কিছু অভিনেতা আছে, যাদের অভিনয় দেখলে মনে হয় না, এরা অভিনয় করছেন। এরা অনেকটা যেন তরল পদার্থও। যখন যে অভিনয়ের খোলসে ঢোকানো হবে, সে খোলসেই ঠিক এঁটে যাবেন তারা। বাংলাদেশে এরকম অভিনেতার সংখ্যা খুব বেশি, এমনটা মোটেও বলা যাবে না। তবে বিরল এ অভিনেতাদের তালিকায় ইন্তেখাব দিনারও যে একজন, তা অবশ্যই বলা যায়...

ওটিটির সাম্প্রতিক এই আগ্রাসন অনেক নতুন কুশীলবকে যেমন পাদপ্রদীপের আলো দিয়েছে, তেমনি হারিয়ে যাওয়া অনেক অভিনেতাকেও মূলস্রোতে এনেছে। অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোর সুবাদে গল্প-নির্ভর নির্মাণের সংখ্যা বেড়েছে, জাত-কুশীলবদের আনাগোনাও বেড়েছে। আমরা দেখেছি, স্ক্যাম-১৯৯২ এর সুবাদে প্রতীক গান্ধীর মত দুর্দান্ত অভিনেতা জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। 'পাতাল লোক' এর সুবাদে জয়দীপ আহলাওয়াতও পেয়েছেন পরিচিতি। যদি দেশের দিকে তাকাই- শ্যামল মাওলা, মনোজ প্রামাণিক, মোস্তফা মন্ওয়ার, খায়রুল বাসারের মতন উদীয়মান অভিনেতারা ওটিটির সুবাদেই বিস্তর আলোচিত হয়েছেন। আবার পরিচিতদের মধ্যে আলাদাভাবে স্ট্রিমিং সাইট কাঁপিয়েছেন চঞ্চল চৌধুরী এবং মোশাররফ করিম। তবে এতসব কুশীলবের ভীড়ে একজন অভিনেতা আছেন, যিনি মাঝের একসময়ে হারিয়েই গিয়েছিলেন পুরোপুরি। এই ওটিটিই তাকে ফিরিয়েছে, এবং ফিরে আসার সে আখ্যান এতটাই দুর্দান্ত, যেন ফিনিক্স পাখির মতই ছাইভস্ম থেকেই জেগে উঠেছেন তিনি! সেই অভিনেতার নাম ইন্তেখাব দিনার৷ 

দিনার বহু আগে থেকেই থিয়েটারের নিয়মিত শিল্পী। নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের অধীনে অনেক মঞ্চনাটকও করেছেন। একসময়ে টিভিতেও তাকে প্রচুর নাটকে দেখেছি। দেখেছি বেশকিছু সিনেমাতেও। বরাবরই সাবলীল অভিনয় করা এ অভিনেতা আচকমকাই অভিনয়ের মাঝপথে হুট করে উধাও হয়ে গেলেন। মাঝের একটা বড় সময়জুড়ে তাকে নাটক কিংবা সিনেমা... কোনো মাধ্যমেই পাইনি। সেই তিনিই ক'দিন আগে ফিরলেন। এবং প্রত্যাবর্তনটা এতটাই দোর্দণ্ডপ্রতাপময় হলো, মুগ্ধ হয়ে গেলাম। 

চরকি'র 'ঊনলৌকিক' অ্যান্থোলজি সিরিজ নিয়ে শুধু বাংলাদেশে না, ভারতেও বিস্তর কথাবার্তা হয়েছে।  শিবব্রত বর্মণের গল্পে ভর করে রবিউল আলম রবির নির্মাণগুলোও হয়েছিলো বেশ অনবদ্য। এই তুমুল জনপ্রিয় সিরিজের একেবারে শেষ পর্বে এলেন ইন্তেখাব দিনার। 'দ্বিখণ্ডিত' গল্পের মোস্তাক আহমেদ তিনি। তথ্য মন্ত্রণালয়ের কেরানি। তিনি এসেছেন পুলিশ স্টেশনে। পুলিশকে শোনাচ্ছেন অদ্ভুত কিছু গল্প। ক্যামেরা নট-নড়নচড়ন হয়ে তার মুখের ওপর স্থির। চব্বিশ মিনিটের গল্পে বিশ-একুশ মিনিট ধরে তিনিই ছিলেন স্ক্রিনে! বিশেষ এই নাটকের জন্যে আঠারো পৃষ্ঠার এক বিশাল স্ক্রিপ্ট দেওয়া হয়েছিলো ইন্তেখাব দিনারকে। এবং শুরু থেকে শেষতক আগ্রহ ধরে রেখে যেভাবে  পুরো 'দ্বিখণ্ডিত'কে একাই টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি, ক্ষণেক্ষণে  মনে করাচ্ছিলেন সেই পুরোনো বাক্যটিই-

ক্লাস ইজ পার্মানেন্ট!  

ঊনলৌকিক দিয়েই হয়েছে তার প্রত্যাবর্তন!  

এরপর দিনারকে দেখেছি চরকিরই আরেক ওয়েব ফিল্ম 'খাঁচার ভেতর অচিন পাখি'তে৷ এ নির্মাণের প্রোটাগনিস্ট তিনি না। সেরকমভাবে অ্যান্টাগনিস্টও না। অল্প সময়েরই এক চরিত্র। কিন্তু সেখানেও যে অভিনয় তিনি করলেন, প্রোটাগনিস্ট ফজলুর রহমান বাবুকেও যেন ছাড়িয়ে গেলেন কিছু ক্ষেত্রে। ডাবল শেডের ক্যারেক্টার, মন্ত্রীর চাটুকার পিএস থেকে প্রভাবশালী নেতা...এই দুই ক্যারেক্টারের ডাইমেনশন বুঝে যেভাবে ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রে তিনি পাল্টালেন চেহারা ও অভিনয়ের ভাষা, আরেক দফা মুগ্ধ হলাম। 

'খাঁচার ভেতর অচিন পাখি'তেও ছিলেন তুখোড়! 

সম্ভবত, এ বছরের মত দিনারের শেষ অভিনয় দেখলাম, চরকি'র অ্যান্থোলজি সিরিজ 'জাগো বাহে'তে। 'লাইটস, ক্যামেরা, অবজেকশন' এ দুর্দান্ত এক অ্যান্টাগনিস্ট হয়েই এলেন তিনি। পরনে সামরিক উর্দি, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, কপালে ভ্রুকুটি... পর্দায় ক্ষণেক্ষণেই উত্তাপ ছড়ানোর যে দায়িত্ব তিনি পেয়েছিলেন, তার একবিন্দু বিচ্যুতি হলোনা কোথাও! উদীয়মান অভিনেতা মোস্তফা মন্ওয়ারের সাথে মুখোমুখি 'ওয়ান টু ওয়ান' কনভারসেশনও হলো দেখার মতন৷ চিবিয়ে চিবিয়ে উত্তপ্ত বাক্যবাণে আবারও ইন্তেখাব দিনার বোঝালেন, কেন তিনি এত প্রাসঙ্গিক।

'লাইটস, ক্যামেরা, অবজেকশন...'এও বজায় রইলো মুগ্ধতা! 

কিছু অভিনেতা আছে, যাদের অভিনয় দেখলে মনে হয় না, এরা অভিনয় করছেন। এরা অনেকটা তরল পদার্থের মতন। যখন যে অভিনয়ের খোলসে ঢোকানো হবে, সে খোলসেই ঠিক এঁটে যাবেন তারা। বাংলাদেশে এরকম অভিনেতার সংখ্যা খুব বেশি, এমনটা মোটেও বলা যাবে না। তবে বিরল এ অভিনেতাদের তালিকায় ইন্তেখাব দিনারও যে একজন, তা অবশ্যই বলা যায়। আশা করবো, গুণী এ অভিনেতা এখন থেকে নিয়মিত নানা নির্মাণের সাথে যুক্ত হবেন। ওটিটির কল্যানে সাংস্কৃতিক যে এক পালাবদল ঘটেছে, প্রত্যাশা থাকবে, এ পালাবদলে তিনিও হয়ে থাকবেন একজন নিয়মিত কর্মী। তাতে আখেরে কল্যান হবে নির্মাণেরই। গুণী এ অভিনেতার জন্যে শুভকামনা।  


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা