এই বিজ্ঞাপনে যেভাবে দেখানো হয়েছে- মেয়ের প্রথম 'নারী' হওয়ার সূচনালগ্নে কেক, বেলুন, ফুলের উৎসব, পরিবারের সবাই মিলে উৎসাহ দেয়া, সেটা হয়তো আমাদের সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে বাস্তব জীবনে বাস্তবায়িত হওয়া খুব দূরের কল্পনা। কিন্তু, যেটা হতে পারে, এবং যেটা হওয়া উচিত, সেটি হচ্ছে- ঋতুস্রাব নিয়ে একজন মেয়ের নিঃসঙ্কোচে কথা বলার স্বাধীনতা...
নেপাল ও ভারতের তৃণমূল অঞ্চলের মেয়েরা একটা ঘরের সাথে খুব পরিচিত। ঘরটির নাম- চৌপদী ঘর। মাসের নির্দিষ্ট একটা সময়ে যখন মেয়েদের ঋতুস্রাব হয়, তখন মূল ঘর থেকে খানিকটা দূরে এই চৌপদী ঘরে রাখা হয় তাদের। যে কয়দিন ঋতুস্রাব থাকে, সে কয়দিনের জন্যেই তাদের স্থায়ী আবাস হয় এটি৷ অনেক পরিবার আলাদাভাবে 'চৌপদী ঘর' না তৈরী করতে পারলে নিজেদের 'গোয়ালঘর' কিংবা এরকম কোনো অস্বাস্থ্যকর স্থানে আটকে রাখে মেয়েদের৷ এসব মানুষজনের ধারণা, ঋতুস্রাবের সময়ে একটি মেয়ে অশুচি হয়ে যায়। সে যা স্পর্শ করে, অপবিত্র হয়ে ওঠে সেটিও। তাকে তাই পরিবারের সাথে রাখার প্রশ্নই ওঠেনা। সুতরাং, গন্তব্য- চৌপদী ঘর।
গা শিউরে ওঠার মতই এক প্রথা। আরো ভয়ংকর বিষয়, ঋতুস্রাবের এই সময়টাতে এই মেয়েদের স্যানিটারি প্যাড দেয়া দূরের কথা, পরিষ্কার কাপড়ও দেয়া হয় না। গাছের পাতা, ছালবাকল, নোংরা কাপড় দিয়েই অনেকে এই সময়ে ঋতুস্রাবের দিনগুলো পার করেন। এবং শরীরের খুবই সংবেদনশীল স্থানে এসব ব্যবহার করার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া যেরকম মারাত্মক হওয়ার কথা, দিনশেষে সেরকমটাই হয়। গুগলে একটু ঘাঁটাঘাঁটি করলেই জানা যাবে, ঋতুস্রাবের দিনগুলোতে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকা ও অপরিষ্কার দ্রব্য ব্যবহারের ফলে ফি বছর কত মেয়ে অকালমৃত্যুর ঝুঁকিতে পড়ছে। এবং সংখ্যাটা এতটাই মারাত্মক, দেখলে চমকে উঠবেন যে কেউই।
'চৌপদী ঘর' যদিও নেপাল ও ভারতের কনসেপ্ট, কিন্তু 'পিরিয়ড' কে ট্যাবু হিসেবে কল্পনা করার সমস্যা মোটামুটিভাবে বৈশ্বিকই। আফ্রিকা বলি, ইন্দোনেশিয়া কিংবা মায়ানমার... গড়পড়তা পরিবারগুলোতে 'পিরিয়ড' নিয়ে কথা বলা এখনও রীতিমতো অপরাধ। এতদূর না যাই, বাংলাদেশের কথাই চিন্তা করি না কেন, পিরিয়ড হলে একটা মেয়েকে যে পরিমাণ লুকোছাপা করে সে তথ্য পরিবারের সদস্যদের জানাতে হয়, দোকান থেকে এক প্যাকেট 'স্যানিট্যারি প্যাড' কিনে নিয়ে আসার জন্যে যত রকমের সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়, তা নিয়ে লিখতে বসলে 'শিবের গীত' হয়ে যাবে। সে প্রসঙ্গে তাই ইস্তফা দিচ্ছি।
তবে আশার ব্যাপার এটাই, ইদানীং এই বিষয়টা নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হচ্ছে। কথাবার্তা হচ্ছে। নির্মাণ হচ্ছে। যার ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি মাহাথির স্পন্দনের একটা নির্মাণ দেখলাম। যেখানে মেয়ের 'প্রথম পিরিয়ড' উপলক্ষ্যে ঘরে রীতিমতো উৎসবের আবহ তৈরী হয়েছে। যে বয়সে একটি মেয়ে শরীরের জটিলতায় সবচেয়ে নাজুক ও ভঙ্গুর অবস্থায় থাকে, সে বয়সে পরিবারই যদি সবচেয়ে বড় সমর্থন দেয়, এরচেয়ে দারুণ আর কিছু হতে পারে না। যদিও বাস্তবের অভিজ্ঞতা কিংবা আলোচনা সাপেক্ষে, এই বিজ্ঞাপন রূপকথাই মনে হবে হয়তো,তবুও, অন্ততপক্ষে বিজ্ঞাপনে এরকম কিছু যে এসেছে, সেটা দেখাও স্বস্তির।
'জয়া স্যানিটারি ন্যাপকিন' এর জন্যে বানানো এ বিজ্ঞাপনে যেরকম করে দেখানো হয়েছে- মেয়ের প্রথম 'নারী' হওয়ার সূচনালগ্নে কেক, বেলুন, ফুলের উৎসব, পরিবারের সবাই মিলে উৎসাহ দেয়া, সেটা হয়তো বাস্তব জীবনে বাস্তবায়িত হওয়া খুব দূরের কল্পনা। কিন্তু, যেটা হতে পারে, এবং যেটা হওয়া উচিত, সেটি হচ্ছে- ঋতুস্রাব নিয়ে একজন মেয়ের নিঃসঙ্কোচে কথা বলার স্বাধীনতা। 'পিরিয়ড' এর মত স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া নিয়ে 'অন্যায় ট্যাবু' বন্ধ হওয়া। একজন মেয়ে 'মা' হওয়ার পথে যাত্রা শুরু করেছেন যে যাত্রাপথে, সে যাত্রাপথে প্রতিবন্ধকতা নিকেশ হওয়া। আশা করি, মাহাথির স্পন্দন যেভাবে স্পর্শকাতর এ বিষয় নিয়ে স্পষ্টভাবে কাজ করেছেন, বাকিরাও ঠিক এভাবেই সরব হবেন। এবং হয়তো এভাবেই একসময়ে নির্মূল হবে অপ-সংস্কৃতির দুরাচার। সেটুকুই প্রত্যাশা।