একসময় যার বাংলা উচ্চারণ নিয়ে অভিযোগ ছিল দর্শকের, তিনি এখন ছোট পর্দায় সবচেয়ে জনপ্রিয় অভিনেত্রী। প্রথমদিকে অভিনয়ে ত্রুটি বিচ্যুতি ছিল, সঙ্গে ছিল অতিরিক্ত মেকআপের অভিযোগ। সেসব ত্রুটি কাটিয়ে উঠে গত কয়েক বছর ধরেই মেহজাবীন জ্বলছেন আপন আলোয়, উদ্ভাসিত করছেন চারপাশ...

২০১০ সাল, আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষ্যে ইফতেখার আহমেদ ফাহমি চ্যানেল আইয়ের জন্য নাটক বানালেন 'তুমি থাকো সিন্ধুপাড়ে', মাহফুজ আহমেদের বিপরীতে অভিনয় করলেন সদ্য লাক্স চ্যানেল আই সুপারস্টার ২০০৯ এর সেরা বিজয়ী। সেদিনের সেই অষ্টাদশী তরুণীই আজ পরিনত এক অভিনেত্রী। একসময় যার বাংলা উচ্চারণ নিয়ে অভিযোগ ছিল দর্শকের, তিনি এখন ছোট পর্দায় সবচেয়ে জনপ্রিয় অভিনেত্রী, তিনি মেহজাবীন চৌধুরী।

'তুমি থাকো সিন্ধুপাড়ে' নাটকে তার চরিত্রটি খুব সুন্দর ছিল। বাস্তবের সঙ্গেও মিল ছিল,কারন তার বেড়ে উঠা দুবাইতে। মধ্যপ্রাচ্য পেরিয়ে এদেশে এসে তখন সবে নিয়মিত বাংলা চর্চা শুরু করেছেন। সেই বছরেই, হুমায়ূন আহমেদের নির্মানে শুভ্র সিরিজের 'মাঝে মাঝে তব দেখা পাই কিংবা দাঁড়কাকের সংসার' নাটকটা করেছিলেন। আরিফিন শুভর বিপরীতে সালাউদ্দিন লাভলুর ওয়ারিশ ছবিতে কাজ করার কথা ছিল, কিন্তু দূর্ভাগ্য ছবিটাই আর হয়নি। পরে গুজব বেরোলেও বড় পর্দায় এখনো মুখ দেখাননি।

লাক্স আর বাংলালিংকের নিয়মিতভাবে বিজ্ঞাপনের সুবাদে পরিচিতি আরো বেড়ে গিয়েছিল বহুগুণ, পুরো দেশজুড়ে রাস্তার বিলবোর্ডগুলোতে শোভা পেত তার সুন্দর মুখ। তখন অব্দি বেশিরভাগ ই ভাবতেন, ঐ মডেলিং পর্যন্ত তার ক্যারিয়ার হবে, কারন কাছাকাছি সময়ের বেশকিছু তারকার এমনই হয়েছিল। তবে মেহজাবীন সেই পথে হাঁটেননি। প্রথমদিকে স্বাভাবিকভাবেই অভিনয়ে ত্রুটি বিচ্যুতি ছিল, সঙ্গে ছিল অতিরিক্ত মেকআপের অভিযোগ। ভালো লাগা ব্যাপার হলো, এই ত্রুটিগুলো ধীরে ধীরে কাটিয়ে উঠেছেন তিনি।

আলাদাভাবে ধরলে রেদওয়ান রনির 'ভালোবাসা ১০১' হচ্ছে তার প্রথম জনপ্রিয় নাটক, কাছাকাছি সময়ে ইউনিভার্সিটি, ইউটার্ন, সুপারস্টার, প্রিয়তমেষু নাটকগুলোর পাশাপাশি সজলের বিপরীতে বেশ কয়েকটি নাটকের সুবাদে একটা ভিত গড়ে দেয়। তবে দর্শক থেকে সমালোচক সবাই তাকে অভিনেত্রী হিসেবে ভাবা শুরু করেন ক্লোজআপ কাছে আসার গল্পের শাফায়েত মনসুর রানার 'হাতটা দাও না বাঁড়িয়ে'র জন্য৷ 

চিরকাল আজ- মেহজাবীনের ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা পারফরম্যান্স

২০১৭ সাল, এলো মাহেন্দ্রক্ষণ। অভিনেত্রী হিসেবে নিজেকে তিনি নিয়ে গেলেন সবচেয়ে জনপ্রিয়তার স্থানে। 'বড় ছেলে' নাটকের সুবাদে পুরো দেশে তাকে নিয়ে বন্দনা, সেটা পেরিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ থেকে অন্যান্য দেশেও৷ মিজানুর রহমান আরিয়ানের এই নাটক অপূর্বকে প্রত্যাবর্তন করালেও সবচেয়ে বেশি লাভ হয়েছে মেহজাবীনেরই, এমনকি পরের বছর আরিয়ানের 'বুকের বাঁ পাশে'তে অভিনেতার বদল ঘটে আফরান নিশো এসেছেন, কিন্তু অভিনেত্রী রয়ে গেল মেহজাবীনই। এটিও সেবছরের সবচেয়ে জনপ্রিয় নাটক। আরিয়ান-মেহজাবীন কে গত পাঁচ বছরের সবচেয়ে জনপ্রিয় নির্মাতা-অভিনেত্রীর জুটি বললেও ভুল হবে না।

মেহজাবীনের জয়রথ এখনো চলছে। অভিনেত্রী হিসেবে নিজেকে আরো প্রমাণের সুযোগ পেয়ে গেলেন আশফাক নিপুণের সাহচর্য পেয়ে, তার নির্মানে মেহজাবীন হয়ে উঠেন আরো স্বতন্ত্র্য। সেটা 'ফেরার পথ নেই', 'সোনালী ডানার চিল' হোক বা 'এই শহরে'র মত কাজগুলো। শোনা যাচ্ছে নিপুণেরই আপকামিং ওয়েব সিরিজ 'সাবরিনা'তেও মেহজাবীনই অভিনয় করছেন। সাম্প্রতিক কালে ভিকি জাহেদের সঙ্গে গড়ে উঠেছে আরেক আস্থাভাজন জুটি। নির্বাসন, ইরিনা, জন্মদাগ, পুনর্জন্ম সিরিজ থেকে 'চিরকাল আজ' এর মত নাটকে অভিনয় তাকে অন্য এক মাত্রা এনে দিয়েছেন। সদ্য করলেন ওয়েব ফিল্ম 'রেডরাম', যেটা মেহজাবীনের প্রথম ওয়েব ফিল্ম। প্রবীর রায় চৌধুরীর বেস্ট ফ্রেন্ড সিরিজ, মাবরুর রশিদ বান্নাহর হঠাৎ নীরার জন্য, লাল রাঙা স্বপ্ন, ছেলেটি অবন্তীকে ভালোবেসেছিল, ছোট্ট পাখির বাসা থেকে কাজল আরেফিন অমির ইনকমপ্লিট, মুঠোফোন, রাফাত মজুমদার রিংকুর পতঙ্গ সহ কিছু নাটক তার ক্যারিয়ারের উল্লেখযোগ্য কাজ।

রেডরামে প্রশংসিত হয়েছে মেহজাবীনের অভিনয়

মাহফুজ আহমেদ তার প্রথম অভিনেতা, পরে সজলের সঙ্গে প্রথমদিকে জুটি হলেও পরে জোভান ও সিয়ামের সঙ্গে তার জুটি জনপ্রিয় হয়ে উঠে। সিয়াম চলচ্চিত্রে যাবার পর জোভানের সঙ্গে নিয়মিত হবার সম্ভাবনা দেখা দেয়, এখনো এই জুটির কাজ জনপ্রিয় হয়, তারা মানিয়ে যান দারুণভাবে। পাশাপাশি অপূর্বের বিপরীতে গড়ে উঠেছে অত্যন্ত জনপ্রিয় জুটি, যদিও সেটায় নিঃশ্বাস ফেলে আফরান নিশোর সঙ্গে জুটিটা। এটাকে সময়ের সেরা জনপ্রিয় জুটি নির্দ্বিধায় বলা যায়। এছাড়া ইরফান সাজ্জাদ, তৌসিফ থেকে তাহসান- সবার সাথেই কম বেশি কাজ করেছেন।

মেহজাবীন এই সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় অভিনেত্রী, সমীক্ষা করলে হয়তো টিভির সেরা জনপ্রিয় তারকাই হবেন সমসাময়িকদের পেছনে ফেলে। তবে তাকে নিয়েও অভিযোগ করা যায়। স্ক্রিপ্ট নির্বাচনে কিছুটা অসচেতনতা, একই জুটি নিয়ে বারবার পর্দায় এনে সেটাকে বিরক্তিতে নিয়ে আসা। যদিও বছর শেষে দারুণ কিছু কাজের জন্য সেরার মুকুট এখন অব্দি কেউ নিতে পারেনি। যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছেন নিজের মত করে, ক্যারিয়ারে আরেকটু সচেতন হলে সব অভিযোগ দূর হয়ে যাবে। এগিয়ে যাবেন আরো বহুদূর, পরিনত হবেন উত্তরসূরীদের আইডলে। গত এক দশকে দেখা যায়, উপমহাদেশে জনপ্রিয়তায় পুরুষ অভিনয়শিল্পীদেরই বেশি মূল্যায়ন করা হয়। সেখানে দারুণ সফল এক অভিনেত্রী তিনি, যার জনপ্রিয়তা পাল্লা দিতে পারে অভিনেতাদেরও। নাটক, ওয়েব সামলে সিনেমাতেও হবেন বিশেষ একজন, ব্যক্তিজীবনেও যতটা সম্ভব নিজেকে বিতর্কহীন রেখেছেন। সামনের দিনগুলি শুভ হোক।

শুভকামনা, মেহজাবীন!


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা