বড়সড় স্টারকাস্ট নেই, যৌনতা নেই, মিনিটে মিনিটে টুইস্টের থ্রিল নেই, আছে কথোপকথনে হালকা বিদ্রুপ, খানিকটা রস, টুকরো টুকরো সুখ-দুঃখ অভিযান, মুহুর্তবন্দী রঙ আর রঙের স্রোতে ভেসে যাওয়া মধ্যবিত্ত জীবন- এসব নিয়েই সাজানো 'গুল্লাক' এর তৃতীয় আসর নিয়ে প্রত্যাশা ক্রমশই ঊর্ধ্বগামী। আশা থাকবে এটাই, অতীতের বিস্মৃতপ্রায় আরো কোনো এলাকায় যাওয়ার সুযোগ হবে 'গুল্লাক' এর বদান্যতায়।
'গুল্লাক' দেখতে বসা নেহায়েতই পাকেচক্রে। এবং শেষ করার পরে উপলব্ধি এটাই- যদিও গল্প খুবই সাদামাটা, কিন্তু এরকম সাদামাটা গল্প বলতেও দম লাগে বিস্তর। এ কথা তো সত্যি, আড়ম্বরহীন গল্পে মানুষকে মুগ্ধ করা যথেষ্ট হিম্মতের ব্যাপার। জটিল গল্পে মানুষকে চমকানো তো যায়ই। কিন্তু এমন এক গল্প, যে গল্পের সাথে রিলেট করতে পারবে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সিংহভাগ মানুষ, যে গল্পে ঠোঁটের পাশে প্রচ্ছন্ন হাসি আর চোখের কোলে জল, অস্ফুটস্বরে ভেতর থেকে একটাই বাক্য- 'এ গল্প তো আমারও'... 'গুল্লাক' এর চমৎকারিত্ব ঠিক সেখানেই। গল্পে আহামরি কোনো চমক নেই, সত্যি। কিন্তু যা আছে, শুধু সেটুকুই যে কাউকে চমকে দেয়ার জন্যে যথেষ্ট, সেটাও বা এড়াবো কি করে?
'গুল্লাক' এর এই যে মিশ্রা পরিবার, এ পরিবারের ছাপোষা চাকুরীজীবি বাবা, গৃহিনী মা, বেকার বড়ভাই এবং অলস ছোট ভাই মিলেমিশে এমন এক রসায়ন তৈরী হয়, যে রসায়ন আমাদের খুব পরিচিত। রাতে আচমকা বিদ্যুৎ চলে গেলে ছাদে গিয়ে সবাই মিলে বসা, ট্যাঁকের জোর না থাকা সত্বেও বাড়ি-গাড়ির আকাশকুসুম স্বপ্ন দেখা, সে স্বপ্নজনিত মতবিরোধে প্রবল উৎসাহে সামিলও হওয়া, বিশ্বকাপে নিজ দেশের খেলা আর অঙ্ক পরীক্ষার আগের দিন একবিন্দুতে লীন হয়ে যাওয়া, ছুটির দিনে মুরগি এনে জমিয়ে রান্না-খাওয়া, বিয়ের কার্ডে সবার নাম না লেখা থাকায় আত্নসম্মানে আঘাত লাগা, পাশের বাসার আন্টির লাগাতার খোঁচা, ভাইয়ে ভাইয়ে খুনসুটি কিংবা বাবার বিদ্রুপে মায়ের মান, সে মানভাঙার জন্যে বাবার আপ্রান্ত প্রচেষ্টা...এসবের অধিকাংশের সাথেই হয়তো কারো না কারো পূর্বস্মৃতি মিলে যাবে। অতীতের মেমোরি লেনে খানিক সময়ের জন্যে হলেও ঘুরিয়ে নিয়ে আসবে গুল্লাক। অবধারিতভাবেই আনবে। সেটাই এই নির্মাণের প্রধানতম চমৎকারিত্ব।
এই যে মধ্যবিত্ত পরিবার, যে পরিবারের বাবার কাছে সবার অনেক আবদার, হয়তো তার সীমিত আয়ে তিনি সবার আবদার পূরণ করার ক্ষমতা রাখেন না, তবু তিনি কারো আবদার নাকচও করে দেন না৷ বরং অপেক্ষা করেন ভালো সময়ের, যখন সবার আবদার পূরণ করতে পারবেন তিনি। যিনি অসৎ হওয়ার অজস্র চেষ্টা করেও কখনো অসৎ হতে পারেন না। দিনশেষে, 'সৎ মানুষ' হয়ে সংকীর্ণ ঘরের চৌহদ্দিতে ছোট সংসার নিয়েই যার সুখ... তিনিই মধ্যবিত্ত পরিবারের বাবা।
আবার, ওপ্রান্তে যিনি মা, তিনি নিয়মিতই তিতিবিরক্ত হন স্বামী-সন্তানের উপর, কিন্তু নির্ধারিত সময়ের চেয়ে সন্তানের ফেরার খানিক দেরী হলেই তার চোখে আশঙ্কার কুয়াশা নামে, বিশেষ উৎসবে যিনি সবার আগে কোমরে আঁচল গুজে নেমে পড়েন রান্নার আয়োজনে, যিনি স্বামীর ব্যবহারে বিমর্ষ হন, কিন্তু সেই স্বামীই যখন এক কাপ চা বানিয়ে আনেন, তখন মুখে হাসি ফোটে তার... এই 'মা' এর সাথেও কি আমরা পরিচিত না? আবার যদি ভাইদের কথা বলি, তাদের খুনসুটি, দ্বৈরথ, ক্ষেত্রবিশেষে হুলস্থুল মারামারি, মুখ দেখাদেখি বন্ধ, আবার, আচমকাই গভীর ভাব, একসাথে নানাবিধ পরিকল্পনা... এসবও কি আমাদের অপরিচিত? নির্ঘাতভাবেই না।
'গুল্লাক' দাবী করে, সে কাহানি বলে না, বলে কিসসা। কারণ, 'কাহানি' বানানো যায়। কিন্তু, 'কিসসা' সেটাই, যেটা আমাদের সাথে ঘটে। সেই প্রিয় 'কিসসা'র কারিগর 'গুল্লাক' এর তৃতীয় সিজন আসবে এপ্রিলে। ট্রেলারও মুক্তি পেলো। যে ট্রেলারের বরাতে জানা গেলো- মিশ্রা পরিবারের বড় ছেলে পেয়েছে চাকরী। বেতনও বেশ ভালো। যে ছেলের 'ফুটো কপাল' নিয়ে এতদিন সবাই ঠারেঠোরে কথা বলেছে, সে ছেলের কপালেই এখন সবাই ঈর্ষান্বিত। ওদিকে 'অফিস পলিটিক্স' এর দুষ্টচক্রে নাকাল হয়ে মিশ্রা পরিবারের কর্তা আবার হারিয়েছেন তার চাকরী। মূদ্রার দুইপ্রান্তে দুই রকম সংবাদ নিয়েই শুরু হবে এবারের সিজন।
কথোপকথনে হালকা বিদ্রুপ, খানিকটা রস, টুকরো টুকরো সুখ-দুঃখ অভিযান, মুহুর্তবন্দী রঙ আর রঙের স্রোতে ভেসে যাওয়া মধ্যবিত্ত জীবন... এসব নিয়েই সাজানো 'গুল্লাক' এর তৃতীয় আসর নিয়ে প্রত্যাশা ক্রমশই ঊর্ধ্বগামী। আশা করি, অতীতের বিস্মৃতপ্রায় আরো কোনো এলাকায় যাওয়ার সুযোগ হবে 'গুল্লাক' এর বদান্যতায়। এই বিক্ষুব্ধ সময়ের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে 'গুল্লাক' যেভাবে সম্মোহিত করে রাখে জীবনের ছোট ছোট জংশনে, সেটা দেখার জন্যেই থাকবে মূলত তীব্র অপেক্ষা।