৭ দুগুণে ১৪: যে শর্টফিল্মগুলো স্বপ্ন দেখার সাহস যোগায়!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

ইউটিউবে মিলিয়ন ভিউজ পাওয়া অনেক নাটক বা টেলিফিল্মের চেয়ে মানে ও গুণে শতগুণ ভালো হয়েছে এই চৌদ্দটি শর্টফিল্মের প্রত্যেকটিই। গল্প, নির্মাণ, আবহসঙ্গীত- প্রত্যেকটি জায়গায় করেছে বাজীমাত। জানলে অবাক হবেন, এই ১৪জন নির্মাতার সবাই এখনও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র!
এইবারের ঈদে সেরা কাজ যদি বেছে নিতে হয়,আমি নির্দ্বিধায় বেছে নেব 'সাত দু গুণে চৌদ্দ' সিরিজ। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া আনকোরা নতুন নির্মাতারা যেভাবে তাদের ভালোবাসা ও চেষ্টায় নিজেদের প্রথম নির্মাণকে সফল করেছেন, তা সত্যিই অনুপ্রেরণামূলক।
এই পরিচালকদের সবাই এখনও সিনেমা নিয়ে পড়াশোনা করছেন কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। চৌদ্দটি শর্টফিল্ম নিয়ে সাজানো এই সিরিজের প্রতিটি শর্টফিল্ম দেখা শেষে তৃপ্তির হাসি মিলবে, সবগুলোই যে কম-বেশি ভালোলাগার তালিকায় থাকবে সেটা কল্পনাতীত ই ছিল। দর্শকদের কাছে তাদের সৃষ্টি পৌঁছে দেবার জন্য এগিয়ে এসেছেন অভিনেতা ও শিক্ষক মনোজ প্রামাণিক। তিনি তার চৌদ্দজন ছাত্র নিয়ে এই দারুন কাজটি করেছেন,যার জন্য উনি অবশ্যই সাধুবাদ পাবেন।
মনপাচিত্রের বাস্তবায়নে এগিয়ে এসেছিলেন প্রযোজক শাহরিয়ার শাকিল। ঈদে দীপ্ত টিভিতে প্রতিদিন রাতে দুইটি করে প্রচার হয়েছে, তবে তক্ষনাৎ অনলাইনে না আসায় বেশিরভাগ দর্শকের আক্ষেপ ছিল। তবে সেই আক্ষেপও ঘুচেছে, বায়োস্কোপে এসেছে এই শর্টফিল্মগুলো। প্রাইম করা নেই, একেবারে ফ্রিতেই দেখা যাবে বায়োস্কোপে। তাই দ্রুত দেখে নিন।
চৌদ্দটি শর্টফিল্ম দেখা নিয়ে আমার অনুভূতি:
১. কাউয়া
সময়কাল ১৯৪৩ সাল,দুর্ভিক্ষ ছেঁয়ে গেছে। শহরের তুলনায় গ্রামে অপেক্ষাকৃত কম। সব হারিয়ে গ্রামে আসে এক আগন্তুক। যার উপর ভর করে মহামারী, জেগে উঠে প্রতিশোধের স্পৃহা। যার সঙ্গে মিলে যায় এই সময়ের অবস্থা। গোলাম মুনতাকিম ফাহিমের নির্মাণ অসাধারণ, প্রথম নির্মানেই মেধার পরিচয় দিয়েছেন,নির্মিত হয়ে সাদাকালো ফরম্যাটে। সোহেল মণ্ডলের অসাধারণ অভিনয় এই শর্টফিল্মকে প্রাণ দিয়েছে। আরো আছেন মনোজ প্রামাণিক।
২. জুজু
নিজের কাজের প্রতি একাগ্র ভালোবাসা থাকে, তাহলে বাজেট কোনো ইস্যু না তা প্রমাণ করলেন সিজু শাহরিয়ার। তার নির্মির শর্টফিল্ম 'জুজু। ড্রাইভার ও তার সহকারী লাশ নিয়ে যাচ্ছেন কুড়িগ্রামে, রাতে পথের মাঝে ঘটে যায় সব অতিপ্রাকৃত ঘটনা। সেই ঘটনা সামলে ফিরতি পথে আরেক চমক! অতিপ্রাকৃত বা হরর গল্প নিয়ে কাজ আমাদের দেশে তেমন হয় না, হলেও সেটা দূর্বলই হয়। তবে সিজু শাহরিয়ার সেই সাহস টাই দেখালেন, ভয় ধরিয়ে দিয়েছেন মনে। আর আবহসঙ্গীত পুরো গল্পটাকে আরো জমিয়ে দিয়েছে,যে কেউই ভয় পেতে বাধ্য। অভিনয়ে অশোক ব্যাপারিকে বেশ ভালো লেগেছে, আর শেষ ছক্কা হাঁকিয়েছেন অ্যালেন শুভ্র।

৩. আনোয়ারা-মনোয়ারা
রেল লাইনে থাকা মা ও মেয়ের গল্প। মা সারাদিন কাজ করে, আর অন্ধ মেয়ে সারাদিন কাটে পুরনো ট্রেন আর রেল লাইনে। একদিন সকালে ঘটে অবাক করা ঘটনা, মেয়ের পায়ে নূপুর, আরেকদিন চুড়ি। সে এইসব কোত্থেকে পায়, মায়ের সন্দেহ হয়! তারপর মা নিজেও উপহার পায়, কিন্তু কিভাবে! ইকবাল হাসান খানের নির্মানে মেহেদী উল্লাহর গল্পের মূলভাবনা এত ভালো লাগলো, আরো বেশি ভালো লেগেছে নির্মান কৌশল। শেষের দিকে দারুণ আবহ তৈরি করলো, আর শাহনাজ খুশী ও তাসনুভা তিশার অভিনয়ে নতুন করে আবার তাদের প্রতিভা দেখা গেল।
৪. বিড়াল তপস্যা
মাসুম বাশার ও শিল্পী সরকার অপুর সংসার, পড়াশোনার জন্য থাকে অপুর বোনের মেয়ে তাসনিয়া ফারিণ আর একটি বিড়াল। ছিমছাম সুখের সংসার, কিন্তু এখানেও নেমে আসে মুখ ও মুখোশের জীবন। শেষ পর্যন্ত এই গল্পের মূলভাব দাঁড়ায় এই সমাজের একটা ব্যাধিতে, বিড়ালটা হয়ে উঠে প্রতীকি! ইশতিয়াক জিহাদের এই শর্টফিল্মটাও বেশ ভালো লাগলো। সরলরেখায় না টেনে দর্শকদের ও ভাবতে দিয়েছেন৷ তাসনিয়া ফারিন, শিল্পী সরকার অপু ও মাসুম বাশার সবাই যথাযথ অভিনয় করেছেন।
৫. দেজাভ্যু
অভীক চন্দ্র তালুকদারের শর্টফিল্মটি গড়ে উঠেছে বাবা ও ছেলের দুই প্রজন্মের গল্প নিয়ে, সময়ের প্রয়োজনে দুজনই দুজনের পরিপূরক হয়ে উঠে, শুধু অবস্থান পরিবর্তন হয়। অভিনয়ে দারুন করেছেন শাহাদাত হোসেন ও সাইয়েদ জামান শাওন, শিশুশিল্পী আরিশ ছিল প্রানবন্ত।
৬. ভূগোল+
সদ্য আঠারোতে পা দেয়া এক ছেলে, সে তার শিক্ষিকার উপর বিশেষভাবে দূর্বল। কিন্তু শিক্ষিকা ততটাই দৃঢ়চেতা, তাই সে একপক্ষীয় ভালোবাসা সেখানেই থেমে যায়। পাঁচ বছর পর আবার তাদের দেখা। পরের অংশ কিছু সিনেমাটিক লাগলেও তবে নাম যেহেতু ভূগোল প্লাস ,তাই ঐ অংশের প্রয়োজন ছিল। মানব মিত্রের নির্মানে আরশ খানের অভিনয় বেশ লাগলো, স্পর্শিয়াও নজর কেড়েছেন।
৭. সহজ সুন্দর
এক হতাশাবাদী ছেলের গল্প, জীবনের সবক্ষেত্রে যে ব্যর্থ। জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা চলে আসে, কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় সে। অন্যদিকে এক ছোট্ট মেয়ের গল্প, ফুল বিক্রি করে। তার স্বপ্ন বাড়ি বানাবে, মায়ের ভালোবাসায় বড় হবে। কিন্তু! 'দুখের তুলনা' কবিতার কথা মনে পড়ে গেল এই শর্টফিল্ম টা দেখে। গল্প হিসেবে অসাধারণ কিছু নয়, তবে সাধারনের মাঝেই থাকে আমাদের গল্প। সেটাই তুলে ধরেছেন মনপাচিত্রের বাস্তবায়নে জিডি মজুমদার। অভিনয়ে খায়রুল বাসার, মারিয়া বেশ, আরো আছে জয়িতা মহালনবিশ।
৮. ঝিলিক
ইরফান সাজ্জাদ ড্রাইভার, তার স্ত্রী সন্তান সম্ভবা। তার মালকিন মডেল তাকে জরুরী কাজে যেতে বলে, নিয়ে যেতে হয় ঢাকার বাইরে। এদিকে ইরফান সাজ্জাদের স্ত্রী প্রসব বেদনায় হাসপাতালে অন্যদিকে মডেল মালকিন নিজের সন্তান কে যাতে পৃথিবীতে আসার আগেই যেন নষ্ট করতে না হয় সেই চেষ্টা করছে! শফিকুল সাজীবের নির্মানে শর্টফিল্ম ঝিলিক ছিল ভালো প্রচেষ্টা। ইরফান সাজ্জাদ অনেক শুকিয়েছেন, ভালো করেছেন। তবে সনিকার আরো ভালো করার সুযোগ ছিল।
৯. মধুচক্র
মফস্বলে নাচ শেখান তারিন, তার একমাত্র মেয়ে তন্দ্রা ওরফে চমক। বখাটের প্রস্তাবে সাড়া না দেয়ায় চমকের নামে বাজে লিফলেট ছাপিয়ে পুরো মহল্লায় ছড়িয়ে দেয়া হয়। এতে তাদের জীবনে নেমে আসে দুর্বিষহ যন্ত্রনা! নির্মাতা হাসিব আহমেদ প্রথম নাটকেই মুগ্ধ করেছেন, ভালো লেগেছে তারিনের অভিনয়, চমক যথাযথ। স্বল্প সময়ে আরশ খান, মিলন ভট্টাচার্য এরাও আছেন।

১০. শুক্রবার
ছুটির দিন শুক্রবারের গল্প, একটি পরিবারের গল্প। সদস্য চারজন,এর মধ্যে বিবাহযোগ্য মেয়ে থাকলে মায়েদের যা হয়, সেটাই দেখানো হয়েছে। একমাত্র মেয়ে সাবিলা নূরকে দেখতে এসেছে বর পক্ষ, তাদের পছন্দ হয়ে যায় মেয়েকে। কিন্তু সাবিলা নূর এই বিয়েতে রাজি নয়, সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়, দিয়ে যায় এক হোয়াইটস অ্যাপ ভিডিও। তবে মন খারাপ করার মতো কিছু নয়, শেষের চমকে এক চিলতে হাসিতে হা হয়ে থাকার মতো। ওটার জন্যই বেশি ভালো লাগলো।
