এই সিনেমার মূল নায়ক পরিচালক। ধানুশ শুধু তাকেই অনুসরণ করেছেন। গ্রামীণ প্রেক্ষাপটের এই গল্পে যেভাবে জাতি বিদ্বেষ, সংস্কার, প্রেম, দ্বন্দ্ব উঠে এসেছে...

মারি সেলভারাজের আগের সিনেমা পেরিয়ারাম পেরুমাল আমার দেখা সেরা কিছু সিনেমার মধ্যে অন্যতম। সেলভারাজের সিনেমা নিয়ে বিশ্লেষণ, কাটাছেঁড়া হবে একসময়। ভারতজুড়ে যে জাতবিদ্বেষের বিভিন্ন স্বরূপ আমরা নাটক, সিনেমা কিংবা ক্রাইম পেট্রোলে দেখে এসেছি সেগুলো যে কতোটা খেলো সেটা পেরিয়ারাম পেরুমাল দেখিয়ে দিয়েছিল। আমার মনে হয়েছিল সেলভারাজ মনে হয় সেরকম একটা সংস্কৃতি থেকেই উঠে এসেছে নাহলে এতো নিষ্ঠুরভাবে দেখাতে পারতো না। 

একই পরিচালকের কার্নান দেখে আবারও একই অনুভূতি হল। এবার মনে হল জাত বিদ্বেষ তো দূরে থাক, যেসব গ্রাম-যেসব অঞ্চলের গল্প মফস্বল পর্যন্ত আসতে দম হারিয়ে ফেলে, শহর তো দূরের কথা সেসব গ্রামের কালচার, সারভাইভাল, স্ট্রাগল এগুলো সেলভারাজ নিজে যাপন করে এসেছেন। নাহলে এতো নির্মমভাবে দেখানো সম্ভব না।

কার্নান সিনেমার গল্প তেমনই একটা গ্রাম নিয়ে। যে গ্রাম পুরোটাই একটা পরিবার। নিজেদের মতো করে মাথা গোঁজার ঠাই করে নিয়েছে। পড়াশোনা, চাকরি বাকরি এগুলো স্বপ্নের মতো ব্যাপার। প্রয়োজনে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাবার জন্য বাস যে থামবে সেটাও থামে না তাদের গ্রামের রাস্তায়। মূল যে গ্রাম সে গ্রামের বাস স্টপে গিয়ে তাদের যাতায়াত করতে হয়। সেটাও কয়েক কিলোমিটারের পথ। শোষণের চূড়ান্ত মাত্রায় অবস্থান করছে তারা যুগযুগ ধরেই। কেউ কিছু বলে না, সহ্য করে নিয়েছে। 

কিন্তু সহ্য করতে পারে নি কার্নান, গ্রামেরই এক রগচটা ছেলে। ছোটবেলায় স্বজন হারানোর বেদনায় হোক কিংবা শোষিত হতে হতে সে প্রতিবাদী হয়ে ওঠে, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে যেসব শোষণকে স্বাভাবিক মেনে এসেছে তার পরিবার সেগুলো নিয়েই সে প্রশ্ন তোলা শুরু করে।

কারনান সিনেমার পোস্টারে ধানুশ

কিন্তু প্রশ্ন কেন তোলে না শোষিত মানুষ সেটির প্রমাণ পেয়ে যায় খুব দ্রুতই। যুগ যুগ ধরে, বছরের পর বছর ধরে অন্যায় মাথা পেতে নিতে নিতে অন্যায় করাটাও যেমন ন্যায়সঙ্গত ও অধিকার মনে হয় শোষকদের কাছে তেমনি অন্যায় সয়ে যাওয়াটাও 'শান্তিতে আছি' বলে মনে হয় শোষিতদের কাছে।

আবারও বললাম এই সিনেমার মূল নায়ক পরিচালক। ধানুশ শুধু তাকেই অনুসরণ করেছেন। গ্রামীণ প্রেক্ষাপটের এই গল্পে যেভাবে সংস্কার, প্রেম, দ্বন্দ্ব উঠে এসেছে তা ওরকম জীবন যাপন না করলে কীভাবে বলা যায় আমি জানি না আসলে। 

ধানুশ জীবনে যতগুলো গুরুত্বপূর্ণ সিনেমা করেছেন তা তার বয়সী কিংবা তার চেয়ে সিনিয়র অনেকে অর্ধেকও করে নি। ধানুশের সিনেমাগুলো গুরুত্বপূর্ণ এইজন্য না যে সিনেমায় একটা ম্যাসেজ থাকে, এগুলো সেকেলে কথা। তার সিনেমা গুরুত্বপূর্ণ কারণ সে তার মানুষের গল্প বলে। যে মানুষের গল্পগুলো সে বলাতে বেশি মানুষ জানতে পারে। যে গল্পগুলো সেখানকার মানুষদের নিজস্ব, সেখানকার সংস্কৃতি বহন করে।

সব মিলিয়ে কার্নান অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটা সিনেমা। হ্যাঁ, পেরিয়ারাম পেরুমালের মতো না। কিন্তু পেরিয়ারাম পেরুমালকে খুব কম সংখ্যক সিনেমাই ছুঁতে পারবে। সেলভারাজ ছুঁতে চান নি। তিনি গল্প বলে যেতে চেয়েছেন। এক পাহাড়ি গ্রামের গল্প। যেখানকার মানুষ কুসংস্কারাচ্ছন্ন, যেখানকার মানুষ একজন মানুষ হিসেবে কতটুকু পাওয়া দরকার এখনো বুঝে ওঠে নি, যেখানকার বালক, তরুণ, বৃদ্ধ-মহিলারা হাতে লাঠি-তলোয়ার তুলে নিয়েছে প্রথমবারের মতো প্রতিবাদ করবে বলে...


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা