সিদ্ধহস্তে গল্পের ভাঁজ খুলতে মলিউড বরাবরই দক্ষ। তবুও বৈপরীত্য ছিলো বাজেট ও কারিগরি জ্ঞানে। আজকাল সে সব দৈন্যদশাও ঘুচেছে অনেকটাই। মালায়ালাম সিনেমার বাজেট বেড়েছে, টেকনিক্যাল কারিকুরিতেও অনেকটাই এগিয়েছে এ সময়ের মালায়ালাম নির্মাণগুলো। এরকম এক বাড়বাড়ন্ত সময়ে এসে তাই প্রত্যাশা থাকবে এটাই, উৎকর্ষতার নিদর্শন চলতে থাকুক নিয়মিত।

মহামারী-কালে যখন গোটা পৃথিবীর শিল্প-সংস্কৃতি-নির্মাণ প্রায় থমকে যাওয়ার উপক্রম, ঠিক তখনই স্বরূপে ভাস্বর হয় অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলো। এবং এই জাগরণের পরবর্তী মুহুর্ত থেকে যেভাবে পালটে যেতে থাকে সিনেমা-নাটকের সংজ্ঞা, তাতে মিশে থাকে বিস্তর চমকের নানাবিধ আভাসও। পাশাপাশি, দ্রুততম সময়ের মধ্যেই নির্মাণগুলো পৃথিবীর নানা প্রান্তে পৌঁছে যাওয়ার চমৎকারিত্বে নির্মাণের সরবরাহ-জনিত বিড়ম্বনাও খানিকটা প্রশমিত হয়৷ এবং অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোর এই বহুবিধ সুবিধার ফলশ্রুতিতেই বাজিমাত করে মালায়ালাম ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি। গল্প কিভাবে বলতে হয় এবং কিভাবে দর্শকের নানাবিধ অনুভূতি নিয়ে খেলতে হয়, তা এই ইন্ডাস্ট্রির নির্মাতারা জানেন। কিন্তু সমস্যা ছিলো, নির্মাণগুলোর ঠিকঠাক সরবরাহে। সরবরাহের সেই কাজটিই যেন ত্রাতা হয়ে করে দেয় যাবতীয় সব স্ট্রিমিং সাইট! যারই ফলশ্রুতিতে মহামারী কালেও মালায়ালাম ইন্ডাস্ট্রি থেকে আসে মনে রাখার মতন অনবদ্য সব নির্মাণ। 

১. চুরুলি

লিজো জোসে পেলিসারির সিনেমা মানেই যে অন্যরকম এক সিনেম্যাটিক এক্সপেরিয়েন্স, তা সচেতন দর্শকমাত্রই জানেন। অথবা, যদি কেউ আঙ্গামালি ডায়েরিস কিংবা জালিকাট্টু দেখেন, তিনিও ধরতে পারবেন এই বাক্যের সত্যতা। সে হিসেবে পেলিসারির সাম্প্রতিক সিনেমা নিয়েও প্রত্যাশা ছিলো বিস্তর, এবং দ্ব্যর্থকন্ঠে বলাই যায়, প্রত্যাশার পুরোটাই হয়েছে পূরণ। অদ্ভুত এক ঘূর্ণি, সেখানে আটকে পড়া কিছু মানুষ আর মেটাফোরিক্যাল টুকরো টুকরো পাজল... গত বছরের দুর্দান্ত সিনেমাগুলোর তালিকায় অবধারিতভাবেই রাখতে হবে পেলিসারির 'চুরুলি'কে।

চুরুলি! 

২. মালিক 

প্রায় তিন ঘন্টার এক সিনেমা, কিন্তু সেই সিনেমার প্রথম থেকে শেষতক টান টান গল্প, পলিটিক্যাল মেটাফোর থেকে লোকাল গ্যাংস্টারের সাত-সতেরো, প্রশাসনের নির্যাতন থেকে মাইনরিটি কমিউনিটির কমপ্লেক্সিটি... কী নেই সেখানে! মহেশ নারায়ণনের সিনেমা তো এমনিতেও অনবদ্য হয়৷ কিন্তু 'মালিক' এ মহেশ নারায়ণন এবং ফাহাদ ফাসিল মিলে যে দুর্দান্ত এক ম্যাজিক উপহার দিলেন, তার সাথে কোনোকিছুর তুলনা হবেনা মোটেও। পাশাপাশি, এই সিনেমার রেশও ভেতরে থেকে যাবে বহুদিন।

মালিক!

৩. দৃশ্যম ২ 

২০১৫ সালে 'দৃশ্যম' মুক্তি পাওয়ার পরে যেন মোটামুটি এক বিস্ফোরণই হয়ে যায় মলিউডে। এরকম টপ নচ থ্রিলার দেখে মুগ্ধতার রেশ যে আকাশচুম্বী হবে, তাও বোধহয় প্রত্যাশিতই ছিলো। তবে  এই সিনেমার দ্বিতীয় খণ্ড যে আরেকটু বেশি জম্পেশ হবে, আরেকটু বেশি বিচিত্র হবে, তা বোধহয় প্রত্যাশা করেনি কেউই। এবারের গল্পে জর্জকুট্টি যেন আরো ধারালো হয়ে ধরা দেন লেখক ও নির্মাতা জিতু জোশেফের কলমে। শোনা যাচ্ছে, 'দৃশ্যম' এর তৃতীয় পর্বও নাকি আসবে। সেখানে যে আর কি কি হবে, এখন সেটাই দেখার অপেক্ষা! 

দৃশ্যম ২! 

৪. জোজি

শেক্সপিয়ারের 'ম্যাকবেথ' অবলম্বনে কালে কালে বহু নির্মাণই হয়েছে, তবু সেগুলোর মধ্যেও দিলীশ পোঠানের 'জোজি' আলাদা হয়ে থাকবে স্বকীয় গল্প বয়ানের মুন্সিয়ানায়। পাশাপাশি এ সিনেমায় যেরকম দুর্দান্ত অভিনয় করলেন ফাহাদ ফাসিল, সেখানেও বজায় থাকে মুগ্ধতার নানাবিধ সরঞ্জাম। চমকে ঠাসা গল্পের বুনোট, অজস্র ইস্টার এগস, সাটল হিউমার, ডার্ক কমেডি... সবই উপস্থিত পরতে পরতে। সে সাথে দুর্দান্ত সিনেম্যাটোগ্রাফী আর অভিনয়... একটা সিনেমা জমিয়ে দিতে আর কীই বা লাগে! 

জোজি! 

৫. হোম

মালায়ালাম ইন্ডাস্ট্রি যে কারণে বিখ্যাত, অর্থাৎ, সহজবোধ্য ছিমছাম গল্পের সাথে আলগোছে বলা কিছু সামাজিক বার্তা...সেটিই যেন পুরোভাগে উপস্থিত 'হোম' সিনেমার সর্বাগ্রে। প্রযুক্তি, সম্পর্ক, জেনারেশন গ্যাপ...নানাবিধ চলককে একত্রে পাশাপাশি বসিয়ে যে নির্মাণ উপহার দেন রোজিন থমাস, তাতে যেমন ক্ষণেক্ষণে মুগ্ধ হতে হয়, আবার কখনো কখনো বোধের প্রাচীরে বেমক্কা ধাক্কা খেয়ে থমকেও যেতে হয়। এ সিনেমার 'অলিভার টুইস্ট' চরিত্রটিও আলাদা করে মনে গেঁথে যায়। 

হোম! 

৬. মিন্নাল মুরালি

উপমহাদেশের নির্মাতারা 'সুপারহিরো' ফিল্ম বানিয়েছেন অগণিত। কিন্তু সেই সুপারহিরোদের কেউই যেন ঠিক আটপৌরে না। সবাই যেন অনেকটাই বিদেশ-ঘেঁষা, ঝা-চকচকে। কারো সাথেই কেন যেন খুব একটা আবেগের সম্পর্ক গড়ে ওঠে না। এরকম এক প্রেক্ষাপটে 'মিন্নাল মুরালি' এমন এক সুপারহিরো হিসেবে আবির্ভূত হন, যিনি খুব পরিচিত, যাকে আশেপাশের মানুষই মনে হয়। যাকে নিয়ে বিশেষণের অতিশয়োক্তি করতে হয় না মোটেও। এমন এক চরিত্র নির্মাণ, সে চরিত্রের পাশাপাশি জমাটি গল্পের বুনোট, ক্যারেক্টার স্টাবলিশমেন্ট, প্রোটাগনিস্ট- অ্যান্টাগনিস্টের দ্বৈরথ...সব মিলিয়ে 'মিন্নাল মুরালি' দুর্দান্ত এক সুপারহিরো ফিল্ম হিসেবেই সমাদৃত হয় দর্শকের কাছে। এবং বেশ সফল প্রচেষ্টা হিসেবেই স্বীকৃত হয় সব মহলে। 

মিন্নাল মুরালি! 

৭. নায়াট্টু

ভিন্ন স্বাদের এক থ্রিলারের সন্ধানই যেন নির্মাতা মার্টিন প্রাকাট তার নির্মাণ 'নায়াট্টু'তে উপস্থিত করেন। খুনের মামলায় ফেঁসে পুলিশবাহিনীর তিন সদস্যের 'ফেরার' হয়ে ঘুরে বেড়ানোর যে রোজনামচা, সে রোজনামচাতে মিশে থাকে রাজনীতি, বিশ্বাস, অবিশ্বাস, আক্ষেপ। দুর্দান্ত গল্প, দারুণ সিনেম্যাটোগ্রাফী ও অসাধারণ অভিনয়, 'নায়াট্টু'র নানা দিক নিয়ে বিস্তর কথাবার্তা হওয়া উচিত, বচসা হওয়া উচিত। হচ্ছেও। সামনেও হবে। 

নায়াট্টু! 

৮. দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান কিচেন

এই সিনেমার প্রায় পুরোটাজুড়েই এক রান্নাঘর এবং সে রান্নাঘরে দিন গুজরান করা এক নারীর গল্প, যে গল্প এতটাই অন্যরকম, খানিকটা শ্বাসরোধও যেন হয়ে আসে৷ জিও বেবি'র এই সিনেমাতে এত মেলানকোলিক সব উপাদানের উপস্থিতি, রীতিমতো চমকে উঠতে হয়। পাশাপাশি, নিজের বিবেকের কাছেও বেশ কোনঠাসা সব প্রশ্নের মুখোমুখি করে এক ঘন্টা চল্লিশ মিনিটের এ নির্মাণ! 

দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান কিচেন! 

৯. কালা 

'একই অঙ্গে নানা রূপ' বাক্যটির সার্থক প্রয়োগই যেন দেখি এ সিনেমায়৷ সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার বানাতে মালায়ালিরা এমনিতেও সিদ্ধহস্ত, পাশাপাশি সে থ্রিলারে যদি থাকে একাধিক লেয়ারের যুগপৎ উপস্থিতি, তাহলে তো কথাই নেই! রোহিত ভি.এস এর এই নির্মাণ যেমন অদ্ভুতুড়ে এক সাসপেন্সের আখ্যান দেয়, তেমনি মনস্তাত্বিক কিছু দ্বন্দ্বের মুখোমুখিও করে ক্রমশ। বৈপরীত্যে ঠাসা এ গল্প এভাবেই রূপান্তরিত হয় অনবদ্য এক নির্মাণে!

কালা! 

১০. কুরুপ

যদিও 'কুরুপ'এর চেয়ে আরো ভালো ভালো সিনেমা এবছর মলিউডে এসেছে, তাও 'কুরুপ'কে এই তালিকায় রাখার কারণ, বন্ধ থাকা প্রেক্ষাগৃহগুলোকে চাঙ্গা করতে এই সিনেমাই রেখেছে মূখ্য ভূমিকা। সুকুমার কুরুপ নামের বর্ণময় আসামীকে প্রোটাগনিস্ট করে সিনেমা, সেখানে দুলকার সালমানের নানা লেয়ারের অভিনয়, সাথে কিছু কমার্শিয়াল মালমশলা... শ্রীনাথ রাজেন্দ্র'র এই সিনেমা খানিকটা বলিউডি কমার্শিয়াল পটবয়লারকেই মনে করায় যেন! 

কুরুপ! 

সিদ্ধহস্তে গল্পের ভাঁজ খুলতে মলিউড বরাবরই দক্ষ। তবুও বৈপরীত্য ছিলো বাজেট ও কারিগরি জ্ঞানে। আজকাল সে সব দৈন্যদশাও ঘুচেছে অনেকটাই। মালায়ালাম সিনেমার বাজেট বেড়েছে, টেকনিক্যাল কারিকুরিতেও অনেকটাই এগিয়েছে এ সময়ের মালায়ালাম নির্মাণগুলো। এরকম এক বাড়বাড়ন্ত সময়ে এসে তাই প্রত্যাশা থাকবে এটাই, উৎকর্ষতার নিদর্শন চলতে থাকুক নিয়মিত। এই ইন্ডাস্ট্রিকে দেখে বাকিরাও শিখুক। সামগ্রিক উন্নতিই হোক সবার। তাহলেই কল্যান। সিনেমারও। সিনেমাক্ষেত্রেরও। 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা