দুর্দান্ত গল্প, নির্মেদ গল্প-বয়ান, শেষাংশে বেমালুম চমকে যাওয়ার মত টুইস্ট আর সব চরিত্রের দোর্দণ্ডপ্রতাপ অভিনয়... একটা চলচ্চিত্রের সব বিভাগই যদি এমন মনে রাখার মত কাজ করে, তাহলে সে সিনেমা নিয়ে কথা হবে নাও বা কেন? সে সিনেমা নিয়ে মুগ্ধতা মাত্র এক দশকেই কমবেও বা কেন? সে সিনেমা 'কাল্ট ক্লাসিক' এর মর্যাদা পাবে নাও বা কেন?
সাল ১৯৯৯। এক মহিলা আমেরিকা থেকে এলেন কলকাতায়। কলকাতার 'গ্রাণ্ড ওবেরয় হোটেল' এ কাজ নিলেন। আমেরিকা থেকে কলকাতায় আসার অন্যতম কারণ, তার প্রেমিকের স্মৃতিবিজরিত এই শহরে কিছুদিন কাটানো। তার প্রেমিক যেখানে যেখানে গিয়েছিলো, যেসব জায়গায় ঘুরেছিলো, সেসব জায়গায় গিয়েও নিজেও পরিচিত হওয়া। তা তিনি করলেনও। এবং পরবর্তীতে নিজের কলকাতা-বাসের এই অভিজ্ঞতার মূলভাবকে অক্ষুণ্ণ রেখে তিনি একটা গল্পও লিখলেন।
লেখিকার সে গল্প পছন্দ হলো এক বাঙ্গালী পরিচালকের। সেই পরিচালকও এরকমই এক গল্প ভাবছিলেন- যেখানে এক অন্তঃসত্ত্বা মহিলা আসবেন অপরিচিত এক শহরে। যে শহরের ভাষা থেকে সবকিছুই তার অপরিচিত, সে শহরেই তিনি বেঁচে থাকার সংগ্রাম করবেন নিজের মত। প্রাথমিক ভাবনা থেকে এলো গল্প। সে গল্পের সাথে ডালপালা মিশিয়ে সাজানো হলো দুর্দান্ত এক থ্রিলারের মঞ্চ। সে মঞ্চকে উপজীব্য করে সিনেমা মুক্তি পেলো। থ্রিলারপ্রেমী সবাই সিনেমাটায় বিস্তর মুগ্ধও হলেন। বিশেষ যে সিনেমা সম্প্রতি পার করেছে দশটি বছর। সে সিনেমাটির নাম- কাহানি। পরিচালক- সুজয় ঘোষ। মূল গল্পের লেখিকা- অদ্বৈত কালা।
লেখিকা অদ্বৈত কালার গল্প অবলম্বনে সুজয় ঘোষ 'কাহানী' বানানোর শুরুতেই ভেবেছিলেন, এ গল্পের প্রোটাগনিস্টকে তিনি আনবেন কলকাতায়। ভারতবর্ষের অন্য কোনো বড় শহরে তিনি চাইলে গল্পটিকে নিতেই পারতেন, কিন্তু, তিনি চেয়েছিলেন- নিজের শেকড়, যেখানে ক্রমশ বেড়ে ওঠা, সে জায়গাকেই খানিকটা ট্রিবিউট দিতে। তাছাড়া, জোব চার্নকের 'কলকাতা'র যে দ্বৈতসত্তা, অর্থাৎ যেখানে হাতে টানা রিকশা আর মেট্রোরেল চলে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে, যেখানে প্রাচীন ও নবীনের মিথস্ক্রিয়া আশ্চর্য সাবলীলতায় থাকে পাশাপাশি... এই বিষয়টাও নির্মাতা আনতে চেয়েছিলেন গল্পে। কারণ, গল্পের প্রোটাগনিস্টেরও যেমন দ্বৈতসত্তা, তেমন শহর কলকাতারও। প্রচ্ছন্নে থেকে এই যে চরিত্র ও স্থানের গভীর মিল, সে বিষয়টি 'কাহানি'কে যে খানিকটা অন্য অবয়বেই আনবে সামনে, তাও হয়তো চিন্তায় ছিলো তার। আর 'কাহানি'র উৎকর্ষতার পেছনের অন্যতম কারণ যে চরিত্র হিসেবে 'কলকাতা'কে পাওয়া, সেও তো ধ্রুবসত্যি। কলকাতার হাবভাব, 'ভিদ্যা' ক্রমশ 'বিদ্যা' হয়ে ওঠা, সরীসৃপ, ট্রামলাইন, দুর্গাপূজা, ভাসান যাত্রা, গরদের শাড়ি, সিঁদুরখেলা... দুর্দান্ত এক থ্রিলারের সাথে এভাবে যে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে যাবে কলকাতা... তাও ছিলো ভাবনার অতীত।
আরেকটা বিষয়, শহর কলকাতা এর আগেও বলিউডি নানা নির্মাতার সিনেমাতেই এসেছে। কিন্তু সেসবের সাথে এই সিনেমার গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য, এই সিনেমায় টিপিক্যাল কলকাতার বাইরেও এমন এক কলকাতা এসেছে, যাকে নিয়ে এর আগে ডিল করেনি কেউই। সুজয় ঘোষ সেখানেই এনেছেন তফাত। তার কলকাতায় বব বিশ্বাসের মত সিরিয়াল কিলার ঘুরে বেড়ায় প্রকাশ্যে। তার কলকাতায় শিকার ও শিকারীর নিঃশ্বাস যুগপৎ ঘুরপাক খায় একই কক্ষরেখায়, তার কলকাতায় চিটচিটে ঘামের সাথে সঙ্গত করে উষ্ণ রক্তও... এই যে জটিল ও কুটিল কলকাতার আখ্যান, সেটিও অনায়াসেই উঠে এসেছিলো 'কাহানি'র ক্যানভাসে৷ 'কাহানি'র চমৎকারিত্বের পেছনে যেটিও এক অন্যতম কারণ।
যদিও সুজয় ঘোষের 'কাহানি' সময়ের ফেরে 'কাল্ট ক্ল্যাসিক' এর মর্যাদাই পেয়ে গিয়েছে, তবু বিস্ময়ের ব্যাপার এটাই, এই সিনেমা বানাতে গিয়ে কম ঝক্কিও পেরোতে হয়নি তাকে। 'কাহানি'র নির্মাণ নিয়ে তিনি যখন এগোচ্ছেন, তখন তার ক্যারিয়ারের অবস্থাও ঠিক সুবিধের নয়। এর আগে টানা দুইটি সিনেমা ফ্লপ হয়েছে। প্রোডিউসাররা খুব একটা ভরসা করতে পারছে না তার উপরে। পাশাপাশি, 'কাহানি'র গল্পটাও এমন, যেখানে থ্রিলার সিনেমা এগোচ্ছে এক ফিমেল ক্যারেক্টারকে লিডরোলে রেখে... স্বভাবতই, আস্থার জায়গাটাও ভীষণ নড়বড়ে। ফলে, বহুদিন ধরেই এই নির্মাতাকে ঘুরতে হয়েছে প্রযোজকদের দ্বারে দ্বারে৷ শেষপর্যন্ত, বহু বিপত্তি টপকে মুক্তি পেয়েছে সিনেমা। এবং বাকিটা সবারই জানা।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই সিনেমার সাফল্য একটা বিষয় বুঝিয়েছিলো স্পষ্টভাবে- ফিমেল ক্যারেক্টার লিড রোলে থাকলেও সিনেমা হিট হতে পারে। বদ্ধমূল সে ন্যারেটিভ, অর্থাৎ, 'পুরুষ লিডরোলে না থাকলে সিনেমা হিট হবেনা', সে ন্যারেটিভকেও ধাক্কা দিয়েছিলো 'কাহানি।' তারই ধারাবাহিকতায়, 'কাহানি'র পরবর্তীতে আরো কিছু এমন সিনেমা মুক্তি পায় যেখানে নারীরা ছিলেন নির্মাণের প্রোটাগনিস্ট। তারা করেছিলেনও দুর্দান্ত অভিনয়ও। এখন আকচার যে ফিমেল-লেড ফিল্ম দেখা যায়, তার পেছনে এক বড়সড় অবদান যে 'কাহানি'র, তা বলা কিন্তু মোটেও অতিশয়োক্তি না।
'কাহানি'র আরেক চমৎকার বিষয়- চরিত্র বিন্যাস। 'বিদ্যা ভিনসেন্ট'রূপে বিদ্যা বালান যে অসাধারণ, তা নিয়ে বোধহয় লেশমাত্র সন্দেহ নেই কারোরই। বিদ্যা বালান ছাড়াও বাকি যে সাপোর্টিং কাস্ট, তারাও যে মুগ্ধকর, সেখানেও কি 'যদি-কিন্তু'র সুযোগ আছে মোটেও? অর্ণব বাগচী, ইনস্পেক্টর রানা, ইন্সপেক্টর চ্যাটার্জী, মিঃ খান কিংবা বব বিশ্বাস... কারো চরিত্রের মাত্রা নিয়ে সামান্যতম প্রশ্ন তোলারও সুযোগ নেই। এই যেমন, বব বিশ্বাসকেই ধরি। মাত্র কয়েক মিনিটের জন্যে এসে 'বব বিশ্বাস' যে এমন জনপ্রিয় হবেন, তাকে নিয়ে যে আস্ত একটা সিনেমাই করা হবে পরে, সেটাও তো এই চরিত্রেরই চমৎকারিত্বের অবদান। সবাই মিলে দুর্দান্ত অভিনয়ের যে পসরা এখানে, 'কাহানি'কে মনে রাখার সেও এক বড়সড় কারণ।
ঠিক এসব কারণেই 'কাহানি' এক দশক পরে এসেও সমান আলোচিত, প্রশংসিত। দুর্দান্ত গল্প, নির্মেদ গল্প-বয়ান, শেষাংশে বেমালুম চমকে যাওয়ার মত টুইস্ট আর সব চরিত্রের দোর্দণ্ডপ্রতাপ অভিনয়... একটা চলচ্চিত্রের সব বিভাগই যদি এমন মনে রাখার মত কাজ করে, তাহলে সে সিনেমা নিয়ে কথা হবে নাও বা কেন? সে সিনেমা নিয়ে মুগ্ধতা মাত্র এক দশকেই কমবেও বা কেন? সে সিনেমা 'কাল্ট ক্লাসিক' এর মর্যাদা পাবে নাও বা কেন?