ভাষা আন্দোলনের সত্তর বছর এবং মাত্র তিনটি সিনেমার লজ্জা
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
একটা দেশ স্বাধীন হয়েছে, স্বাধীনতার পরে অর্ধশতাব্দী পারও হয়ে গিয়েছে, অথচ সেদেশের 'ভাষা আন্দোলন' নিয়ে সিনেমার সংখ্যা মাত্র তিনটি! তাও, এই তিনটির মধ্যে একটি আবার নির্মিত হয়েছে দেশ স্বাধীন হওয়ারও আগে! অর্থাৎ এই একান্ন বছরে 'ভাষা আন্দোলন' নিয়ে নির্মিত সিনেমার সংখ্যা মাত্র দুটি! কেন? এরকম লজ্জাজনক পরিসংখ্যানের কারণ কী? কে দায়ী এর পেছনে?
ভাষা আন্দোলন' নিয়ে বানানো আপনার সবচেয়ে প্রিয় সিনেমা কোনটি?
যদি কোনো তুমুল সাংস্কৃতিক হুল্লোড়ের মাঝখানে আচমকা এ প্রশ্ন করি, তাহলে নির্ঘাতভাবেই, অনেকে স্রেফ থতমত খেয়ে যাবেন। যারা একটু সিনেমা-টিনেমার খোঁজ রাখেন, তারা হয়তো জহির রায়হানের 'জীবন থেকে নেয়া'র কথা বলবেন। হালের সিনেমাবোদ্ধারা তৌকির আহমেদের 'ফাগুন হাওয়া'র কথাও বলতে পারেন। ভীড়ের মাঝখান থেকে ফিসফিস করে শহীদুল আলম খোকনের সিনেমা 'বাঙলা'র কথাও ভেসে আসতে পারে দুয়েকবার। কিন্তু, এই কয়টিই। এর বাইরে আর কোনো নাম আসবেনা৷ এরিক মারিয়া রেমার্কের 'অল কোয়াইট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট' এর মত ক্রমশই থিতিয়ে আসবে শোরগোল। কারণ, বলার মত আর কিছু নেই। 'ভাষা আন্দোলন' নিয়ে আমাদের গুনেবেছে সিনেমা মাত্র এই তিনটিই!
'একুশে ফেব্রুয়ারি' এলেই প্রথা মেনে কিছু বিষয় খেয়াল করি। মাইকে দেশাত্মবোধক গান, শহিদ মিনারে উপচে ওঠা ফুলের স্তুপ, সাময়িক 'বাংলাপ্রীতি', রঙচঙে পোস্টার- প্ল্যাকার্ড। এই এক দিনকে কেন্দ্র করে আবেগের যে মোচ্ছব শুরু হয়, সে আবেগ কতটুকু ভেতর থেকে আসা, আর, কতটুকু বাইরের আবরণের দেখনদারি... তা জানিনা৷ তা নির্ণয় করার কোনো সমীকরণও হয়তো নেই। তবে এটা বেশ বুঝতে পারি, 'ভাষা আন্দোলন' নিয়ে তলিয়ে দেখার, খতিয়ে ভাবার মানুষ ক্রমশই ক্ষীয়মান। সে সাথে এটাও উপলব্ধি হয়- প্রশ্ন করার মানুষও উবে যাচ্ছে ক্রমশ। যদি এরকম মানুষ সত্যিই থাকতো, তাহলে এতদিনে নিশ্চয়ই এই প্রশ্নটা একাধিকবার উচ্চারিত হতো- একটা দেশ স্বাধীন হয়েছে, স্বাধীনতার পরে অর্ধশতাব্দী পারও হয়ে গিয়েছে, অথচ সেদেশের 'ভাষা আন্দোলন' নিয়ে সিনেমার সংখ্যা মাত্র তিনটি কেন? তাও আবার, এই তিনটির মধ্যে একটি নির্মিত হয়েছে দেশ স্বাধীন হওয়ারও আগে! অর্থাৎ এই একান্ন বছরে 'ভাষা আন্দোলন' নিয়ে নির্মিত সিনেমার সংখ্যা মাত্র দুটি! কেন? এরকম লজ্জাজনক পরিসংখ্যানের কারণ কী? কে দায়ী এর পেছনে?
সপ্তাহখানেক আগেই গিয়েছে ভালোবাসা দিবস। আপনি, আমি একাধিক চ্যানেলে, ইউটিউবে অজস্র নাটক, ওয়েব ফিল্ম দেখেছি৷ সেই আমি, আপনিই আজকে একটু নিজেদের টিভিসেটের দিকে যদি তাকাই, 'ভাষা দিবস' নিয়ে কয়টা কাজ সম্প্রচারিত হবে আজ, সেটা যদি খেয়াল করি, তাহলে খানিকটা লজ্জাই পাবো। হয়তো প্রশ্নও তৈরী হবে ভেতরে, এই যে ভয়ঙ্কর ইতিহাস-বিমুখতা, স্মৃতিভ্রষ্ট হওয়ার তীব্র বাসনা, ঐতিহাসিক নির্মাণ নিয়ে অনীহা... এসবের পেছনে গুপ্তরহস্য কী? সে কারণের পুরোটাজুড়ে কি রাজনৈতিক দলগুলোর হালফিল ইতিহাস-বিকৃতি, নাকি, আমাদের বোধবুদ্ধির অসারতা? জানি, প্রসঙ্গটি বেশ রহস্যময়, অস্বস্তিকর, জটিল। সে সাথে এও জানি, এ প্রসঙ্গটির মূল ইতিহাসের খুব গভীরে প্রোথিতও।
সে মূল-অনুসন্ধানে কালক্ষেপণ করবোনা। তবে খানিকটা ভাবনা তো আসেই- 'ভাষা'র জন্যে প্রাণ দেয়ার এই পাগলামি গোটা পৃথিবীর সাপেক্ষেই যেখানে বিরলতম ঘটনা, সে ঘটনা নিয়ে খোদ আমাদেরই কেন এই উপেক্ষা? এই একুশে ফেব্রুয়ারি, যে একুশে ফেব্রুয়ারি সলতের সেই আগুন, যে আগুন থেকেই দাবানল, যে দাবানল থেকে পোড়া মানচিত্র আর যে পোড়া মানচিত্রের আড় থেকে জ্বলজ্বলে দেশ- বাংলাদেশ, সে একুশে ফেব্রুয়ারির ইতিহাস নিয়ে আমাদের কি কিছুই বলার নেই? ইতিহাস নিয়ে আমাদের সবকিছু বলা কি শেষ?
গভীর মনোযোগ দিয়ে সাম্প্রতিককালের কিছু জনপ্রিয় নির্মাতার সাক্ষাৎকার পড়লাম। মুক্তিযুদ্ধ, কিংবা, বলা ভালো, ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে নির্মাণজনিত কোনো পরিকল্পনা তাদের আছে কি না, এসব প্রশ্নের জবাব অনেকেই 'ধরি মাছ না ছুঁই পানি'র মতন এড়িয়ে গেলেন। কেউ কেউ অনিচ্ছাসত্ত্বেও মুখ খুললেন। জানালেন- প্রোডিউসার'রা ইতিহাসনির্ভর সিনেমায় অর্থলগ্নি করতে চান না। তারা মনে করেন, ভাষা আন্দোলনের সিনেমা দেখতে দর্শক আসবে না, ফলশ্রুতিতে সিনেমা চলবে না, তাদের লগ্নিকৃত অর্থ ফেরত আসবে না। এ কারণেই অনেক নির্মাতা ইচ্ছে থাকা সত্বেও ইতিহাস-নির্ভর সিনেমা করতে পারেন না। আবার অনেক নির্মাতা এও জানালেন, এদেশের ইতিহাসে এত চলকের লুকোচুরি, চাপানউতোর... এসব নিয়ে কাজ করতে গেলে এপক্ষ নাহয় ওপক্ষের রোষানলে পড়তে হয়৷ বিতর্ক এড়ানোর জন্যেও তাই কেউ কেউ দূরত্ব বজায় রাখেন এই নির্মাণগুলোর সাথে। কথাগুলো সর্বৈব সত্যি, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এটাও তো ধ্রুবসত্যি, যেসব আপত্তি দেখানো হলো, এ আপত্তিগুলো 'ভাষা আন্দোলন নিয়ে মাত্র তিনটি নির্মাণ' এর তীব্র লজ্জাজনক পরিসংখ্যানের সামনে ধোপে টেকার মত শক্তিশালী না মোটেও!
এই তো গত বছরেই, স্ট্রিমিং সাইট 'চরকি'তে বিজয় দিবস উপলক্ষ্যে 'জাগো বাহে' নামের এক অ্যান্থোলজি সিরিজ করা হলো। সেখানের 'শব্দের খোয়াব' নির্মাণটি যারা দেখেননি, একটু দেখবেন। অতলস্পর্শী গবেষণা, অর্থের কারিকুরি, জলঘোলা বিতর্ক...কিছুই নেই। পুরোটাজুড়েই আলগোছে স্নিগ্ধ করে বলা এক গল্প। যে গল্পে বাদও রইলোনা কিছু। ভাষা আন্দোলনের আবহও এলো ঠিকঠাক। অর্থাৎ 'শব্দের খোয়াব' দেখে থাকলে স্পষ্টভাবে বোঝা যাবে এটাই- সদিচ্ছা থাকলে কিংবা 'ভাষা আন্দোলন' এর জন্যে মন থেকে টান এলে, করা সম্ভব বহুকিছুই৷ আর এখন 'ওটিটি'র এই বাড়বাড়ন্ত সময়ে এরকম ইতিহাস-নির্ভর কাজ করা তো আরো বেশি সম্ভব! আরো বেশি প্রাসঙ্গিক!
প্রশ্ন উঠতে পারে, 'ভাষা আন্দোলন' নিয়ে সিনেমা-সিরিজ হলেও বা লাভ কি? উত্তর হলো- লাভ আছে। বিস্তর লাভ আছে। ঋত্বিক ঘটক বলেছিলেন- আদর্শ কিংবা বার্তা প্রচারের জন্যে সিনেমার চেয়ে বড় কোনো মাধ্যম এখনো আবিষ্কৃত হয়নি৷ অর্থাৎ, আপনার যদি বলার কিছু থাকে, কোনো বোধকে প্রমোট করার থাকে, আপনি অবশ্যই 'সিনেমা'কে টার্গেট করবেন। কারণ, সিনেমার টার্গেট অডিয়েন্স বড়, সেসাথে- বিচিত্র। এবং এই বড় ও বৈচিত্র্যময় অডিয়েন্স বিবেচনাতেই 'ভাষা আন্দোলন' নিয়ে সিনেমা বানানো উচিত ক্রমশ। এটা তো সত্যি, আজকের এই প্রজন্ম বই পড়ে খুব কম। খবরের কাগজ পড়ে আরো কম। এবং এরকম বই-তথ্য-ইতিহাস'বিমুখ প্রজন্মকে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ দিবসের বিশেষ কিছু আয়োজন দিয়ে আপনি যে দেশপ্রেমের লেশমাত্র সবকও দিতে পারবেন না, তাও অনেকটাই নিশ্চিত৷ অথচ, 'ভাষা আন্দোলন' নিয়ে আট পর্বের একটা ওয়েব সিরিজ হোক, নির্ঘাতভাবে, এই প্রজন্মের অন্তত কিছু সংখ্যক ছেলেমেয়ে হলেও বিষয়টার গুরুত্ব ধরতে পারবে। অবধারিতভাবেই পারবে। এবং এই প্রতিকূল সময়ের সাপেক্ষে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেটাই!
'একুশে ফেব্রুয়ারি' নামে এক সিনেমা বানাতে চেয়েছিলেন জহির রায়হান। স্ক্রিপ্টও রেডি ছিলো। পরে ভাইকে খুঁজতে গিয়ে শহিদ হন তিনি৷ 'একুশে ফেব্রুয়ারি'র সে স্ক্রিপ্টটিকে করা হয় গুম। গুম হয় সিনেমাটিও। আরেক নির্মাতা আমজাদ হোসেন 'শহীদ আসাদ' নামে করতে চেয়েছিলেন সিনেমা। সেটিও আর পরে আলোর মুখ দেখেনা। এবং, উদ্যোগ বলতে এটুকুই। এরপরে যা হয়, পুরোটাই নৈরাশ্য, হতাশা। সংস্কৃতির বন্ধ্যাদশা।
অবশ্য যে দেশে টিসিবির গাড়ির পেছনে রুদ্ধশ্বাসে দৌড়াতে হয় তৃণমূল মানুষকে, দূর্ঘটনায় খোলামকুচির মত মরা যেখানে স্বাভাবিক ঘটনা, সেখানে এসব সিনেমা-সংস্কৃতি-ইতিহাস নিয়ে বলা অনেকটা অরণ্যে রোদন, উলুবনে মুক্তা ছড়ানোর সামিল। সেটা জানিও। তবু বলি৷ কারণ, বলতে হয়। একটা দেশের অধঃপতন আসলে কোন মর্মান্তিক পর্যায়ে, এবং কতটা ব্যাপক তার গণ্ডি, সেটা বোঝার জন্যে এই বিষয়গুলো নিয়ে ক্রমাগত কথা বলাটা জরুরি। এবং ঠিক সে কারণেই এত শব্দব্যয়। হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগানো। যদিও নিশ্চিত নই, সময় পাল্টাবে কি না। তবুও আশা রাখি। সময় পাল্টানোর আশা। 'ভাষা আন্দোলন' নিয়ে অজস্র নির্মার্ণের আশা। সে আশায় সওয়ার হয়ে অপেক্ষা করি। নিরন্তর, একঘেয়ে অপেক্ষা। যদিও জানি না, এ অপেক্ষার প্রহর ফুরাবে ঠিক কবে! বা, আদৌ ফুরোবেই বা কী না!