যে সিনেমা দেখার পরে গল্প মনে থাকেনা, খুঁটিনাটি মনে থাকে না, মনে থাকে শুধু টুকরো দৃশ্য, সে সিনেমাই 'সিনেমা'র গণ্ডি উতরে পরিণত হয় শিল্পে। আর, 'হাওয়া' পুরোপুরিই সেরকম এক সিনেমা। একবিন্দু বাড়িয়ে না বলেও, এটাই 'হাওয়া' প্রসঙ্গে চূড়ান্ত মতামত।

হারুকি মুরাকামি'কে অনেকে পছন্দ করেন তার সাররিয়ালিস্টিক গল্পের কারণে। অনেকে পছন্দ করেন তার সহজ-সরল গল্প-বয়ানের কারণে৷ আবার কিছু মানুষ আছে, যারা মুরাকামির এ সোজাসাপ্টা ন্যারেশন পছন্দ করেন না। দেখা গেলো, তারা মুরাকামি না, হয়তো কাফকা'র গল্প পছন্দ করেন। বলা বাহুল্য, কাফকা'র গল্প প্রচলিত বয়ান থেকে অনেকটুকুই ভিন্ন। খানিকটা দুর্বোধ্যও। এবার, এক দল 'মুরাকামি'কে পছন্দ করে বলে 'কাফকা'কে নাকচ করে দেবে, আবার 'কাফকা'র ফ্যানরা 'মুরাকামি'কে নাকচ করে দেবে, এটা কিন্তু হয় না। কারণ, মোদ্দা কথা এটাই, লেখক হিসেবে দুজনেই অনবদ্য। এবং, দুজনের লেখার এই যে ভিন্ন ভিন্ন টোন এবং অ্যাটমোস্ফিয়ার, এটাই বৈচিত্র‍্য। এবং, যেকোনো ক্ষেত্রেই এই বৈচিত্র‍্যটুকু থাকা দরকার। 

বাংলাদেশি সিনেমার ক্ষেত্রে এই বৈচিত্র‍্যের অভাব বহুদিন ধরেই। এখানের বহুপ্রাচীণ 'ক্লিশে কমার্শিয়াল' স্ট্রাকচারের সিনেমা দেখতে দেখতে আমাদের অনেকের দেখার জিভে আস্তরণ পড়েছে। স্বাদগ্রন্থি হয়েছে অকেজো। এবং, এরকম এক অবস্থায়, যখন সম্পূর্ণ ভিন্ন স্বাদের সিনেমা 'হাওয়া' মুক্তি পেয়েছে, জিভগ্রন্থিতে অনাস্বাদিতপূর্ব এক আবহ দিয়েছে, তখন দর্শক স্বাভাবিকভাবেই হতচকিত হয়েছে। খানিকটা ভিন্ন স্বাদের সন্ধানে স্থানুও হয়েছে হয়তো। 'হাওয়া' নিয়ে মুগ্ধতার শুরু এখান থেকেই। 

এ সিনেমা নিয়ে অনেক কথা বলা যায়। অনেকগুলো বিষয়ে বিস্ময়-জনিত প্রগলভতা দেখানো যায়। তবে, সেসব বাদ দিয়েও, এ সিনেমার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক মনে হয়েছে- আপোষহীনতা'কে। 'আপোষহীনতা' এই অর্থে- এই সিনেমার শুরু থেকে শেষতক নির্মাতা মেজবাউর রহমান সুমন একটা গল্প বলতে চেয়েছেন। সে গল্পে রূপকথা-মিথোলজি মিলিয়েছেন। নানারকম লেয়ার এনেছেন। এবং, এসব মিলিয়ে-মিশিয়ে গল্পের যে অবয়ব দাঁড়িয়েছে, তা কখনো সোজাসাপ্টা, আবার কখনো খানিকটা সর্পিল ঘূর্ণির আভাসও দিয়েছে। তবে, এখানে, সাহসের বিষয় এটাই, মাস-পিপলকে তুষ্ট করার জন্যে সুমন এখানে রাখেননি কিছুই। গল্পের প্রয়োজনে যেখানে যা দরকার, এনেছেন সব। বাড়তি কিছু না। গল্পকেই দিয়েছেন হোমাজ। এবার, সে হোমাজ যদি কারো ভালো লাগে তো ভালো কথা, নাহয়, কিছু বলার নেই। সে প্রসঙ্গে মেজবাউর রহমান সুমন'ও বলেছিলেন-

আমার সিনেমা হয়তো সবার ভালো লাগবেনা।

যদিও, আমার প্রচণ্ড ভালো লেগেছে, 'হাওয়া'র এ ট্রিটমেন্ট। যারা সুমনের কাজের সাথে পরিচিত, তারা জানেন, এ নির্মাতা তার নির্মাণের শেষটায় দাড়ি না টেনে, বরাবরই টানেন কমা। 'হাওয়া'তে সেটাও টানেননি। এ নির্মাণের শেষে কোনো যতিচিহ্নই নেই। দর্শককে তিনি ছেড়ে দিয়েছেন এমন এক পাথারে, যে পাথারের চারপাশে থইথই রহস্য আর প্রবল উত্তেজনা। গল্পের শেষটাতে যদিও একটা পরিণতি আছে, কিন্তু, সে পরিণতি যে বেশ অর্থবোধক, তাও না। এবার ভাবুন, দর্শক গাঁটের পয়সা খরচ করে সিনেমাহলে যাবে আড়াই ঘন্টার বিনোদনের জন্যে, সেখানে এমন এক সিনেমা দেখানো হচ্ছে, যা দর্শকের মনস্তত্ব নিয়ে খেলছে, দর্শককে বিভ্রান্ত করছে, এরকমটা খুব কি দেখি বাংলাদেশে? বিদেশে? নিশ্চিত না। 

সিনেম্যাটোগ্রাফী না যেন একেকটা ফ্রেম! 

'হাওয়া'র গল্পে জটিল গলিঘুঁজি খুব একটা নেই। মাঝ-সমুদ্রে ভেসে থাকা মাছ ধরার বড় নৌকা, আর সেখানে বসবাসরত মাঝি-মাল্লা আর এক নারী... এই নিয়েই গল্প। সে গল্পে সাসপেন্স আছে, যৌনতার ইঙ্গিত আছে, ক্লাস স্ট্রাগল আছে, কমিক রিলিফ আছে, ক্লাইম্যাক্সের নেইল বাইটিং মোমেন্টও আছে। যদিও গল্প স্লো-বার্ণ, তবে সময়ের প্রয়োজনে সে গল্পের গতিও বেড়েছে৷ আবার, কমেছে। আবার, কিছু ক্ষেত্রে গল্প ভেসেছে, 'হাওয়া'র 'নয়ন-তারা' সাম্পানের মত, নানা পথে। বিবিধ গন্তব্যে। 

তবে, এই গন্তব্যের পুরো পথে অধিকাংশ সময়েই থমকেছি কামরুল হাসান খসরু'র সিনেম্যাটোগ্রাফী দেখে। সূর্যাস্তের পিছলে যাওয়া আলোয় ভাস্বর সমুদ্র, আদিগন্ত নীল জলে বিন্দুর মত অসহায়; ভেসে থাকা জলযান, ছেঁড়া পাল আর ভরা চাঁদের বৈপরীত্য, ক্যামেরার অ্যাঙ্গেলে 'শিকার' ও 'শিকারী'র ক্লাস ডিফারেন্সের পোর্ট্রেয়াল... 'হাওয়া'র জন্যে কামরুল হাসান খসরু'র ক্যামেরা বোধহয় রূপান্তরিত হয়েছিলো তুলিতে। যে তুলি দিয়ে ক্যানভাসে ইচ্ছেমত রঙ চড়িয়েছেন তিনি। যা দেখে চোখের শান্তির পাশাপাশি মনের শান্তিও এসেছে বিস্তর।

শান্তি দিয়েছে 'হাওয়া'র কুশীলবেরাও। চরিত্রকে Own করা বলে যে বিষয়টা শুনি, 'চরিত্রের খোলসে ঢুকে যাওয়া' বলে যে শব্দবন্ধ আমাদের কানে আসে প্রায়ই, সেটাই স্পষ্ট 'হাওয়া'র চান মাঝি, এজা, নাগু, ইব্রাহিম, মরা, উরকেস, পারকেস কিংবা গুলতি'র ক্ষেত্রে। চঞ্চল চৌধুরীর পান খাওয়া লালচে দাঁতে খোনা স্বরের চিৎকার, 'তুষি'র ধনুকের ছিলার মত টানটান অভিনয়, নাসির উদ্দিনের প্রিসাইজ কমিক রিলিফ, শরিফুল রাজের ক্যারেক্টার আর্ক... কোনোটাই কম না। এবং, অনেকগুলো চরিত্র থাকার পরেও চরিত্রগুলোর  যে বন্টন, সে বন্টনে একমাত্র 'সোহেল মণ্ডল' ছাড়া বাকি সবার করার এবং দেখাবার সুযোগ যেরকম পর্যাপ্ত, তারা করেনও দুর্দান্ত। 

আবারও মুগ্ধ করলেন চঞ্চল চৌধুরী 

'হাওয়া'র গল্পটা যদি আরেকটু জটিল হতো, এখানে যদি আরো কিছু মেটাফোর যুক্ত হতো, সোশ্যাল কনটেক্সটে কিছু রিলেভেন্ট কোটেশনস যদি আসতো ক্যারেক্টারগুলো থেকে, তাহলে হয়তো তৃপ্তি আরেকটু বাড়তো। তবে, সেসব না হলেও এটুকু বলতেই পারি- 'হাওয়া'র এই সামুদ্রিক জীবন, নৌকার মৃদু দুলুনি আর জলের নীচের সুরমা মাছের খলবলানি... এসবের বড়পর্দায় যে এক্সপেরিয়েন্স, সেটা অনেকটুকুই স্বকীয়। এ সিনেমা হয়তো পরবর্তীতে ওটিটিতে আসবে, মোবাইল, ল্যাপটপ, টেলিভিশন সব মাধ্যমেই দেখা যাবে, কিন্তু, সেখানে খামতি থাকবে অনেকটুকুই। সিনেমাহলে এ সিনেমা দেখার যে এক্সপেরিয়েন্স, যাকে আমরা 'সিনেম্যাটিক এক্সপেরিয়েন্স' বলি, সেটা পাওয়ার জন্যে যে শুধুমাত্র সিনেমাহলেই আসতেই হবে, এরও নেই কোনো ব্যত্যয়। 

নাজিতা তুষি বিস্মিত করেছেন অভিনয়ে 

এবং, মাথায় রাখতে হবে এটিও, যে সিনেমা দেখার পরে গল্প মনে থাকেনা, খুঁটিনাটি মনে থাকে না, মনে থাকে শুধু টুকরো দৃশ্য, সে সিনেমাই 'সিনেমা'র গণ্ডি উতরে পরিণত হয় শিল্পে। আর, 'হাওয়া' পুরোপুরিই সেরকম এক সিনেমা। একবিন্দু বাড়িয়ে না বলেও, এটাই 'হাওয়া' প্রসঙ্গে চূড়ান্ত মতামত। উপসংহার।


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা