দিনশেষে 'মেজর' প্রমাণ করে এটাই, চাইলে বিদ্বেষ না ছড়িয়েও দেশপ্রেমের গল্প বলা যায়, এই কাটখোট্টা সময়ে এসেও গল্প দিয়ে মানুষকে আবেগতাড়িত করা যায়, জাতীয় বীরদের সম্মান দেয়া যায়। মূলত, সেসব বিবেচনাতেই 'মেজর' অনবদ্য। এবং, সেজন্যেই, এই সিনেমা দেখার জন্য রেকোমেন্ড করা যায়...

কোনো একজন মানুষ, যিনি বীরত্বের কোনো কাজ করে নিহত হলেন, সেই মানুষটিকে নিয়ে যদি শোকগাথা লেখা হয়, সেই শোকগাথায় কি তার দোষ-ত্রুটি থাকবে? যে মানুষ রাষ্ট্রীয় কোনো সংকটের মুখে হারিয়েছেন প্রাণ, কিন্তু প্রাণ হারাবার আগে বাঁচিয়েছেন অজস্র মানুষকে... সে মানুষকে নিয়ে যখন কথা বলা হবে, সেখানে তার ব্যক্তিগত দোষত্রুটির প্রসঙ্গ কতটুকু পাবে গুরুত্ব?

প্রশ্ন দুটি এজন্যেই করা, কারণ, এই দুই প্রশ্নের উত্তরের উপরেই নির্ভর করবে, শশী কিরণ টিক্কার সিনেমা 'মেজর' কার কতটুকু ভালো লাগবে, তার নিদান। কেননা, এ সিনেমায় মেজর সন্দীপ উন্নিকৃষ্ণান (যার বায়োগ্রাফিই এই সিনেমার উপজীব্য, মুম্বাই অ্যাটাকের সময়ে যিনি ফ্রন্টলাইনে থেকে তাজ হোটেলে আটকে পড়া অজস্র মানুষকে বাঁচিয়ে নিজে নিহত হয়েছিলেন) এর পোর্ট্রেয়ালটা অনেকটা এরকম, যেখানে তাকে যাপিত 'মনুষ্য' দোষত্রুটির গণ্ডি থেকে সরিয়ে রাখা হয়েছে খানিকটা অন্য অবস্থানে৷ সিনেমার শুরু থেকেই, পুরো টিম চেয়েছিলো- 'উন্নিকৃষ্ণান' এর এই যে জার্নি, সেটাকে ইমোশনাল অ্যাঙ্গেল থেকে দেখাবেন তারা৷ তাছাড়া, এই সিনেমার 'স্ক্রিনপ্লে রাইটিং' এর পুরোটা সময়েই টিমের সাথে ছিলেন মেজর সন্দীপ উন্নিকৃষ্ণান এর মা-বাবা৷ স্বভাবতই, মৃত সন্তানের দোষ-ত্রুটি তারাও উপেক্ষা করেছেন,বা, করানোর পেছনে প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছেন৷ ফলে, পুরো সিনেমায় যেটা হয়েছে, মেজর উন্নিকৃষ্ণানের 'হিরোইক' দিককেই দেয়া হয়েছে আটমোস্ট প্রায়োরিটি, আবার, সেই হিরোইজমের সাথে ইন্ডিয়ান জিঙ্গোইজম, অ্যাকশন সিকোয়েন্স, রোমান্স আর ট্রাজেডি ব্লেন্ড করা হয়েছে৷ ফলে, শেষমেশ, এ সিনেমা যে অবয়বে দাঁড়িয়েছে, সেটিকে ইমোশনাল 'ট্রিবিউট' হিসেবে যেমন ট্রিট করা যাবে, তেমনি, একজন 'ন্যাশনাল হিরো'কে ন্যাশনালি ইন্ট্রোডিউস করাবার একটা ডিসেন্ট ডিসকর্ড হিসেবেও চিন্তা করা যাবে। এবার, এই ট্রিটমেন্ট যারা পছন্দ করেন, তাদের 'মেজর' খুবই ভালো লাগবে৷ কিন্তু, যারা স্তুতির পাশাপাশি সত্যবচনেরও অনুসন্ধান করেন, সে সত্যান্বেষীদের এ সিনেমা কেমন লাগবে, সেটা বলা খানিকটা দুরূহ। 

সিনেমার অনেকটুকু জুড়েই মুম্বাই অ্যাটাক! 

তবে, পাশাপাশি, এও ঠিক, যদিও এই বায়োগ্রাফিক্যাল ফিল্মে 'মিথ'কে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে বেশি, কিন্তু তবুও কোথাও গিয়ে সেটা আরোপিত লাগেনি। উন্নিকৃষ্ণানের ছোটবেলা, বাবার কাঁধে চেপে 'নেভি প্যারেড' দেখার সময়ে বাবাকে বলা- বাবা বড় হয়ে আমি সোলজার হবো, সেই 'সোলজার' হওয়ার লক্ষ্যেই ক্রমশ এগোনো, মাঝখানে ছিমছাম রোমান্স, প্রেম, বিচ্ছেদ, 'আর্মি'তে যাওয়ার ডাক, সেখানে গিয়ে 'সিভিলিয়ান' থেকে 'সোলজার' এ ট্রান্সফর্ম, এরপর ২৬/১১, এনএসজি (ন্যাশনাল সিকিউরিটি গার্ড) এর ফ্রন্টলাইনে থাকা, হামলাকারীদের সাথে সম্মুখ সমর, ক্লাইম্যাক্স... পুরো মিশেলটাই এত নির্মেদ, মূলত, মুগ্ধতার জায়গা সেটাই৷ এখানে 'ইন্ডিয়ান জিঙ্গোইজম' আছে, কিন্তু সে জিঙ্গোইজমে 'অ্যান্টি-পাকিস্তান' স্টেস্টমেন্ট নেই৷ একটা উদাহরণ দিই৷ সিনেমায় একটা দৃশ্য আছে এরকম, মেজর উন্নিকৃষ্ণান, ইন্ডিয়ান- পাকিস্তান বর্ডারের 'নো ম্যানস' ল্যান্ড' এ দাঁড়িয়ে পাকিস্তানী বাচ্চাদের সাথে ক্রিকেট খেলছে। খুবই নাতিদীর্ঘ দৃশ্য৷ অথচ, যে দারুণ অর্থ এই সিকোয়েন্স টা ক্যারি করেছে, সিনেমার ব্রিলিয়ান্স সেখানেই। এ সিনেমায় অকারণে ঘৃণার ছড়াছড়ি নেই, প্রোপাগাণ্ডা নেই, বিদ্বেষ কিংবা বিষবাষ্পও নেই৷ আছে শুধু এক যোদ্ধার দেশপ্রেম দেখানো। গল্প ওখানেই জমেছে। পাশাপাশি, শ্রীচরণ পাকালা'র মিউজিক, ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর কিংবা শেষদিকের ক্লাইম্যাক্সে এসে স্কোরের নিয়ন্ত্রিত ও দুর্দান্ত ব্যবহার দিয়েছে দারুন সঙ্গত। আব্বুরি রবি'র ডায়লগও ছিলো দারুণ। বিশেষ করে সিনেমার এক অংশে যখন উন্নিকৃষ্ণান এর বাবা বলেন-

আমার ছেলে কিভাবে মারা গেলো, সেটা না, বরং, আমার ছেলে কিভাবে জীবন কাটালো, সেটাই যেন হয় সবার মনে রাখার কারণ। 

তখন, দর্শক মুগ্ধ হয়েছে। আর, এরকম মুগ্ধ হবার মত শব্দবাজি অজস্রই আছে এ সিনেমায়। 

'রোমান্স' এর দিকটা আরেকটু ভালো হতে পারতো

আদিভি সেশ এর ডেডিকেশন 'মেজর' এর আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ দিক। তিনি যে শুধু সিনেমার প্রোটাগনিস্ট, তা তো না৷ সিনেমার স্ক্রিপ্ট রাইটিং ও স্ক্রিনপ্লে'ও তার। সিনেমার এডিটিং এর সময়ে দুই এডিটর- বিনয় কুমার শ্রীগিনেদী ও কোদাতি পবন কল্যান এর সাথেও লেগে ছিলেন ছায়ার মতন। সাড়ে তিন ঘন্টার সিনেমাকে আড়াই ঘন্টায় নামানো, এডিটিং এর দৃশ্যগুলোকে সিঙ্ক করাতেও রেখেছেন অবদান৷ তাছাড়া, সিনেমার জন্যে ট্রান্সফর্মও করেছেন নিজেকে। ওজন ঝরিয়েছেন, বাড়িয়েছেন, আবার, ঝরিয়েছেন। ব্যক্তিগত জীবনে বামহাতি মানুষটি চরিত্রের প্রয়োজনে ডানহাতি হয়েছেন। নিজের সবগুলো স্টান্ট নিজে করেছেন, হাঁটাচলা পাল্টেছেন। এই যে ডেডিকেশন, সেটা সিনেমাতেও হয়েছে দ্রষ্টব্য৷ আদিভি'র পাশাপাশি প্রকাশ রাজ, সবিতা ধুলিপালা, সাই মাঞ্জরেকর, রেভতী... কারো অভিনয়েই খামতি থাকেনি একবিন্দু৷ নিজ নিজ জায়গার সর্বোচ্চ ব্যবহারটুকুই করেছেন তারা৷ 

যদিও, এতসব ভালো দিক থাকা সত্বেও সিনেমার কিছু বিষয় জমেনি। ফার্স্ট হাফে উন্নিকৃষ্ণান-ইশা'র মধ্যে যে রোমান্স বিল্ডাপ হবার কথা, সেটা ঠিকঠাক ক্লিক করেনি। উন্নিকৃষ্ণান এর বাবা-মা'র অংশটুকু আরো আনা উচিত ছিলো। 'অপারেশন মুম্বাই' এর কিছু অংশের অ্যাকশন সিকোয়েন্স চাইলে আরেকটু কাটছাঁট করা যেতো। উন্নিকৃষ্ণানের পোর্ট্রেয়াল'টা মিথিক্যাল না করে, আরেকটু রিয়েলিস্টিক করা যেতেই পারতো। তাতেও দর্শকের মনোযোগের ছন্দপতন বোধহয় হতোনা। 

অভিনয়, রাইটিং, স্ক্রিনপ্লে, এডিটিং... সিনেমার অনেকটুকুতেই অবদান আদিভি সেশের! 

তবে, সেসব ছাড়াও, বাদবাকি যা হয়েছে, সেটুকুই দর্শককে ইমোশনাল করে দেয়ার জন্যে যে যথেষ্ট, সেটা দর্শকেরা একবাক্যেই স্বীকার করবেন৷ ১২০ শুট ডে, ৭৫ লোকেশন, ৮টা সেট, ২৭০০ ভিএফএক্স শটস, ৩ ভাষা, সাথে মহেশ বাবু, অনুরাগ রেড্ডি, শরত চন্দ্র, সনি পিকচারস এর একসাথে প্রোডিউসার হওয়া... সবমিলিয়ে বিগ ক্যানভাসের 'মেজর', প্রমাণ করেছে এটাই, চাইলে বিদ্বেষ না ছড়িয়েও দেশপ্রেমের গল্প বলা যায়, এই কাঠখোট্টা সময়ে এসেও গল্প দিয়ে মানুষকে আবেগতাড়িত করা যায়, জাতীয় বীরদের হোমাজ দেয়া যায়। মূলত, সেসব বিবেচনাতেই 'মেজর' অনবদ্য। এবং, সেজন্যেই,  রেকোমেন্ডেড। 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা