বলিউডি সিনেমার দুর্দান্ত সব নারী চরিত্রেরা!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
বলিউডি সিনেমাগুলোতে নারী চরিত্রগুলোর ভূমিকা আসলে কতটুকু? আমরা যেসব হিন্দি সিনেমা নিয়মিত দেখি, সেসব সিনেমায় স্বল্প ক্রিয়া, অল্প পোশাক এবং সংক্ষিপ্ত উপস্থিতির বাইরে নারী চরিত্রগুলোকে পাণ্ডুলিপিতে সম্মানজনক অবস্থানে রাখার কথা ভেবেছেন কয়জন চিত্রনাট্যকার? উত্তর জানা আছে কারো?
বলিউডের হিন্দি সিনেমাগুলোতে নারী চরিত্রগুলোর ভূমিকা আসলে কতটুকু? আমরা যেসব হিন্দি সিনেমা নিয়মিত দেখি, সেসব সিনেমায় স্বল্প ক্রিয়া, অল্প পোশাক এবং সংক্ষিপ্ত উপস্থিতির বাইরে ভেবে নারী চরিত্রগুলোকে পাণ্ডুলিপিতে সম্মানজনক অবস্থানে রেখেছেন কয়জন স্ক্রিপ্ট রাইটার? এসব প্রশ্ন আপাতদৃষ্টে নিরীহ মনে হলেও, এর ঠিকঠাক উত্তর দিতে গেলে, সমাজ-সংস্কার-ধর্ম অনেককিছুতেই টান লেগে যেতে পারে। প্যান্ডোরার বাক্স খুলে সব ভজঘট পাকারও উপক্রম হতে পারে।
তাই সেসব দিকে আলোকপাত না করা যাক বরং। আপাতত এটুকুই জেনে নেওয়া যাক- উপমহাদেশের সিনেমাগুলোতে 'নারী চরিত্র' অনেকটা কাঁচামরিচের মতন। গরম ভাত, তরকারির সাথে কাঁচামরিচ থাকলে খারাপ লাগে না। তবে যদি না থাকে, তাহলেও খুব একটা ক্ষতিবৃদ্ধি হয় না। বলিউডের মেইনস্ট্রিম সিনেমার নায়িকাদের বেলায় বিষয়টা অনেকটা এরকমই।
তবে এসবের বাইরেও কথা থেকেই যায়। সময়ের ফেরে এই হিন্দি সিনেমার ইন্ডাস্ট্রিতেও এমন কিছু নারী চরিত্র এসেছে, যারা অর্থোডক্স 'সিনেমায় এদের কোনো ভূমিকা নেই' ন্যারেটিভকে ধূলিসাৎ করেছে। মাঝেমধ্যে তাদের প্রভাব এতটাই বিস্তর, পুরুষ চরিত্রগুলো স্রেফ ম্লান হয়েছে তাদের উপস্থিতির সামনে। সেরকমই কিছু তুখোড় নারী চরিত্র নিয়ে আজকের কথাবার্তা।
১. শশী গোদবলে (ইংলিশ ভিংলিশ)
পরিচালক গৌরি শিন্দ তাঁর অভিষেক সিনেমা 'ইংলিশ ভিংলিশ' এ যেভাবে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের জটিলতাকে তুলে এনেছেন 'শশী গোদবলে' নামক চরিত্রটির মধ্য দিয়ে, তা এককথায়- দুর্দান্ত। এই চরিত্রটির মধ্যে আটপৌরে অথচ অনমনীয় ভাব এতটাই প্রবলভাবে উপস্থিত, গড়পড়তা অনেক নারীই 'শশী গোদবলে'র সাথে নিজেদের সম্পর্ক খুঁজে পেয়েছেন। পরিবারের কাছে একটু সম্মানজনক ব্যবহার পাবার জন্যে এক মধ্যবয়স্ক নারীর যে অদম্য প্রচেষ্টা বা এই প্রচেষ্টা-পথের সহযাত্রীদের সাথে তার যে মিথস্ক্রিয়া...সব মিলিয়ে হিন্দি সিনেমার ইতিহাসে এই 'শশী গোদবলে' চরিত্রটির প্রভাব সুগভীর।
২. পিকু (পিকু)
সুজিত সরকারের 'পিকু' সিনেমাটির নানা আঙ্গিক নিয়ে অজস্র কথাবার্তা বলা যায়। স্টোরি, ন্যারেশন, ক্যারেক্টার ডেভেলপমেন্ট... সবকিছুই এত প্রাসঙ্গিক ও ব্যালেন্সড, মুগ্ধ হওয়ার মতন। মুগ্ধ হতে হয় সিনেমার নাম ভূমিকায় অভিনয় করা দীপিকা পাড়ুকোনের চরিত্রটিতেও৷ এ সিনেমার স্ক্রিপ্ট রাইটার 'জুহি চতুর্বেদী'র কলমে 'পিকু' চরিত্রটি 'চরিত্র' শব্দে আটকে না থেকে জ্বলজ্যান্ত এক মানুষেই পরিণত হতে দেখি। খিটখিটে বাবা কে নিয়ে বিপত্তি, বাবার 'মেয়ে' না হয়ে 'মা' হয়ে ওঠা, ব্যক্তিগত জীবন এবং পেশাগত জীবনের দোটানা, শক্তপোক্ত চরিত্রের ভেতরেও কোথায় যেন অস্তিত্ব খুঁজে ফেরার আকুতি...সব মিলিয়ে 'পিকু' যেন বর্তমান সময়ের অজস্র নারীরই এক নির্মেদ পোর্ট্রেয়াল।
৩. বিদ্যা বাগচী (কাহানি)
সুজয় ঘোষের 'কাহানি' সিনেমার প্রোটাগনিস্ট 'বিদ্যা বাগচী' চরিত্রটির মধ্যে এত অজস্র লেয়ার, অথচ প্রত্যেক লেয়ার আলাদা আলাদা করে ধরা যাচ্ছে, উপলব্ধি করা যাচ্ছে, এ বিষয়টির অভিনবত্বই বিশেষ এ চরিত্রকে দিয়েছে অমরত্ব। রহস্য, ক্রোধ, ক্ষোভ, আতঙ্ক... 'বিদ্যা বাগচী' চরিত্রটি ব্লটিং পেপার হয়ে এইসব অনুভূতিকে শুষে নিয়ে পর্দায় ছড়িয়ে দেয়ার দায়িত্বও পালন করেছে। বিদ্যা বালান এই বিশেষ চরিত্রে যেভাবে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দৃঢ় এক অবস্থানে থেকে অভিনয় করে গিয়েছেন, তা দুর্দান্ত। 'বিদ্যা বাগচী' চরিত্রের অভিনয়গত সৌকর্য নিয়ে অজস্র কথাবার্তা হয়। সামনেও হয়তো হবে৷ তবে মিথোলজিক্যালি, মেটাফোরিক্যালি এরকম ক্যারেক্টার সামনে আর আসবে কি না, সন্দেহ থেকেই যায়।
৪. দূর্গা দেবী কৌশিক (বাধাই হো)
কিছু সিনেমা এমন হয়, যেখানে দুই একটি চরিত্র থাকে, যারা পর্দায় এলেই হৃদয় জুড়িয়ে দেয়। 'দূর্গা দেবী কৌশিক' এমনই এক চরিত্র। হাস্যরস, বিদ্রুপ ভালোবাসা, মায়া...এই চারটি বিষয়কে একসাথে শিলনোড়ায় বেটে এরপর যেন তৈরী করা হয়েছে চরিত্রটিকে। সিনেমার প্রথমাংশের খানিকটা দেখার পরে আপাতদৃষ্টিতে যখন মনে হচ্ছিলো, এ চরিত্রের কাজ হয়তো শুধুমাত্র 'কমিক রিলিফ' হিসেবে পর্দায় থাকা, সেই চরিত্রটিই পরবর্তী অংশে এমন দুর্দান্তভাবে গল্পের সাথে সংযুক্ত হয়েছেন, অনবদ্য। বিশেষ এই চরিত্রে অভিনয় করা গুণী অভিনেত্রী 'সুরেখা সিক্রি' প্রয়াত হলেন সম্প্রতি। তবে তিনি মারা গেলেও এ চরিত্রের মধ্য দিয়ে তার স্মৃতি আরো বহুদিন দর্শকের কাছে উজ্জ্বল থাকবে বলেই বিশ্বাস।
৫. রানী (কুইন)
'কুইন' সিনেমার 'রানী' চরিত্রটির পরিস্ফুটন এমনই অনবদ্য, ব্যক্তিগতভাবে অনেক নারীই এ চরিত্রের সাথে নিজেদের রিলেট করতে পারেন। 'রানী' চরিত্রের অসহায়ত্ব, পরিবারের দমন-পীড়ন, মানসিক টানাপোড়েন, সবকিছু ছেড়েছুড়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে পড়া...এ সবকিছুর সাথেই অনেক নারীরই আত্মিক সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যাবে। কঙ্গনা রানাউত অভিনীত বিশেষ এ চরিত্রটিতে সারল্য এবং আশ্রয়হীনতার মিশেল এতটাই অনবদ্য, মনে হবে 'রানী' চরিত্রটি আসলেই বাস্তব কাউকে ভেবে লেখা। এখানেই এ চরিত্রের সার্থকতা।
৬. সাফিনা (গালি বয়)
'সাফিনা'কে বলা যেতে পারে 'কবির সিং' চরিত্রটির মেয়ে ভার্সন। গড়পড়তা, সাধারণ, লজ্জাবতী লতা নয় এ চরিত্র। হুটহাট রেগে যায় সে। নিজের প্রেমিকের জন্যে অন্য মেয়ের সাথে মারামারিতেও পিছপা হয় না। বুনোফুলের মতন আলাদা থেকে সে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নিজের মতন সংগ্রাম করে যায়। এবং সিনেমার কোনো অংশে গিয়েই এই চরিত্রটির কাজকর্ম আরোপিত মনে হয় না৷ বরং এই বৈপরীত্য দেখে মন ভালো হয়ে যায়৷ 'সাফিয়া' চরিত্র ঠিক এভাবেই আলাদা এক সত্ত্বা হিসেবে দাঁড়িয়ে যায় 'গালি বয়' সিনেমাতে।
৭. নীরু (রেইনকোট)
ঋতুপর্ণ ঘোষের 'রেইনকোট' সিনেমা যতবার দেখেছি, এক গুচ্ছ অনুভূতি গলার কাছে দলা পাকিয়ে উঠে এসেছে, নিরন্তর ঘুরপাক খেয়েছে। মান্নু এবং নীরুর গল্পে হয়তো নতুনত্ব কিছুই ছিলো না। সেট, কস্টিউম বা সিনেম্যাটোগ্রাফীতেও হয়তো চমক ছিলো না। কিন্তু এমনসব অপ্রত্যাশিত মোচড় ছিলো অভিনয়ে, চমকাতে বাধ্য হয়েছি। আলাদা করে নজর কেড়েছে 'নীরু' চরিত্র। অন্তরে অতৃপ্তি রেখে প্রিয় মানুষের সাথে এমন অভিনয়, মাপা হাসি, চাপা বিস্ময় এবং কপট অভিমান...কোথাও গিয়ে মনে হয়েছে, এই 'নীরু' যেন আমাদের আশেপাশেরই কেউ, যে হাসিমুখের মুখোশ পরে বিষাদ আড়াল করে ঘুরপাক খাচ্ছে এই জটিল জনঅরণ্যে!
৮. কাইরা (ডিয়ার জিন্দেগি)
আমরা আমাদের শারীরিক সুস্থতা নিয়ে যতটা সচেতন বা আগ্রহী, কেন যেন মানসিক সুস্থতা নিয়ে ততটা না। পা ভাঙ্গলে পা জোড়া লাগানোর ব্যবস্থা আছে, কিন্তু মনোজগতের ভারসাম্য টলে গেলে, সেখানে নেই কোনো শুশ্রূষা। 'ডিয়ার জিন্দেগি'র কাইরা আমাদের ঠিক এ বিষয়টিতেই সচেতন করে। 'কাইরা' অতীতের নানা ট্রমা থেকে বাঁচতে চায়, সে মনোরোগের চিকিৎসা নেয়াও শুরু করে। আস্তে আস্তে আরোগ্যের পথে আসা শুরু হয় তার। নির্মাণ হিসেবে 'ডিয়ার জিন্দেগি' সিনেমার একগাদা ত্রুটি আছে, তবুও এসবের মধ্যেও 'কাইরা' চরিত্রটি যেন পুরোপুরি বৈপরীত্য! মনে রাখার মত এক চরিত্র!
৯. অমৃতা (থাপ্পড়)
সাম্প্রতিক সময়ে সম্ভবত সবচেয়ে আলোচিত নারী চরিত্র 'থাপ্পড়' এর অমৃতা। সাদাসিধে ছোট কোনো ঘটনাও যে মানুষের জীবন পালটে দিতে পারে পুরোপুরি, সেটাই দেখি এখানে। আবার ঘটনা ছোট হলেই তার ব্যপ্তি যে কম হবে, এমনটাও তো না। পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির সামনে দাঁড়িয়ে 'অমৃতা' চরিত্রটি হয়ে দাঁড়ায় প্রতিবাদের আরেক নাম। পুরো সিনেমাজুড়ে এ চরিত্রের মধ্যে মানসিক অস্থিরতা, চিন্তার ভঙ্গুরতা এবং জটিলতার যে মিশেল দেখি, তা অভিনব-দুর্দান্ত-স্বকীয়। 'অমৃতা' চরিত্র এখানেই সার্থক। এবং ঠুনকো পুরুষতান্ত্রিক আগ্রাসনের বিপক্ষে যে বার্তা দেয় পর্দার অমৃতা, তা দর্শককেও যেন খানিকটা সবক দেয়; বোধের, বিবেকের।
১০. তারা মহেশ্বরী (তামাশা)
ইমতিয়াজ আলীর সিনেমা মানেই চিন্তাভাবনার একেকটা নতুন দরজা খুলে যাবে... এ তো ধ্রুবসত্যি। 'তামাশা'ও ঠিক একই পথের পথিক। সিনেমার গল্প, 'তারা মহেশ্বরী' এবং 'বেদ বর্ধন সাহনি' চরিত্রদ্বয়ের অভিনয়শৈলী; দুর্দান্ত, স্রেফ দুর্দান্ত। তবুও সবকিছু ছাপিয়ে 'তারা মহেশ্বরী' চরিত্রটি যেন আলাদা করে নজর কাড়ে। এ চরিত্রটির জীবনে নানাবিধ জটিলতা থাকার পরেও সে ভালোবাসা রক্ষার জন্যে যেতে পারে যেকোনো দূরত্বে। মনস্তাত্বিক জটিলতাকে সামলে সে বুঝতে চায় প্রিয় মানুষের আকুতি, বিষাদ কিংবা উদ্বেগ। আবেগি, অনুভূতিপ্রবন এবং সংবেদনশীল হৃদয়ের এক মানুষ হিসেবেই তার রূপান্তর ঘটে আমাদের সামনে। আর ঠিক এভাবেই 'তারা মহেশ্বরী' হয়ে যায় প্রাসঙ্গিক, আরাধ্য এবং খুব কাছের কেউ।
বলিউডের সিনেমাগুলোতে এরকম দুর্দান্ত নারী চরিত্রের উপস্থিতি যতবার দেখেছি, চমকে উঠেছি। চরিত্রগুলোর রূপ-রস-বর্ণন এতটাই অভূতপূর্ব সুন্দর, বিস্ময় বেড়েছে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, নারী চরিত্রের এরকম অপূর্ব বিন্যাস বলিউডে হয় কদাচিৎ। বাকিসব সময়ে এমন সব লেজেগোবরে নারী চরিত্র দেখি, বিব্রত হই। অতীতে দেখা দুর্দান্ত নারী চরিত্রগুলোর কথা মনে পড়ে আর কানে বাজে রবিঠাকুরের সে গান-
মাঝে মাঝে তব দেখা পাই, চিরদিন কেন পাই না?
তথ্যসূত্রঃ ফিল্ম কম্প্যানিয়ন