মালিক: ফাহাদ ফাসিলের সিনেম্যাটিক ব্রিলিয়ান্সের অনন্য এক নজির
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
মালিক অসাধারণ একটা সিনেমা, সিনেম্যাটিক ব্রিলিয়ান্স। এই গল্প আমাদের অজানা নয়। স্রেফ ক্যানভ্যাস বদলে দিলে, শহর বদলে দিলে এই গল্প আমাদের অজস্রবার দেখা। কিন্তু মালিক অসাধারণ তার ন্যারেশন স্টাইলে, গল্পের পরত খুলেছে ভাঁজে ভাঁজে। একেকজনের ন্যারেশনে গল্প বলা হয়েছে একেকভাবে...
উপমহাদেশে কোয়ান্টিটি ও কোয়ালিটি মিলিয়ে ফাহাদ ফাসিল বর্তমানে সেরা অভিনেতা। নো ওয়ান ক্যান ডিনাই দ্যাট, নো ওয়ান শুড। মালিক তার জলজ্যান্ত প্রমাণ। ওটিটিতে কয়েক মাস পরপরই ফাসিলের নতুন সিনেমা আসছে আর তাক লাগিয়ে দিচ্ছে। কী কনসেপ্ট, কী স্ক্রিপ্ট, কী অভিনয়, কী সিনেমা! প্রতিবার ফাহাদ আসে, দেখে, জয় করে চলে যায়।
মালিক অসাধারণ একটা সিনেমা। সিনেম্যাটিক ব্রিলিয়ান্স। এই গল্প আমাদের অজানা না। স্রেফ ক্যানভ্যাস বদলে দিলে, শহর বদলে দিলে এই গল্প আমাদের অজস্রবার দেখা। সিসিলি হোক, ধনবাদ হোক, মান্ডওয়া হোক কিংবা রামাদাপাল্লি; একটা শহরে একজন আন্ডারডগের ক্ষমতাবান হয়ে ওঠার গল্প আমাদের জানা। কিন্তু মালিক অসাধারণ তার ন্যারেশন স্টাইলে, গল্পের পরত খুলেছে ভাঁজে ভাঁজে। একেকজনের ন্যারেশনে একেকভাবে গল্প বলা হয়েছে।
শুরুতেই মালিক সুলায়মানের ক্ষমতা, তার ধর্মভীরুতা, তার রিয়ালাইজেশনের সাথে দর্শককে পরিচয় করে দেয়ার জন্য সাড়ে ১৩ মিনিটের ওয়ান শট টেক। তারপর গিয়ে মালিকের উত্থান পর্বে যাওয়া হয়। সুলায়মানের তারুণ্য থেকে শুরু করে বার্ধক্য, ফাহাদ ফাসিল প্রতিটা বয়সকেই নিজের মাঝে ধারন করেছেন। রামাদাপাল্লিও এখানে একটা চরিত্র। সমুদ্র পাড়ের এই রামাদাপাল্লি শহর ময়লার ভাগাড় আর মাছের বাজার থেকে যেন ধীরে ধীরে রাজনীতি ও ক্ষমতার প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠেছে সুলায়মানের হাত ধরে।
মুসলমান ও খ্রিষ্টানদের ভাতৃত্ববোধ, তাদের কেন্দ্র করে ধর্মের রাজনীতি, ক্ষমতাবানদের ক্ষমতা দখলের লড়াই উঠে এসেছে দারুণভাবে। সাথে সুলায়মানের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠা, সরকারের চোখের বিষ হয়ে ওঠা, তাকে শেষ করার চূড়ান্ত প্রচেষ্টা বারবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে সুলায়মান কোন পর্যায়ে চলে গেছে। বারবার একটা ডায়লগই উঠে আসে সেখানে সুলায়মানের কর্তৃত্ব বোঝানোর জন্য- রামাদাপাল্লির কেউ কখনো সুলায়মানকে হত্যা করতে পারবে না।
বিশাল অনসম্বল কাস্ট এবং হোয়াট এ কাস্ট! প্রতিটা অভিনেতা দুর্দান্ত। কেউ কারও চেয়ে এক ইঞ্চি কম না। ফাহাদ ফাসিলের সাথে পাল্লা দিয়ে অভিনয় করেছে তার সহধর্মিণীর চরিত্রে ২৪ বছর বয়সী নিমিশা সাজায়ান। ২৪ বছরের এই মেয়েকে দেখে বিশ্বাস হবে না যে সে পঞ্চাশোর্দ্ধ কোন মধ্যবয়স্কা নন। কী অসাধারণ স্ক্রিন প্রেজেন্স! এই বছরে এই মেয়ে যে ৩ টা সিনেমা করেছে (মালিক, নায়াত্তু, গ্রেট ইন্ডিয়ান কিচেন) প্রতিটাই মাস্টারপিস।
এছাড়াও ডেভিড চরিত্রে ভিনায় ফোর্ট, সুলায়মানের মায়ের চরিত্রে জালাজা, কালেক্টর আনোয়ার আলির চরিত্রে জজু জর্জ স্রেফ অসামান্য ছিলেন। প্রতিটা ছোট ক্যারেক্টারও ছাপ ফেলে গিয়েছে গল্পে। ফাহাদ ফাসিলকে নিয়ে যত বলা যায় কম হয়ে যাবে। তারুণ্যের ধূর্ততা, মধ্যবয়সের ক্লান্তি সবকিছু এক সিনেমায় কীভাবেই না নিয়ে এসেছেন তিনি। তার ক্লান্ত, কুজো চলাফেরা, তার প্রতিশোধপরায়ণ রুদ্রমূর্তি, তার প্রেমিক সজল চোখ- প্রতিটা শেডেই ফাফা অসাধারণ।
মালিকের গল্প আদতে গডফাদারেরই গল্প। মারিও পুজো যখন লিখেছেন ক্ষমতার সে পালাবদলের গল্প, সে গল্প সিসিলি হোক কিংবা রামাদাপাল্লি সবজায়গাতেই প্রাসঙ্গিক। তবে তাই বলে গডফাদারের ছায়ায় থাকে নি মালিক। নিজস্ব ছায়া তৈরি করেছে। সে ছায়ায় দাঁড়ালে মাছের গন্ধ পাওয়া যাবে, শুনতে পাওয়া যাবে আযানের সুর, নামাজের জন্য এক কাতারে দাঁড়ানো মানুষগুলোকেই একটু পরে দেখা যাবে সমুদ্রে নেমে যেতে, জাহাজ থেকে মাল চুরি করতে।
শুধু নিজেদের জন্য না, পুরো অঞ্চলের জন্য তারা অন্যায় করে। সে অন্যায় দারিদ্রের কষাঘাতে কখন ন্যায়ে পরিণত হয় কেউ টের পায় না। রামাদাপাল্লির সাধারণ মানুষ শুধু দেখে সুলায়মান নামে একটা ছেলে তাদের জন্য করছে। ময়লার ভাগাড়কে রূপান্তরিত করেছে স্কুলে, মাছের বাজারকে রূপান্তরিত করেছে পরিপাটি শহরে। সে ই তো মালিক, তাদের নেতা, তাদের রক্ষাকর্তা। মালিককে হয়তো পৃথিবী থেকে মুছে দেয়া সম্ভব কিন্তু মালিকের রেখে যাওয়া লেগ্যাসি রামাদাপাল্লির প্রতিটা মানুষ জাতিস্মরে মনে রাখবে।