লং ডিস্টান্স রিলেশনশিপ এর কড়চা তো রইলোই। পাশাপাশি লতায়-পাতায় সওয়ার হয়ে এই নির্মাণের গল্প গড়িয়েছে বহুদূর। একান্নবর্তী পরিবারের নিয়মিত দিনলিপি কিংবা আটপৌরে নারীর প্রতি সমাজের নানা স্তরের মানুষের বহুবিধ প্রত্যাশার জটিলতা, পারস্পরিক যোগাযোগের অভাবে সম্পর্কের মলিনতা, কর্মক্ষেত্রে সফলতার ইঁদুরদৌড়...নানা সাবপ্লটের সমাবেশই ছিলো উপস্থিত!

স্ট্রিমিংসাইট নেটফ্লিক্সে সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া 'মীনাক্ষী সুন্দরেশ্বর' এর পুরোটুকু জুড়ে এক জোড়া দম্পতির টক-ঝাল-মিষ্টি জীবনের গল্প। এই দম্পতি আলাদা স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বলও। মীনাক্ষী, সুপারস্টার রজনীকান্তের ভক্ত। আত্মবিশ্বাসী এবং মেধাবী এই মেয়ে যেকোনো আড্ডার আসর একাই জমিয়ে দিতে পারে।  অন্যদিকে সুন্দরেশ্বর খানিকটা অন্তর্মুখী, লাজুক মানুষ। বাবার শাড়ির ব্যবসা যার ভালো লাগে না। সে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। কোডিং, বাইনারি, প্রোগ্রামিং এ সে খুঁজে পায় আনন্দ। বন্ধুবান্ধব খুব একটা নেই। নিজের কাজে ডুবে থাকাতেই তার স্বস্তি।

খানিকটা বিপরীত স্বভাবের এই দুই নারী-পুরুষ নানা ঘটনার ডামাডোলের প্রেক্ষাপটে একসময়ে আবদ্ধ হয় বিবাহসূত্রে। মঙ্গলসূত্র আর গাঁটছড়ার গণ্ডিতে আশ্রয় পায় সম্পর্ক। যদিও এ বিয়ে হবে কী হবে না, তা নিয়েও বিস্তর যদি, কিন্তু, অনিশ্চয়তা ছিলো। অল্পবিস্তর ঘটনা-দুর্ঘটনাও ছিলো। সেসব টপকে একসময়ে একসাথে জুড়ে যায় দুজন মানুষের নাম; মীনাক্ষী সুন্দরেশ্বর। যে নামের আরেক অর্থঃ পার্বতী-শিব।

গল্প এইটুকু পর্যন্ত বেশ ছিমছামই ছিলো। কিন্তু বিয়ের পরে খানিকটা পালটে যায় সমীকরণ। মীনাক্ষী এবং সুন্দরেশ্বর এর সম্পর্কের মিথস্ক্রিয়ায় আসে খানিকটা টানাপোড়েনও। সুন্দরেশ্বর এক আইটি ফার্মের চাকরী পায় ব্যাঙ্গালোরে। স্ত্রী'কে ছেড়ে সেখানে যেতে হবে তাকে। তাও বিয়ের কয়েক দিন পরেই। একসময়ে সুন্দরেশ্বর চলেও যায় ব্যাঙ্গালোর। মীনাক্ষী থেকে যায় সুন্দরেশ্বরের একান্নবর্তী পরিবারের সাথে। 'লং ডিস্ট্যান্স রিলেশনশিপ' এর সূত্র ধরে আস্তে আস্তে তাদের মধ্যে জমতে থাকে আক্ষেপ-হতাশার ধুলো। কথা কমে। বাড়ে অভিমান।

'মীনাক্ষী সুন্দরেশ্বর' চলচ্চিত্রের মূলভাব হিসেবে যদি দূরে দূরে বসবাস করা দম্পতিদের মধ্যবর্তী রসায়নের অনুসন্ধান করাকেই ধরা হয়, তাহলে এ কথা বলাই যায়,  এ সিনেমায় সেই আকাঙ্ক্ষিত রসায়নের চড়াই-উতরাইয়ের পুরোপুরি আসেনি মোটেও। দূরে থাকা প্রিয়মানুষ-কেন্দ্রিক যন্ত্রণা বোঝাতে এমন অনেক কিছুই আনা হয়েছি, যা আরোপিত। খুব একটা বাস্তব-সুলভ না তা। তাছাড়া 'রোমান্টিক কমেডি' জনরার সার্থকতা প্রমাণ করার জন্যেই নির্দিষ্ট সময় পর পরে কমিক এলিমেন্টস আনতে হবে, এমন কোনো বাধ্যবাধকতা থাকলে তাতে নির্মাণেরই ক্ষতি। যদিও এই নির্মাণের কোনো সিচুয়েশনাল কমেডিই বাড়াবাড়ি না, বরং বেশ ভালোই লাগবে গল্পের অম্ল-মধুর এ দৃশ্যগুলো। কিন্তু পাশাপাশি গ্রে ম্যাটারেও প্রশ্ন আসবে, যা দেখলাম, তা কি বাস্তবেও হয়? এই প্রশ্ন যখনি মাথায় চলে আসবে, বুঝে নিতে হবে- সিনেমা, সিনেমা হয়েই থেকে গিয়েছে। জীবনের অংশ হয়ে উঠতে পারেনি। 

সম্পর্কের মিঠেকড়া গল্প বলে এ সিনেমা! 

তবে এটাও ঠিক, শুধুমাত্র 'লং ডিস্টান্স রিলেশনশিপ' এর কড়চাতেই এই নির্মাণ থেমে থাকে নি। বরং লতায়-পাতায় সওয়ার হয়ে গল্প গিয়েছে বহুদূর। একান্নবর্তী পরিবারের নিয়মিত দিনলিপি কিংবা আটপৌরে নারীর প্রতি সমাজের নানা স্তরের মানুষের বহুবিধ প্রত্যাশার জটিলতা, পারস্পরিক যোগাযোগের অভাবে সম্পর্কের মলিনতা, কর্মক্ষেত্রে সফলতার ইঁদুরদৌড়...নানা সাবপ্লটের সমাবেশ ছিলো এখানে। সেসব যে খুব দারুণভাবে পর্দায় স্টাবলিশ করতে পেরেছেন নির্মাতা, তা বলা যাবে না। তবে চেষ্টা করেছেন। এবং সে চেষ্টা যে থোড় বড়ি খাড়া কোনো চেষ্টা, এমনটিও না। সেসব খাপছাড়াও লাগেনি মোটেও। কিন্তু কেন যেন তৃপ্তির ঢেঁকুরটিই আসেনি।

'মীনাক্ষী' চরিত্রে সানিয়া মালহোত্রা করেছেন মুগ্ধ! 

তাছাড়া এই চলচ্চিত্রে সাংস্কৃতিক কিছু গোঁজামিলও বেশ প্রকটভাবে উপস্থিত। আরেকটু স্পষ্ট করা যাক। 'মাদুরাই নামক স্থানে গল্পের প্রেক্ষাপট করা হয়েছে। অথচ সুন্দরেশ্বর কিংবা মীনাক্ষী, প্রত্যেকের পরিবারের মানুষই হিন্দিভাষী। 'মাদুরাই' তে হিন্দিভাষী মানুষের সংখ্যা যে কম, তা সবাই-ই জানেন। পাশাপাশি, এই পরিবারের মানুষজন যখন কালেভদ্রে তামিল বলছেন, সেটিও যে ঠিক শুদ্ধ উচ্চারণের হচ্ছে, এমনটি না। গড়পড়তা দর্শক হয়তো এই পার্থক্যগুলো বুঝতে পারবে না। কিন্তু যারা এসব নিয়ে ওয়াকিবহাল, তাদের কাছে এ ভুলগুলো খানিকটা 'গলার কাঁটা'র মতনই খচখচাবে।

তবে নেতিবাচক নানা দিকের মধ্যেও আলাদা করে বলতে হবে 'মীনাক্ষী সুন্দরেশ্বর' এর স্নিগ্ধ ক্যামেরার কাজ নিয়ে। ডিওপি দেবোজিৎ রায় সিনেমার প্রত্যেক ফ্রেমেই যেভাবে কিছু না কিছু মোলায়েম জিনিস রেখেছেন, তা প্রশংসনীয়। আল্পনাই হোক কিংবা কাঞ্জিভরম শাড়ি অথবা হাড়িভর্তি রসমালাই কিংবা মাদুরাই এর প্রাচীণ 'মীনাক্ষী সুন্দরেশ্বর' মন্দির... সিনেম্যাটোগ্রাফী এবং ক্যামেরার চমৎকারিত্বের জন্যেও এ সিনেমা ভালো লাগবে অনেকের। 

দারুণ সিনেম্যাটোগ্রাফীতে চমকে দিয়েছে এ সিনেমা! 

চরিত্রদের মধ্যে প্রোটাগনিস্ট সানিয়া মালহোত্রা অনবদ্য। থ্যালাইভা ফ্যান হয়ে পাগলামো কিংবা শ্বশুরবাড়ির অপমানের বিরুদ্ধে মুখ শক্ত করা প্রতিবাদ... 'মীনাক্ষী' চরিত্রের ডাইমেনশন অনুযায়ী নিজেকে সিনেমায় বহুবারই ভেঙ্গেছেন, গড়েছেন তিনি। পাশাপাশি 'সুন্দরেশ্বর'রূপী অভিমন্যুও দেশাইও দারুণ। লাজুক, অন্তর্মুখী, সংবেদনশীল এক চরিত্রের সুর ঠিকঠাকভাবে ধরে ছিমছাম এক অভিনয়ই করেছেন তিনি। বাকিরাও দারুণ। ত্রিশান, পুর্নেন্দু ভট্টাচার্য কিংবা রিতিকা শরত্রী...সবাই মিলেঝিলেই টেনে নিয়েছেন গল্পকে। 

যদি কেউ টাইম পাস কন্টেন্ট কিংবা মন ভালো করার মতন এক নির্মাণ দেখতে চান, তাহলে 'মীনাক্ষী সুন্দরেশ্বর' নিঃসন্দেহে দেখা যেতে পারে। কিন্তু যদি গল্পের মাঝখানে লুকোচুরি পছন্দ না হয়, যদি কাহিনীর বিস্তারে অসঙ্গতি থাকলে ক্রমাগত প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে কিংবা সিনেমায় না-বাস্তব কিছু দেখতে ভালো না লাগে, তাহলে এ সিনেমা বাদ দিলেও খুব একটা ক্ষতিবৃদ্ধি নেই। সবমিলিয়ে, এ সিনেমা তাই অনেকটা ঘিয়ে ভাজা জিলিপির মতন। গরম গরম খেতে ভালোই লাগবে। কিন্তু খাওয়ার পরে স্বাস্থ্যের যে খুব একটা উন্নতি হবে, তা দ্ব্যর্থকন্ঠে বলা যাবে না মোটেও। তাই খাওয়ার পরামর্শ দেওয়াটাই সমীচীন নয়। খেতে হলে নিজ দায়িত্বেই খেতে হবে। 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা