বরাবরই লক্ষ্য করেছি, বাংলায় 'পিরিয়ড ফিল্ম' করার চেষ্টা হলেই কোনো এক অদ্ভুত কারণে নির্মাতারা জড়ভরত হয়ে যান! গল্প হয়তো আগের, কিন্তু গল্প বলার ধরণে তো নতুনত্ব আসতে পারে! সেই নতুনত্বের আঘ্রাণই অনুপস্থিত থাকে বারবার। একঘেয়ে ক্যামেরার কাজ, আদ্যিকালের গল্প বয়ান, ঢিমেতালের আবহসংগীত এবং শ্লথগতির ঘটনা-পরম্পরার বিন্যাসে যেভাবে আটকে থাকেন নির্মাতারা, তা মর্মপীড়ারও কারণ হয়। যে মর্মপীড়া অনুভব করি 'গোলন্দাজ' এর ক্ষেত্রেও...

নরেন্দ্র প্রসাদ সর্বাধিকারী... বিশেষ এই নামটির সঙ্গে সবাই যে খুব পরিচিত, এমন না মোটেও। কিন্তু যারা উপমহাদেশের ক্রীড়া-ইতিহাস নিয়ে খানিকটা হলেও ওয়াকিবহাল, তাদের নিঃসন্দেহে জানা- নরেন্দ্র প্রসাদ সর্বাধিকারী, ভারতে ফুটবল খেলার জনক। যদিও অন্যান্য বহু খেলাই তিনি খেলেছেন, কিন্তু, তা সত্বেও শুধুমাত্র ফুটবল নিয়ে তার যে অনুরাগ-ত্যাগ-সাফল্য, অন্য আর কোনো খেলাই ছাপিয়ে যেতে পারেনি তা। দশ বছর বয়সে প্রথমবারের মতন ময়দানে গোরাদের ফুটবল খেলতে দেখে এই বিস্ময়-গোলকের প্রতি যে অদ্ভুত আকর্ষণ তৈরী হয় ছোট্ট নরেন্দ্র'র, সে আকর্ষণ তাই ক্রমশই বাড়ে। ফুটবলকে সম্মুখে রেখে ক্রমশ বর্ণবৈষম্য, শোষন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে নরেন্দ্র করে যান শাণিত প্রতিবাদ। 

এরকম অসাধারণ এক মানুষের জীবনী নিয়ে যখন 'গোলন্দাজ' নির্মাণের ঘোষণা এলো, বাংলার স্পোর্টস জনরার 'ম্যাগনাম ওপাস' হতে যাচ্ছে এই নির্মাণ...বলে যখন মুক্তির আগেই শোরগোল ফেলে দেয়া হলো, তখন খানিকটা নড়েচড়েই বসেছিলাম। মহামারীর পরে হলগুলোর বদ্ধ পাল্লা ধীরে ধীরে খুলছে, এরকম এক সময়ে হাই এক্সপেকটেশনের কমার্শিয়াল সিনেমাই তো দরকার, আর সে সিনেমার প্রোটাগনিস্ট যদি হয় দেবের মত সুপারস্টার, তাহলে তো কথাই নেই। খানিকটা 'মণিকাঞ্চনযোগ' পাবার উচ্ছ্বাস নিয়েই বসেছিলাম 'গোলন্দাজ' দেখতে। 

কিন্তু প্রাথমিক উচ্ছ্বাসের বাড়া ভাতে ছাই পড়ে সিনেমা শুরুর কিছু সময় পরেই। বরাবরই লক্ষ্য করেছি, বাংলায় 'পিরিয়ড ফিল্ম' করার চেষ্টা হলেই কোনো এক অদ্ভুত কারণে নির্মাতারা জড়ভরত হয়ে যান! গল্প হয়তো আগের, কিন্তু গল্প বলার ধরণে তো নতুনত্ব আসা উচিত! সেটাই যেন বারবার হারিয়ে ফেলি। ক্যামেরার কাজ, আদ্যিকালের গল্প বয়ান, ঢিমেতালের আবহসংগীত এবং শ্লথগতির ঘটনা-পরম্পরার বিন্যাস... এ জাতীয় নির্মাণ দেখতে গেলে ধৈর্যের বাঁধ খুব কষ্টে আগলে রাখতে হয় বরাবর! এবং ঠিক একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয় 'গোলন্দাজ' এর ক্ষেত্রেও। নরেন্দ্র প্রসাদ সর্বাধিকারীর বৈচিত্র্যময় জীবনগল্পকে যেভাবে ম্যাড়মেড়ে করে বর্ণনা করা হয়েছে এখানে, তা খানিকটা আশাহতও করে। গল্প চমকপ্রদ হলেও সে গল্পের এক্সিকিউশনটাই যেন ক্রমশ সেকেলে সময়ের ইঙ্গিত দিয়ে যায়! 

ত্রুটি লক্ষ্য করি ক্যারেক্টার ডেভেলপমেন্টেও। আমরা বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রির অজস্র পিরিয়ড ফিল্মে দেখেছি, মূল গল্পে প্রোটাগনিস্ট একজন থাকলেও আশেপাশের সাপোর্টিং ক্যারেক্টারদের ব্যাকস্টোরিও খুব ভালোভাবে ডেভেলপ করা হয়েছে বরাবর। যেকোনো নির্মাণের জন্যে এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ এক বিষয়। আর 'স্পোর্টস' জনরার সিনেমার ক্ষেত্রে এটা শুধু দরকারই না, এটা মেরুদণ্ডের মত প্রধানতম একটা বিষয়। আমরা যদি 'লগান' সিনেমাটা দেখি, সেখানে 'ভুবন' প্রোটাগনিস্ট হলেও বাদবাকি যারা সাইড-ক্যারেক্টার, তাদেরও হাবভাব-আচরণের মোটামুটি একটা ধারণা দেয়ার চেষ্টা করেছেন নির্মাতা। এবং এই ধারণাটুকু পাওয়া খুব দরকার, নাহয় সিনেমার সাথে দর্শকের যোগাযোগ সেভাবে তৈরী হয় না। যে সমস্যা খুব তীব্রভাবে প্রকট 'গোলন্দাজ' এর ক্ষেত্রে। এই সিনেমার একটা নির্দিষ্ট সময় পরে গল্প শুধুই 'নরেন্দ্র প্রসাদ' কিংবা 'দেব'ময়। যেসব সংকট হচ্ছে, দেবের সাথেই হচ্ছে। যা কিছু গ্লোরিফাই করার মতন, তাও দেবের মাধ্যমেই হচ্ছে। ফুটবল টিমওয়ার্কের খেলা, সেই খেলাকে উপজীব্য করে নির্মিত সিনেমায় যদি একজনই ছাপিয়ে যান বাদবাকি সবাইকে, সেখানে সেই সিনেমার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে খানিকটা চাপানউতোর তৈরী হয়ই। হওয়াটা স্বাভাবিকও। 

'গোলন্দাজ' এর আরেক সংকট, স্বল্প বাজেট। সিনেমার বাজেট নিয়ে বাংলার নির্মাতারা বরাবরই বিস্তর সংকটে ভোগেন। সে সংকট কাটাতে নির্মাতারা অনেক কিছুর সাথে আপোষও করেন। সেট ডিজাইনের সাথে আপোষ , ক্যামেরার কাজের সাথে আপোষ,  এক্সপেরিমেন্ট করা নিয়ে আপোষ হয় নিয়মিত। এবং এসব আপোষের মিলিত ফলশ্রুতিতে কাজটিও ঠিক খোলতাই হয় না শেষমেশ।'গোলন্দাজ' এ যেমন দেখা যায়, প্রচুর ক্যামেরার জারিজুরি রয়েছে। দুই এক জায়গায়, যেখানে ছিটেফোঁটা ভিএফএক্স এর কাজ রয়েছে, সেটাও ঠিক বিশ্বাসযোগ্য নয়। সেট ডিজাইন কিংবা মেকআপ... স্বকীয় কিছুই নয়! বরং অনেককিছুই আরোপিত। 

দেব ছাড়া কেউই সেভাবে অভিনয়ের সুযোগ পেলেন না 'গোলন্দাজ' এ! 

তবে ঋণাত্মক অনেক কিছু থাকা সত্বেও 'গোলন্দাজ' এর সবচেয়ে ভালো দিক, অভিনেতা দেব। দেবের এই বিষয়টা প্রশংসনীয়, তিনি ফুলটাইম কমার্শিয়াল অভিনেতা হওয়া সত্বেও মাঝেমধ্যেই এরকম এক্সপেরিমেন্টাল কাজে নেমে পড়েন। এই 'জুলফিকার' এর মতন পুরোদস্তুর কমার্শিয়াল কাজ করছেন তো, পরবর্তীতেই নেমে যাচ্ছেন 'সাঁঝবাতি' কিংবা 'বুনোহাঁস' এর মতন আর্টফিল্মে। এই সাহস সব কমার্শিয়াল সুপারস্টাররা দেখান না। তাছাড়া ভিন্ন রকমের এই নির্মাণগুলোতে দেবের শতভাগ দেয়ার প্রচেষ্টাও থাকে চোখে লেগে থাকার মতন! তার উচ্চারণ নিয়ে খানিকটা সমস্যা আছে, অভিনয়েরও কিছু কিছু বিষয়ে সীমাবদ্ধতা আছে, তিনি সেগুলো জানেন। এবং সেগুলো উত্তরণের জন্যেও আপ্রাণ চেষ্টা করেন। যেটা শতভাগ বজায় ছিলো 'গোলন্দাজ' এর সময়েও। তাছাড়া 'সুঠামদেহী বাঙ্গালী খেলোয়াড়' চরিত্রে দেবের চেয়ে ভালো বিকল্পও সেভাবে নেই। সেসব বিবেচনায়, 'গোলন্দাজ' যদি কোনো বিশেষ কারণে দেখতে হয়, তাহলে তা দেখা উচিত দেবের দারুণ অভিনয় দেখার জন্যেই! 

দেবের জন্যে হলেও এ নির্মাণ দেখা যায় একাধিকবার! 

দ্বিতীয় যে কারণে এই সিনেমা দেখা যেতে পারে, সেই কারণের পুরোভাগে নরেন্দ্র প্রসাদ সর্বাধিকারী। আমরা এখন সময়ের যে প্রকোষ্ঠে দাঁড়িয়ে আছি, সে প্রকোষ্ঠে এসে আমরা জানতে চাই কম, ভাবতে চাই তার চেয়েও কম। সেরকম এক সময়ে এসে মানুষকে কোনো মনীষী  সম্পর্কে জানাতে চাইলে সিনেমার চেয়ে ভালো কোনো মাধ্যম আছে বলে মনে হয় না। এই সিনেমার আগে ভারতের ফুটবলের জনক কে হয়তো অনেকেই চিনতেন না, যেমন অনেকেই 'শেরশাহ' এর আগে চিনতেন না বিক্রম বাত্রাকে। সিনেমার মাধ্যমে অতীতকে জানানোর এই প্রক্রিয়াটা বেশ জরুরি। নির্মাতা ধ্রুব ব্যানার্জী সাহস সঞ্চার করে বিশেষ এ কাজটি যে করেছেন, সেজন্যে একটা বড়সড় ধন্যবাদ তিনি অবশ্যই পাবেন। 

তবে আক্ষেপ এটাই, চাইলে 'গোলন্দাজ' নিয়ে আরো বহুকিছু করা যেতে পারতো। ঘটনা, চরিত্র, গল্প বয়ানে খানিকটা চকমকি পাথরের স্পর্শ পড়তেই পারতো। সেসব যে কিছুই করা গেলো না বা পাওয়া হলো না, সেজন্যে 'পিরিয়ড ফিল্মের জুজু'ই অনেকাংশে দায়ী। নির্মাণজনিত এ সংকট কবে কাটবে, জানা নেই কারো। তবে প্রত্যাশা এটাই, যদি পিরিয়ড ড্রামার নিয়মিত বাজেট পাওয়া যায়, তাহলে এ জনরা নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট হবে ক্রমশ। এভাবেই নিয়মিত নির্মাণের বদৌলতে কোনো এক সময়ে নির্মাতারা হয়তো যাপিত সংকট কাটিয়ে উঠবেন। ভাঙ্গবেন দুর্দশার চক্র। প্রোপার পিরিয়ড ফিল্ম বলতে যা বোঝে দর্শক, সেরকম নির্মাণই আসবে বাংলায়। সেদিকপানে তাকিয়ে 'গোলন্দাজ'জনিত দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর আক্ষেপ নিয়ে এখানে তাই যাত্রাশেষের দাগ টানাই প্রাসঙ্গিক।


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা