নির্মাতা তানিম নূরের ইচ্ছে ছিলো, তিনি তার নির্মাণের বরাতে ঢাকার পটভূমিতে কোনো এক ফিকশনাল গোয়েন্দাকে স্টাবলিশ করবেন৷ সে কারণেই 'কাইজার'কে বানিয়েছিলেন ড্রিম প্রজেক্ট, পাখির চোখ। বেশ যত্ন নিয়েই যে তিনি করেছেন কাজটি, তার ছাপ মেকিংয়েই চোখে পড়ে...
কোনো একজন নির্মাতা যদি গোয়েন্দাকাহিনীর পাড় ভক্ত হন, এবং তিনি যদি থ্রিলার ওয়েব সিরিজ বানাতে উদ্যোগী হন, তাহলে সে সিরিজে যে প্রচুর ফিকশনের রেফারেন্স আসবে, মূলত সেটিই প্রাসঙ্গিক। আর বিষয়টি যদি এমন হয়, বাংলাসাহিত্যে আমরা যেসব গোয়েন্দা-গল্প ছেনেকুটে বড় হয়েছি, তারাই এই নির্মাতারও নির্মাণের উপকরণ, আর তেহারির ভাতের ফাঁকে ফাঁকে শাঁসালো মাংসের মত যদি এই গোয়েন্দারাই ক্রমশই চলে আসেন গল্পে, খণ্ড খণ্ড নস্টালজিয়ায় মতন... তাহলে তা যে সাধারণ দর্শকদের জন্যেও বেশ উপভোগ্য হবে, সেখানেও নেই কোনো নাটকীয়তা।
এতসব কথার অবতারণা নির্মাতা তানিম নূরের নির্মাণ 'কাইজার' নিয়ে বলার জন্যে। যদিও 'কাইজার' জার্মান শাসকদের টাইটেল, কিন্তু হইচই'তে আসা থ্রিলার ওয়েব সিরিজে 'কাইজার' একজন মানুষের নাম। যিনি একজন ডিবি অফিসার। তিনটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য- ডিভোর্সি, গেমার এবং গোয়েন্দা.... নিয়ে যার বসবাস। যিনি পুলিশ, আবার যিনিই ভিডিও গেমে চরম মাত্রায় আসক্ত, আবার রক্ত দেখলে যিনিই হড়বড়িয়ে বমি করেন ক্রাইম সিনে... 'কাইজার' চরিত্রটি এই বৈপরীত্যে ভরা অনুষঙ্গের যুগপৎ মিশেলও। এবং, এই অন্যরকম অথবা অদ্ভুতুড়ে 'কাইজার' সাহেবের কাছে আসা 'ডাবল মার্ডার মিস্ট্রি'র কেস-সলভ নিয়েই পুরো গল্প।
এ গল্পে শুধু যে মৃত্যু, বিবাহ-বিচ্ছেদ, মর্টাল কমব্যাট কিংবা থকথকে রক্তই আছে, তা না। এখানে গলাকাটা লাশ আছে। লাশের পেছনে একাধিক চক্র আছে। রিহ্যাব সেন্টার আছে। মানুষের সাইকোলজি আছে। সাইকোলজির তলানিতে কিছু অস্বস্তির সত্যিও আছে। পাশাপাশি, তিন গোয়েন্দা, ফেলুদা, ব্যোমকেশ, ক্রিস্টি কিংবা কোনান ডয়েল তো আছেই। সবমিলিয়েই, এক পটবয়লার।
যদি কেউ আশা করে থাকেন- 'কাইজার' খুব রোলারকোস্টার গতির এক থ্রিলার, সাসপেন্সে ঠাসা গল্প... তাহলে তিনি খানিকটা আশাহতই হবেন। এ গল্পে টিপিক্যাল থ্রিলার এলিমেন্টস যেমন- শুরুতেই মৃত্যু, মৃত্যুকেন্দ্রিক রহস্যের ঘনঘটা, এক বা একাধিক চক্রের তৎপরতা, গোয়েন্দাকে ব্যক্তিগতভাবে হামলা, ফ্যামিলি ক্রাইসিস, শেষে এক টুইস্ট...আছে সবই। কিন্তু সে সব এসেছে বেশ ঢিমেতালে৷ খানিকটা রসিয়ে রসিয়ে। সে কারণেই কোনো পর্বের রানটাইম টিপিক্যাল ২৫-৩০ মিনিট পার হয়ে এগিয়েছেও অনেকটুকু। ঘটনা-পরম্পরায় মনোযোগ দিলেও নির্মাতা অনেকটুকু খেয়াল রেখেছেন শব্দবাজিতে, চরিত্রের 'মানুষ' হয়ে ওঠায়। ফলে, দিনশেষে যা দাঁড়িয়েছে, সেটি পুরোপুরি রগরগে থ্রিলার না হলেও যা হয়েছে, সেটিও উপভোগ্য। বেশ উপভোগ্য।
'আফরান নিশো'র হইচই'তে প্রথমবার আসা৷ অভিনয়টাও খারাপ হলোনা। 'কাইজার' যেরকম রগচটা ও উদ্ধত, সেটা বেশ ভালোভাবেই স্টাবলিশড হলো তার চরিত্রে। মনের সুখ মিটিয়ে খিস্তিখেউড় ও ভায়োলেন্স যেভাবে দেখালেন পুরো সিরিজে, সেই একই মানুষ মেয়ের কাছে হয়ে থাকলেন 'আদর্শ বাবা'র প্রতিমূর্তি। 'ইনভেস্টিগেশন' এ গিয়ে তারই আবার অন্য মূর্তি৷ ক্ষুরধার চিন্তা, আর, আউট অব বক্স মুভমেন্ট। মাল্টি শেডের ক্যারেক্টার। সামলালেনও সব ভালোভাবে। পাশাপাশি, অন্য চরিত্রেরাও ভালো। মোস্তাফিজুর নূর ইমরান ভালো। ইমতিয়াজ বর্ষণ অনবদ্য। 'রাফ অ্যান্ড টাফ' নো ননসেন্স ক্যারেক্টার আর ক্ষণেক্ষণে 'জন উইক'কে মনে করিয়ে দেয়া কস্টিউম নিয়ে দুর্দান্ত। সে সাথে- শতাব্দী ওয়াদুদ, শাহেদ আলী, দীপান্বিতা মার্টিন, স্বাগতা... নিজ নিজ চরিত্র বুঝে সবাই ঠিকঠাক। আহমেদ রুবেল এর ছোটখাটো এক চরিত্র ছিলো। তিনিও ঠিকঠাক। 'কাইজার' যদি সামনে এগোয়, তাহলে ধারণা করতে পারি, 'আহমেদ রূবেল' এর চরিত্রটির কিছু লেয়ার সামনের দিকে পাওয়া যাবে। প্রত্যাশা থাকবে এই চরিত্রটির উপরেও।
যদিও সিরিজের গল্প এগিয়েছে ধীরগতিতে, তবে এও ঠিক, গল্প ঝুলে পড়েনি কোথাও। অর্থাৎ, যে গতিতে শুরু হয়েছিলো, সে গতিতেই গল্প হয়েছে শেষ। পাশাপাশি, কালার গ্রেডিং, সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, বিজিএম কিংবা ক্যামেরার কাজও সন্তোষজনক। চরিত্রেরাও দারুণ। ডায়লগ দারুণ। গল্পটাও বেশ জমাটি। সহজসরল। হালকা।
নির্মাতা তানিম নূরের ইচ্ছে ছিলো, তিনি তার নির্মাণের বরাতে ঢাকার পটভূমিতে কোনো এক ফিকশনাল গোয়েন্দাকে স্টাবলিশ করবেন৷ সে কারণেই 'কাইজার'কে বানিয়েছিলেন ড্রিম প্রজেক্ট, পাখির চোখ। বেশ যত্ন নিয়েই যে তিনি করেছেন কাজটি, তা নির্মাণেই দ্রষ্টব্য। সে কারণেই তাই বলা, 'কাইজার'কে নিয়ে যদি তিনি আরো এগোনোর পরিকল্পনা করেন, তাহলে গল্প নিয়ে যেন তিনি আরেকটু ভাবেন, অন্যরকম সব ক্রাইসিস যেন যোগ করেন নির্মাণে, শেষের চমক যেন আরেকটু খোলতাই করেন। কারণ 'কাইজার' এর বাকি সবই ঠিকঠাক। শুধু গল্পটাই একটু দূর্বল। যদি এই দূর্বল দিকে খেয়াল রাখা হয়, যদি পরবর্তী নির্মাণে কাইজার পাশা, অম্লান মিলফোর্ড আর তন্ময় আমান.... একসাথে যৌথভাবে 'তিন গোয়েন্দা'র 'অল্টার ইগো' হয়ে নতুন কোনো অপারেশনে যুক্ত হয়, তাহলে রকি বীচের পাশের সেই স্যালভিজ ইয়ার্ডের খানিকটা নষ্টালজিয়া পাকাপোক্ত হয়ে আমাদের ভেতরেও যে ভর করবেনা... সেও বা উড়িয়ে দেই কিভাবে? এবং, মূলত, ঠিক সেজন্যেই, বাড়বাড়ন্ত প্রত্যাশা। এবং শুভকামনা।