'জন গণ মন' এর যে গল্প, এ গল্প তো আমাদেরও। গোটা উপমহাদেশেরও। অথচ, গল্পটা শুধু ওরাই বলছে। আমরা পারছিনা। কেন পারছিনা? সে কি প্রশাসকের দাপটে? নাকি, নিজেদের সৎসাহসের ভয়ে? নাকি, মেরুদণ্ডের অভাবে?

জর্জ অরওয়েলের ডিস্টোপিয়ান সোশ্যাল সায়েন্স ফিকশন '১৯৮৪' এ প্রথমবার পড়েছিলাম অমর সেই লাইন- 

Big Brother is watching you. 

এই এক লাইনের বরাতেই অরওয়েল যেভাবে শাসকদের 'সর্বময় নজরদারি'কে কটাক্ষ করেছিলেন, তা ছিলো চূড়ান্ত বিস্ময়কর। পাশাপাশি, গোটা উপন্যাসই নানা দুর্দান্ত মেটাফোরে, নানা থট প্রভোকিং সিনারিওতে প্রশাসকের নাভিশ্বাস ওঠানো নগ্ন খবরদারিকে যেভাবে মুহুর্মুহু জ্যান্ত করছিলো, চক্ষু চড়কগাছ হবার জোগাড় হয়েছিলো সেখানেও। এ বই  পাশাপাশি যেভাবে বোঝাচ্ছিলো, শাসকের শ্বদন্ত আচমকাই চেপে বসতে পারে শোষিতের গলায়,  আচমকাই নৃশংস হতে পারে তাদের মাত্রাহীন লোভ, তা অবাক করছিলো। বইটা যতই পড়ছিলাম, ভয়াবহ বর্ণনায় চুপসে যাচ্ছিলাম। ডিস্টোপিয়ান ওয়ার্ল্ড নিয়ে বই কম পড়িনি। কিন্তু, তা সত্বেও, প্রথম বয়সের উপন্যাস হিসেবে '১৯৮৪' বরাবরই হয়ে থেকেছে আলাদাভাবে প্রিয়। স্বকীয়। 

যদিও আজকে '১৯৮৪' নিয়ে কথা বলবোনা, কিন্তু তবুও এই বইয়ের প্রসঙ্গ দিয়ে শুরু করার কারণ, সম্প্রতি এমন এক সিনেমা দেখলাম, যে সিনেমা দেখে সবার আগে মনে পড়লো এই বইয়ের কথাই৷ সময় যত গড়াচ্ছে, অরওয়েলের 'বিগ ব্রাদার' যে ঠিক ততটাই জেঁকে বসেছে সবখানে, তা তো সবার জানা৷ আইন, সেন্সরশিপ, দমন-পীড়নের বদান্যতায় লেখক, পরিচালক কিংবা সাধারণ মানুষকে 'স্পিকটি নট' করে দেয়া হচ্ছে প্রতিদিনই। ফলশ্রুতিতে, আজকালের গল্প কিংবা সিনেমা হয়ে পড়েছে নির্জীব-নিরস্ত্র-অসহায়। জলবৎ তরলং। ফুলপাখি-লতাপাতা৷ কিংবা, থোড়বড়িখাড়া খাড়াবড়িথোড়। 

পুরো উপমহাদেশেই একই আখ্যান। তবু, এখানেও আছে ব্যতিক্রম। যে ব্যতিক্রমের নাম কেরালা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি৷ এখানের নির্মাতারা যে প্রচণ্ড সাহসী, তা সবাই জানেন। পাশাপাশি, এখানের  সুপারস্টাররাও যে প্রচণ্ডভাবে রাজনীতি-সচেতন, সেও বলাই বাহুল্য। শাসকের চোখ-রাঙ্গানিকে তারা যে খুব একটা পাত্তাও দেন না, সেটারই ফলশ্রুতিতে তাই দেখতে পাই সাহসী 'জন গণ মন' সিনেমাকে। এ সিনেমায় এমনভাবেই আসে রাজনীতির নানা ক্লেদ, এমনভাবেই রাখঢাক না করে নির্মাতা প্রশ্নবিদ্ধ করেন আমাদের জাজমেন্টাল মেন্টালিটিকে... হলফ করে বলতে পারি, এরকম বিতর্কিত ও বিস্ফোরক বিষয় নিয়ে ডিল করতে গেলে অন্য ইন্ডাস্ট্রির পরিচালকেরা অবধারিতভাবেই ভাবতেন কয়েকবার। হয়তো হতেন ইতস্ততও। মূলত, সেখানেই হয় তফাত। 

সিনেমা শুরু হয় মহাত্মা গান্ধীর সেই বিখ্যাত উক্তি-

In matters of conscience, the law of the majority has no place.

লাইন দিয়ে৷ যে লাইন মূলত পুরো সিনেমার সারাংশকেই একবাক্যে নিয়ে আসে সামনে। পাশাপাশি, আশেপাশের কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল, তা যে বরাবর জনস্রোতই নির্ধারণ করবে, এটারও যে কোনো ভিত্তি নেই, এই ন্যারেটিভকেও  চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় গান্ধীজির এ বয়ান। গল্প এগোয়। জানা যায়, বেশ নামী এক প্রতিষ্ঠানের এক নারী শিক্ষককে ধর্ষণ করে মেরে, তার লাশ পুড়িয়ে দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। বলাই বাহুল্য, চাঞ্চল্যকর এই ঘটনার প্রতিবাদে সেই শিক্ষকের ছাত্র-ছাত্রীরা বিক্ষোভে একাট্টা হয়। শাসকদল আবার শিক্ষার্থীদের নিরস্ত্র করতে লেলিয়ে দেয় পোষা পুলিশবাহিনীকে। পুলিশ আর সরকার-দলের পান্ডাদের বেধড়ক মার খেয়ে অনেক ছেলেমেয়েই হয় শয্যাশায়ী। তাদের স্থান হয় হাসপাতালে। 

ঠিক এখান থেকেই গল্পে আসে মোচড়। দেখি এক পুলিশ অফিসারকে, যিনি বাকিদের মত চাটুকার না। তিনি দায়িত্ববান। ন্যায়পরায়ণ। যিনি স্রোতের বিপরীতে গিয়ে এই অসহায় শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ান। প্রয়াত নারী শিক্ষকের খুনীদের খুঁজে বের করেন। এরপর যখন জানতে পারেন, আইনিপথে এই অপরাধীদের শাস্তি দেয়া তার পক্ষে সম্ভব না, তখন এনকাউন্টারে অপরাধীদের মেরে ফেলেন। এবং, সিনেমার এ পর্যায়ে এসে সবাই বেশ খুশিও হয়। কারণ, সবারই জানা, আইনের প্রক্রিয়া দীর্ঘ। এবং এ প্রক্রিয়ার শেষে দুষ্কৃতিকারীরা যে শাস্তি পাবেই, তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। সুতরাং, যদি কোনো সৎ পুলিশ অফিসার এই অপরাধীদের নিকেশ করার ভার তার নিজের হাতেই তুলে নেন, তাতে সাধারণ দর্শক অখুশি হবেনও বা কেন? বলাই বাহুল্য, সিনেমাহলে হাততালির হুল্লোড় ওঠে। হয়তো ওঠে তৃপ্তির ঢেঁকুরও!

সিনেমার তখন মাত্র ঘন্টাখানেক পেরিয়েছে। এদিকে সিনেমার প্রোটাগনিস্ট পৃথ্বীরাজ তখনো আসেননি স্ক্রিনে। খানিকটা বিস্মিত হতে হয়। হবারই কথা। গল্প তো বলা শেষ৷ আর কি হবে? আর কি বাকি আছে? প্রশ্ন ক্রমশ দানা বাঁধে। দর্শকও হতে থাকে কিংকর্তব্যবিমুঢ়। এবং, এরকমই এক হতবিহ্বল মুহুর্তে ক্রাচে ভর দিয়ে আবির্ভূত হন কাঁচা-পাকা চুলের এক আইনজীবী। যিনি দৃশ্যপটে আসেন। এবং, এসেই বোমা ফাটান। জানান- 

যে নারী শিক্ষককে নিয়ে এতকিছু, সে শিক্ষককে খুন করার আগে ধর্ষণ করাই হয়নি! 

চমকে যাওয়ার উপক্রম হয়। গল্পে আস্তে আস্তে উঠে আসে রাজনীতির সাত-সতেরো, সুলুকসন্ধান। মাথাচাড়া দেয় মিডিয়া ট্রায়ালের ভয়ঙ্কর সর্বগ্রাসী অবয়বও। যদিও গল্প ততক্ষণে ফসকে গিয়েছে, দর্শকের হাত থেকে চলে গিয়েছে বহুদূর। সেই দূরত্বে গিয়েই গল্প তখন ভয়ঙ্কর সব টার্ণ নিচ্ছে। কে যে পক্ষের, আর কে যে বিপক্ষের, ঘোঁট পাকিয়ে যাচ্ছে। পাল্টে যাচ্ছে দর্শকের পালস, পালটে যাচ্ছে জঁরাও। সোশ্যাল থ্রিলার, পলিটিক্যাল মিস্ট্রি কিংবা রিভেঞ্জ স্টোরি.... সর্পিল সব বাকে তখন ঘুরছে 'জন গণ মন।' 

এই সিনেমার সবচেয়ে বড় গুণ, পুরো সিনেমার প্রতিটি দৃশ্যই যেন ঠাণ্ডা মাথায় সাজানো দাবার ঘুঁটি। প্রতিটি এলিমেন্টস এমনভাবে  সহাবস্থানে রয়েছে, এমন মাপা ক্যালকুলেশনে দর্শকের পারসেপশন নিয়ে খেলেছেন নির্মাতা, অবিশ্বাস্য। প্রথম থেকেই যেমন শুরু হয়েছে দর্শককে নিয়ে ছেলেখেলা। আন্দোলনের মাঝখানে সেই নীতিবান পুলিশ অফিসারের আসা এবং আইন হাতে তুলে নেয়া, সেখানে আমাদের সমর্থন ও আমাদের মোর‍্যাল স্ট্যান্ডকে প্রশ্নবিদ্ধ করা থেকেই শুরু হয়েছে সিনেমার চমক। পরবর্তীতে, সিনেমার জঁরা যখন 'থ্রিলার' থেকে শিফট করে 'কোর্টরুম ড্রামা'য় চলে যাচ্ছে, তখন আবার আগের ঘটা প্রতিটি পয়েন্ট ধরে ধরে 'উকিল'রূপী পৃথ্বীরাজ যেভাবে আমাদের 'বায়াসনেস'কে একহাত নিচ্ছেন, তখন আমরাই হয়ে পড়েছি কোণঠাসা। এবং, ঠিক এভাবেই, এ সিনেমা কেন যেন কুশীলবদের পরিণতি না দেখিয়ে ক্ষণেক্ষণে অস্বস্তিতে ফেলতে চাইছে আমাদেরই। ক্রমশ। বারবার। 

পৃথ্বীরাজ সিনেমা মানেই এখন দুর্দান্ত সব চমক

সিনেমার শুরুর দিকে এমন একটা দৃশ্য আছে, যেখানে কোনো এক ক্লাসরুমে শিক্ষক এসে বলছেন-

তোমাদের আমি পলিটিক্যাল সায়েন্সের থিয়োরি শিখিয়েছি৷ এবার শেখাবো পলিটিক্যাল সায়েন্সের প্রাকটিকাল। বাইরে একটা প্রোটেস্ট হচ্ছে। যাও, সেখানে গিয়ে দাঁড়াও সবাই। প্রতিবাদ করো। বেঞ্চ থেকে ওঠো। ক্লাস থেকে বেরোও।

এই যে ক্লাসরুমের শিক্ষক, সে শিক্ষকের চরিত্রে ক্যামিও পারফরম্যান্স দিয়েছিলেন 'জন গণ মন'র পরিচালক ডিজো জোশে অ্যান্টনি স্বয়ং। এবং, এই এক দৃশ্যকে চাইলে মেটাফোরিক্যালি ইন্টারপ্রেট করে বলাও যায়-  নেক্সট লেভেল পলিটিক্যাল প্যারাডক্স নিয়ে তিনি যে খেলবেন, সেটার হিন্ট তিনি দিয়ে রেখেছিলেন সিনেমার এই অংশেই। এবং, সেটা তিনি খেলেছেনও। এবং এই খেলায় তাকে যোগ্য সমর্থন দিয়েছে স্ক্রিপ্ট রাইটার শরিশ মোহাম্মদও। শরিশ মোহাম্মদ নিজেও একটা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক। শিক্ষকতার পাশাপাশি মাঝেসাঝে লেখেন সিনেমার স্ক্রিপ্ট। গল্প। সেই শরিশই যখন অ্যান্টনির সাথে জোট পাকালেন, দুইজনে মিলেমিশে অদ্ভুত এক মেটাফোরিক্যাল অ্যাটমোস্ফিয়ার সাজালেন, সেখানে শেষতক বাদ রইলোনা কোনোকিছুই। সোশ্যাল লাইফের নানা প্যারাডক্সকে একের পর এক আনা হলো গল্পে। মিশিয়ে দেয়া হলো সিনেমার সাথে। দক্ষ হাতে। প্রখর মুন্সিয়ানায়। 

পৃথ্বীরাজ আর সুরাজের একত্রে সম্ভবত দ্বিতীয় সিনেমা এটা৷ এদের প্রথম ডুয়েট সিনেমা 'ড্রাইভিং লাইসেন্স' দেখেছিলাম লকডাউনে। দুইজনের ডুয়ো বেশ মুগ্ধ করেছিলো তখন । এই সিনেমায় যদিও তাদের মুখোমুখি ডুয়েল হলো কম, তবুও সিনেমার প্রথমাংশে সুরাজ আর শেষাংশে পৃথ্বীরাজ যেভাবে টানলেন সিনেমাকে, মুগ্ধ হলাম। হতে বাধ্য হলাম। মালায়ালাম ইন্ডাস্ট্রি গল্প বলতে জানে। কিন্তু সে গল্প এভাবে মুখোমুখি করবে নগ্ন বাস্তবের, কুশীলবেরা এভাবে দেবে 'মোর দ্যান রিয়েল' পারফরম্যান্স, এটা কি ভেবেছিলাম? বোধহয় না। 

পৃথ্বীরাজ-সুরাজের ডুয়ো মুগ্ধ করেছে

'জন গণ মন'র সিক্যুয়েল আসবে। সেভাবেই শেষটা টানা হয়েছে। সিক্যুয়েলের টুকরোটাকরা কিছু দৃশ্য এনে পরবর্তী পর্বের জন্যে আগ্রহটাও ঠিকঠাক জমিয়ে রাখা হয়েছে। এই সিনেমাকে আটকানোর জন্যে নানা রকম চালও চালা হয়েছে। ট্রেলার মুক্তির পরে কন্ট্রোভার্সি ছড়ানো হয়েছে। অক্ষয় কুমারের ম্যাগনাম ওপাস 'সম্রাট পৃথ্বীরাজ'কে 'ট্যাক্স ফ্রি' ঘোষণা করে হিন্দি বেল্টে 'জন গণ মন' এর সাকসেসকে আটকানোর চেষ্টাও হয়েছে। কিন্তু, এসব সত্বেও সিনেমাটিকে থামানো যায়নি। মানুষ এখন যে থমথমে সময় পার করছে, সে সময়ের প্রতিনিধি হয়ে আসা এরকম এক সাহসী নির্মাণকে তারা লুফে নিয়েছে পুরোপুরিই। কোনো এক নির্মাণ গুণগত যোগ্যতায় উতরে গেলে, তাকে যে থামানো যায়ওনা, 'জন গণ মন' হাড়েহাড়ে বুঝিয়েছে সেটিও। 

এবং, এরকম এক পর্যায়ে এসেই আক্ষেপ হয়েছে, এরকম সিনেমা বানানোর গাটস, এরকম সত্যকথা বলার সাহস, এরকম সাহসী সেন্সর বোর্ড, এরকম সাহসী নির্মাতা-পরিচালক আমাদের দেশে কবে দেখবো? 'জন গণ মন' এর যে গল্প, এ গল্প তো আমাদেরও। গোটা উপমহাদেশেরও। অথচ, গল্পটা শুধু ওরাই বলছে। আমরা পারছিনা। কেন পারছিনা? সে কি প্রশাসকের দাপটে? নাকি, নিজেদের সৎসাহসের ভয়ে? নাকি, মেরুদণ্ডের অভাবে? প্রশ্ন থাকে। থেকেই যায়। 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা