'লা কাসা দে পাপেল' এর সিজন ফিনালের প্রথম খণ্ড এমন কোনো চমক রাখেনি, যে কারণে দ্বিতীয় খণ্ডের জন্যে হাপিত্যেশ করা যায়। এবং নির্মাতারা যে ঠিক এ সিজনে এসেই শেষ করে দিচ্ছেন সিরিজটিকে, সিজন ফিনালের প্রথম খণ্ড দেখার পর এই বিষয়টিকেই মনে হচ্ছে সঠিক এবং বুদ্ধিদীপ্ত সিদ্ধান্ত...

'মানি হাইস্ট' নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে যত বেশি উন্মাদনা হয়েছে, সমসাময়িক অন্যান্য সিরিজের হিসেবে তা বেশ বিরলতমই বলতে হবে। এবং এই উন্মাদনা, মাতামাতি কিংবা চমকের পুরোটাই যে নেটফ্লিক্সের কারিশমা, একবাক্যে সেটা বলাও ভুল। এটা মানতেই হবে, কন্টেন্ট মার্কেটিং কিভাবে করতে হয়, তা নেটফ্লিক্সের চেয়ে ভালো কেউ জানে না। কিন্তু এই সিরিজটির মধ্যেও এমন কিছু বিষয় ছিলো, যা সিরিজটিকে সমসাময়িক অন্যান্য সিরিজের চেয়ে স্বকীয় করেছে। ন্যারেশন স্টাইল বলা হোক কিংবা স্ক্রিপ্ট রাইটিং অথবা ক্যারেক্টার ডেভেলপমেন্ট, সবখানেই কিছু না কিছু অভিনবত্ব ছিলো। এতসব কারণের মিলিত প্রতিক্রিয়াতেই 'মানি হাইস্ট' বেশ অনেকদিন ধরে স্থায়ী হয়ে রয়েছে দর্শকের মস্তিষ্কে। 

'মানি হাইস্ট' এর নির্মাতা অ্যালেক্স পিনা কিংবা টিমের বাকিদেরও ধারণা ছিলো না, তারা এই সিরিজটিকে নিয়ে কতদূর যাবেন। প্রথম সিজনের পরে 'মানি হাইস্ট' বন্ধ হয়ে যাওয়ারও উপক্রম হয়েছিলো। কিন্তু নেটফ্লিক্সের সাথে যুক্ত হওয়ার পরেই ক্রমশ পালটায় দৃশ্যপট। সিরিজে নিয়মিত বিরতিতে নানা অনুষঙ্গ যুক্ত হওয়া শুরু করে, গড়পড়তা 'থ্রিলার' এর মোড়ক ভেদ করে 'লা কাসা দে পাপেল' ক্রমশই যেতে থাকে আরো গহীনে, গভীরে। নড়েচড়ে বসা শুরু হয় তখন। 'লা কাসা দে পাপেল' এ তখন আস্তে আস্তে প্রবেশ করছে সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম নানা মেটাফোর। এ প্রসঙ্গে একটা বিষয় জানিয়ে রাখা ভালো, এই সিরিজের স্ক্রিপ্ট কিন্তু আগে লেখা হয় না। শুটিং চলাকালে স্ক্রিপ্ট রাইটাররা এক পর্বের শুটিং দেখতে দেখতে পরবর্তী পর্বের স্ক্রিপ্ট লেখেন। এটা করার অন্যতম কারণ, যাতে করে শুটিং এর সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম ডিটেইলসগুলোকে পরবর্তী পর্বে যুক্ত করা যায়। কাজটি সহজ না, কষ্টসাধ্য। তবে এটার সুবিধেও আছে। 'লা কাসা দে পাপেল' এর ডিটেইলিং নিয়ে এত যে কথাবার্তা হয়, এর পেছনে স্ক্রিপ্ট রাইটিং এর এই টেকনিক বেশ কার্যকর ভূমিকা রেখেছে বরাবরই।

প্রথমে যখন ঐতিহাসিক 'বেলা চাও' গানটিকে যুক্ত করা হলো এই সিরিজের সাথে, কোনো ভাবনাচিন্তা ছিলো না সেখানে। কিন্তু ক্রমশই বেলা চাও, দালি মাস্ক (চিত্রশিল্পী সালভাদর দালির মুখের আদল) এবং রেড জাম্পস্যুট হয়ে যায় গভীর রূপক, বিদ্রোহের প্রতীক। সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম পলিটিক্যাল প্যারাডক্স ঢুকে যায় এই সিরিজে। ক্যারেক্টারগুলোর ডেভেলপমেন্ট যতই সামনের দিকে এগোয়, দর্শক বুঝতে পারে- 'লা কাসা দে পাপেল' ঠিক প্রথাগত অ্যাকশন প্যাকড সিরিজ না। এখানের লড়াইটা সিস্টেম বনাম সাধারণ মানুষের। এখানে মশলামুড়ির মতন অনুষঙ্গ যেমন আছে, তেমনি ভাব-বুদ্বুদেরও মিশেল আছে। আস্তে আস্তে 'মানি হাইস্ট' নিয়ে আগ্রহ বাড়ে অনেকের। আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। মানুষ বিভক্ত হয় বহুমুখী শিবিরে। 

যদিও প্রথম দুই সিজনে যে ধার ছিলো 'লা কাসা দে পাপেল' এর, সেটি মাঝের দুই সিজনে এসে অনেকটাই ভোঁতা হয়ে যায়। খানিকটা মুখ থুবড়ে পড়ে যেন গোটা নির্মাণ। দর্শকেরও সাময়িক মোহ কেটে যায়। দর্শক বুঝতে পারে, 'লা কাসা দে পাপেল' যা বলতে চেয়েছিলো, তা বলা হয়ে গিয়েছে। একই আবেগ, একই অ্যাকশন, একই মানুষের উপর বারবার নির্ভরশীলতা, একই ধাঁচের বিজয়...এক বিষয়ের পুনরাবৃত্তি ঘটছিলো বারবার। দর্শকের আগ্রহও নিয়মিত কমছিলো। তবুও সিজন ফিনালে'র ঘোষণা এলো। নির্মাতার পক্ষ থেকে জানানো হলো, এবারের সিজনে খানিকটা চমক থাকবে, তখন ফের নড়েচড়ে বসলো অনেকে। 

যদিও সিজন ফিনালের প্রথম খণ্ড শেষ হয়েছে মাত্র। বাকি রয়েছে আরো এক খণ্ড, এরকম এক মুহুর্তে সিরিজটির 'সিজন ফিনালে' নিয়ে উপসংহার টানা মোটেও সমীচীন হবে না। তবে প্রথম খণ্ডের পাঁচ পর্ব দেখে একটা জিনিস স্পষ্ট, নতুনত্ব নেই এবারেও।  'লা কাসা দে পাপেল' এর প্রথম দুই সিজন অ্যাকশনে ঠাসা ছিলো, পাশাপাশি সেখানে সাসপেন্স, থ্রিল, কী হবে না হবে নিয়ে উৎকন্ঠাও ছিলো। দারুণ দারুণ সব লেয়ার ছিলো। লেয়ারগুলোর এক্সিকিউশনও ছিলো দারুণ। কিন্তু তৃতীয় সিজন থেকেই যেন এই বিষয়গুলো ক্রমশ ফিকে হতে থাকে। প্রফেসর খানিকটা বোকা হয়ে যান, ডাকাতদলের মধ্যবর্তী কোন্দল বিরক্তিকর পর্যায়ে যেতে থাকে, প্রশাসন আরেকটু অথর্ব হতে থাকে, ক্রমশই ঝাঁজ হারাতে থাকে একসময়ের তীব্র ঝাঁঝালো 'লা কাসা দে পাপেল।' 

এই সিজনের নতুন অনুষঙ্গ- আর্মি বহর! 

তবে পঞ্চম সিজনে এসে নতুনত্ব খুব একটা না থাকলে এক্সিকিউশনে খানিকটা মুন্সিয়ানা এসেছে। অতি-আবেগ খুব একটা নেই। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ধুন্ধুমার অ্যাকশন। গত সিজনগুলোর মতন প্রফেসরের 'সর্বেসর্বা' ভূমিকাও খুব একটা নেই। যে অ্যালিসিয়া সিয়েরাকে ভাবা হয়েছিলো এবারের সিজনে প্রোটাগনিস্ট হয়ে উঠবেন, তিনিও নখদন্তহীন ব্যাঘ্রশাবকে পরিণত হয়েছেন।

প্রফেসর বিপাকে পড়তে গিয়েও পড়েনি শেষমেশ!  

আর্তুরোর বিরক্তিকর কর্মকাণ্ড এবারেও দৃশ্যমান। ব্যাঙ্ক অব স্পেন এর ভেতরে টোকিও, লিসবন, ডেনভার, স্টকহোম, পালেরমোর বেঁচে থাকার লড়াইয়ে এবারে প্রতিবন্ধক হিসেবে এসেছে একদল খুনে স্পেশাল এজেন্ট, খোলামকুচির মতন উড়েছে গুলি- গ্রেনেড-বোমা। সবমিলিয়ে এসবই৷ মাঝে স্বজনহারানো শোক এসেছে। কিছু ক্যারেক্টারের প্রাসঙ্গিক কিছু ব্যাকস্টোরি এসেছে। বার্লিনের এক অভিনব ডাকাতিও এসেছে। যেসব না এলেও খুব একটা ক্ষতিবৃদ্ধি ছিলো না। গল্পের মূল কাহিনীতে এসব ফ্ল্যাশব্যাক খুব একটা আঁচড় কাটেনি। ক্লিফহ্যাঙ্গারে আটকে থাকা, অস্বস্তিকর সাসপেন্স, সম্মুখ দ্বৈরথ কিংবা বুদ্ধিদীপ্ত কথার লড়াই...এগুলোর অনুপস্থিতি বেশ প্রকট হয়েই চোখে পড়েছে। 

অতি-আবেগ খানিকটা কমেছে এবার! 

সব মিলিয়ে বলা যায়, 'লা কাসা দে পাপেল' এর সিজন ফিনালের প্রথম খণ্ড এমন কোনো চমক রাখেনি, যে কারণে দ্বিতীয় খণ্ডের জন্যে হাপিত্যেশ করা যায়। এবং নির্মাতারা যে ঠিক এ সিজনে এসেই শেষ করে দিচ্ছেন সিরিজটিকে, সিজন ফিনালের প্রথম খণ্ড দেখার পর এ বিষয়টিকেই সঠিক এবং বুদ্ধিদীপ্ত সিদ্ধান্ত বলে মানতে হচ্ছে। বিগত দুই সিজন ধরে যেভাবে এগিয়েছে গল্প বা এ সিজনের প্রথম পাঁচ পর্বেও যেভাবে দেখেছি কাহিনীর রূপান্তর, তাতে করে এই সিরিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব উচ্চাশা করা একটু বাড়াবাড়িই হয়ে যাবে। 'মানি হাইস্ট' এবারেই শেষ হোক, সেটাই ভালো। কিন্তু তাও একটু প্রত্যাশা, শেষটা যেন একেবারেই গড়পড়তা না হয়। খানিকটা যেন চমক, অনিশ্চয়তা থাকে। এটুকু যদি থাকে, তাহলেই বর্তে যাবে 'লা কাসা দে পাপেল' এর অনুরাগীরা। সেটাই চাওয়া। 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা