'তিনি ছিলেন' নয়, তিনি থাকবেন আমাদের সবার হৃদয়ে...
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

বাংলাদেশের নায়িকাদের মধ্যে আভিজাত্য ব্যাপারটা হারিয়ে যায় বয়সের সাথে। কিন্তু কবরী সেটা সারাজীবন ধরে রেখেছিলেন। কি কথাবার্তায়, কি চাল চলনে, কি পোশাকে। যখন যেটা ভালো মনে করেছেন সেটাই করেছেন, নিজের সিদ্ধান্তে অটল থেকেছেন...
কবরীকে আমি প্রথম কোন সিনেমায় দেখেছি মনে নেই, সাদাকালো টিভিতে বিটিভিতেই হবে। তবে শৈশবে উনাকে দেখলেই মনে পড়ে ফুলের মালা হাতে নিয়ে 'সে যে কেন এলো না' গান টা আর সব সখীরে পার করিতে'। কালের প্রবাহে গান দুইটা যে কি পরিমান আইকনিক হয়ে উঠেছে সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। আর কারো অভিনীত গান এই পর্যায়ে আসতে পারেনি।
একবার বিটিভিতে ক্ল্যাসিক চলচ্চিত্র উৎসব চলতো, প্রতি শনিবারে দিত। প্রথম দিনেই দিয়েছিল 'সুতরাং', কবরী প্রথম সিনেমা। পরানে দোলা দিল এ কোন ভোমরা গানে সেই চৌদ্দ বছরের কিশোরী যেন আমার মন কেড়ে নিল। এরপর ঐ উৎসবেই সাত ভাই চম্পা, অরুন বরুন কিরন মালা, দ্বীপ নেভে নাই, দর্পচূর্ণ, নীল আকাশের নীচে, সুজন সখী- সবগুলো দেখেছিলাম। যতই দেখি কবরীর প্রতি মুগ্ধ হই। এর কিছুদিন পরেই সাংসদ হলেন, সেখানেও অনেক ঘটনা।
বড় হয়ে কবরীর ছবিগুলো দেখতে লাগলাম, 'সারেং বউ' ছবিতে যে অভিনয় করেছিলেন শুধুমাত্র তাতেই তিনি চির অমর থাকবেন। তিতাস একটি নদীর নাম, মাসুদ রানা, আরাধনা, দুই জীবন- আরো অনেক ছবি। ইউটিউবের যুগে এসে আরো সুবিধা হলো। 'বধু বিদায়' এর মত ছবি দেখতে পারলাম, যে ছবিতে কবরী একাই আলো কেড়ে নিয়েছিলেন, দেবদাসের পার্বতী হয়েছেন। দুই বছর আগে ঈদে 'ময়না মতি' দেখে আরেকবার মুগ্ধ হয়েছিলাম, কি সারল্য তার অভিনয়ের ব্যক্তিত্বে।
উনি সিনেমা নির্বাচনে সব সময় ই সচেতন থাকার চেষ্টা করেছেন, যেকারণে তার দুর্বল ছবি একেবারেই কম কিংবা বয়সকালেও যত্রতত্র ছবি করে নিজের আভিজাত্য কমাননি। আভিজাত্যের কথা যখন উঠলোই তখন বলা ভালো, বাংলাদেশের নায়িকাদের মধ্যে আভিজাত্য ব্যাপার টা হারিয়ে যায়। কিন্তু কবরী সেটা সারাজীবন ধরে রেখেছেন। কি কথাবার্তায়, কি চাল চলনে, কি পোশাকে। যখন যেটা ভালো মনে করেছেন সেটাই করেছেন, নিজের সিদ্ধান্তে অটল থেকেছেন। ধর্ম পরিবর্তন, একাধিক বিয়ে- এসব নিয়ে বিতর্কের মুখে পড়লেও সবগুলোই সামলে নিয়েছেন।

মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি এই দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নায়িকা, চাইলেই তিনি আড়ালে থাকতে পারতেন। কিন্তু তা করেননি, কলকাতার পথে পথে ঘুরেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য,সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। ১৯৭৫ এর পরে যখন দেশের রদবদল ঘটলো, অনেকেই সুবিধাবাদী হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু তিনি ছিলেন নিজ অবস্থানে অটল, প্রতিবাদ করেছেন। যার জন্য চক্ষুশূল হয়েছিলেন ক্ষমতাবানদের।
রাজ্জাকের সঙ্গে তার জুটি এদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় জুটি, এই জুটির যখন বৃহস্পতি তুঙ্গে, তখনই রাজ্জাকের একটি কথায় সিদ্ধান্ত নেন আর রাজ্জাকের সঙ্গে ছবি করবেন না। রাজ্জাক তখন সুপারস্টার, তবুও এই সিদ্ধান্ত থেকে কেউ সরাতে পারেনি কবরীকে। দুজনকে একত্রিত করতে প্রায় ৩০ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল। বেশিরভাগ তারকারাই জনপ্রিয়তা হারাতে হারাতে সিনেমা করা ছেড়ে দিন, এক্ষেত্রেও তিনি ব্যতিক্রম। প্রতিকূল পরিবেশের জন্য সিনেমা থেকে যখন অনিয়মিত হয়ে আসছিলেন তখনো তিনি জনপ্রিয় নায়িকা৷ এমন সাহসী সিদ্ধান্ত যে কারো পক্ষে নেয়া সম্ভব না, তিনি নিয়েছিলেন কারন তিনি কবরী। পরিচালনা করেছেন 'আয়নার' মত সুন্দর ছবি, দ্বিতীয় ছবির ও কাজ চলছিল, কিন্তু শেষ করে দিয়ে যেতে পারলেন না।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের প্রথম আইকনিক নায়িকা কবরীই, পেয়েছেন মিষ্টি মেয়ের খেতাব। ষাটের দশকের তরুনদের কাছে তিনি ছিলেন স্বপ্নসুন্দরী, এখনকার যুগে যেটাকে বলা হয় ক্রাশ৷ বাংলাদেশের পাঁচজন নায়কের অভিষেক ঘটেছিল তার বিপরীতে। তার অভিনীত সবচেয়ে বেশি গানই আজ কালজয়ীর খেতাব পেয়েছে। তুমি আসবে বলে, তুমি যে আমার কবিতা থেকে চিঠি দিও প্রতিদিন, আবার দুজনে দেখা হলো- অসংখ্য গান। শাহনাজ রহমতউল্লাহ, সাবিনা ইয়াসমিনের সঙ্গে উনার ছিল দারুণ রসায়ন। শাহনাজ চলে গিয়েছেন বছর দুয়েক আগে, এমনই হঠাৎ করে। আর আজ চলে গেলেন কবরী।
কবরীর সুসময়ে জাতীয় পুরস্কার ছিল না, অভিনেত্রী হিসেবে একবার ই পেয়েছেন এই পুরস্কার, এরপর অনেক বছর পর আজীবন সম্মাননা। এত বর্ণাঢ্যময় ক্যারিয়ার, মুক্তিযুদ্ধে অবদান তবুও উনাকে আজও একুশে পদক দেয়া হলো না। অথচ তিনি শুধু একুশে পদক নন, স্বাধীনতা পুরস্কারও প্রাপ্য। ইতিহাসের জয়গান হলে একদিন হয়তো পাবেন, তবে আক্ষেপ থেকে যাবে, জীবিত থাকাকালীন দেখে যেতে পারলেন না।
আজ থেকে ঠিক এক বছর আগে করোনার কাছে হার মেনেছিলেন এই সফল নারী, পাড়ি জমিয়েছিলেন অনন্তলোকে। যেখানে অপেক্ষা করছিলেন তার প্রিয় সহকর্মীরা। পৃথিবীতে দর্শকেরা তার অভিনীত ছবি, গান দিয়ে সারাজীবন মনে রাখবে, চির অম্লান হয়ে থাকবেন তিনি। কবরীর গুণমুগ্ধ ভক্তদের ও বয়স হয়েছে, তারাও চলে যাবেন একে একে। হয়তো সেখানেই দেখা হবে অনেকের সাথে। নতুন প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে যাক উনার আপন প্রতিভা, তারাও জানুক কবরীর মত একজন নায়িকা আমাদের ছিলেন।
'তিনি ছিলেন' হবে না, তিনি থাকবেন আমাদের সবার হৃদয়ে...