নির্মান সাদামাটা,তবে এই ধরনের গল্পে কাহিনী, সংলাপই মূল সম্পদ। হুমায়ারা স্নিগ্ধার নির্মানে সাবিলা নূর সাবলীল, বেশি ভালো লেগেছে প্রথম চেনা মার্জিয়া আক্তারের অভিনয়, কাজের বুয়ার চরিত্রে রীনা রহমানকে অনেকদিন বাদে দেখে ভালো লাগলো। শেষে বিশেষ একজনের অতিথি উপস্থিতি আরো আকর্ষন বাড়িয়ে দেয়।
১১. সেমিডেট
বাবা-মা গ্রামে চলে যাওয়ায় ফাঁকা বাসায় নিজের প্রেমিকাকে বাসায় আনে ছেলে। তবে ডেটের জন্য প্রেমিকার রয়েছে একাধিক শর্ত, ছেলে থাকে বাহানার আশায়। তবে এক সময় সেই প্রেমিকাই তার কাছে এসে ধরা দেয়, তারপর? মুনসিফ উজ জামান মিমের নির্মানে এই শর্টফিল্মের গল্প আধুনিক সমাজের তরুন তরুনীকে ঘিরে। ইয়াশ রোহান বেশ সাবলীল, প্রিয়ন্তী উর্বিকে এই প্রথম দেখলাম।
১২. জসুয়া সূর্যসেন জডার্ণ বাসকে
একটা গোবেচারা আনস্মার্ট ছেলের গল্প। মার্কেটিং জবে সুবিধা করতে না পেরে দায়িত্ব পড়ে টিয়া পাখিকে কথা শিখানোর। তার শেষ অব্দি কি হয়! অন্যগুলোর তুলনায় কিছুটা ধীরগতির, তবে পলাশ নামক ছেলেটার অভিনয় ভালো লেগেছে। এই শর্টফিল্মের নির্মাতা ছিলেন আহসাবুল ইয়ামিন রিয়াদ।
১৩. গ্যাঁড়াকল
রাশেদ মামুন অপু, নাসিরউদ্দিন খান ও মুকিত জাকারিয়া। এই তিনজনের মত দক্ষ অভিনেতাকে একই ফিকশনে পাওয়া দর্শকদের জন্য খুশির খবর। ওটিটি প্রজন্মে সম্প্রতি তিনজনই আলোচনায় এসেছেন। সেটাই করে দেখালেন রাহিল রহমান, তার শর্টফিল্মে। তিনজন মানুষ, আছে লোভ বাসনা। আর সেজন্য তারা পড়ে যান গ্যাঁড়াকলে, আর কারন তারা তিনজনই। তবে গল্পের খাতিরে একজনের জয় হয়, আর বাকিদের? ভালো লেগেছে বেশ।
১৪. নওমহল
ক্রিকেট খেলা নিয়ে জুয়ার খবর ভাইরাসের মত ছেঁয়ে গেছে। কেউ কেউ হয়তো বাজিতে জিতে যান তবে অনেকেই সর্বশান্ত হন। তেমনি এক গল্প নিয়ে সাজানো হয়েছে এই শর্টফিল্ম। এবি মামুনের নির্মানে শর্টফিল্মটি ভালোই বলা যায়, বিশেষ করে শেষ দৃশ্যটা চমকপ্রদ। অভিনয়ে মনোজ প্রামাণিক, রিফাত চৌধুরী ও তুহিন অবন্ত যথাযথ।
সবশেষে আলাদা করে বলতে হয় শর্টফিল্মগুলোর আবহসঙ্গীতের কথা। প্রতিটা কাজেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে আবহসঙ্গীত, দুর্দান্ত হয়েছে গোটা ব্যাপারটা। এই দায়িত্বে ছিলেন স্টুডিও এলকেজির কর্নধার লাবিক কামাল গৌরব, তাকে বিশেষ ধন্যবাদ। সবার জন্য শুভকামনা রইলো।