে 'মহানগর' এর দর্শককে হতে হবে প্রচণ্ড সমাজসচেতনও। নাহয় সাদাসিধে, নিরীহ এক ক্রাইম থ্রিলারই মনে হবে মহানগর কে।

কিন্তু 'মহানগর' শুধু এক ক্রাইম থ্রিলার না। এর ব্যপ্তি অনেক অতলে৷ সমাজবৃক্ষের পঁচে যাওয়া শেকড়ের একেবারে শুরুর অংশ থেকে শুরু হয়ে 'মহানগর' এর আখ্যান পৌঁছেছে সেই বৃক্ষের শুকিয়ে যাওয়া মগডালের একেবারে শীর্ষবিন্দুতেও। তাই, দর্শকের সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গি নিবিড়ভাবে কাম্য। 

ধন্যবাদ রইলো, 'মহানগর' এর পুরো টিমের জন্যে। সে সাথে থাকলো দ্বিতীয় পর্বের জন্যে শুভকামনাও।


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা